বাংলাদেশ ক্রিকেট

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলার সামর্থ্য রাখে: উইলকিন্স

ফয়সাল হাবিব

ফয়সাল হাবিব
প্রকাশের তারিখ: 22:24 বৃহস্পতিবার, 11 মে, 2023

|| ক্রিকেট করেসপন্ডেন্ট ||

প্রায় চার দশক ধরে ক্রিকেটের সঙ্গে নিজের গল্প লিখে যাচ্ছেন অ্যালান উইলকিন্স। শুরুটা হয়েছিল ক্রিকেটার হিসেবে, কাউন্টি ক্রিকেটে খেলেছেন গ্ল্যামারগান এবং গ্লুচেস্টারশায়ারের জার্সিতে। বাঁহাতি মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে নিয়েছেন ৩৭৩ উইকেট। যদিও নিজে ক্রিকেটার উইলকিন্সকে ‘অ্যা জার্নিম্যান কাউন্টি ক্রিকেটার’ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

কাঁধের চোটে ক্রিকেট খেলা ছাড়তে হয়েছিল উইলকিন্সকে। যদিও ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরাতে পারেননি ওয়েলশের সাবেক এই পেসার। পেশাদার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের ইতি টানার পর সাউথ আফ্রিকায় ব্রডকাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। এরপর হয়েছেন জনপ্রিয় ক্রিকেট ধারাভাষ্যকার। আকর্ষণীয় উপস্থাপনার সঙ্গে দুর্দান্ত ভয়েস, সেন্স অব হিউমার আর তথ্য বহুল ধারাভাষ্য মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে তাকে।

আয়ারল্যান্ড-বাংলাদেশ সিরিজেও ধারাভাষ্যকার হিসেবে কাজ করছেন উইলকিন্স। যেখানে বাংলাদেশকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। ২০০০-০১ সময়টাতেও বাংলাদেশকে দেখেছেন সাবেক এই বাঁহাতি এই পেসার। ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে একান্ত আলাপকালে বাংলাদেশের বদলে যাওয়া, পেস বোলিং ইউনিট, হাসান মাহমুদের বোলিংয়ে মুগ্ধতার আর ওয়ানডে বিশ্বকাপে তামিম ইকবালদের সম্ভাবনার কথা বলেছেন উইলকিন্স।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: এটা আসলে প্রথম দিনের কথা। হাসান যখন বালবির্নিকে আউট করল তখন আপনি ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন আর বলছিলেন সে বাংলাদেশের জন্য খুব সম্ভাবনাময়ী পেসার। আজকে তাকে বোলিং করতে দেখলেন। আপনিও তো একজন পেসার ছিলেন, কেমন দেখলেন তাকে?

অ্যালান উইলকিন্স: প্রথম ম্যাচে আমি তাকে প্রথমবারের মতো বোলিং করতে দেখেছিলাম। আমি তার পরিসংখ্যান দেখছিলাম যে সে বাংলাদেশের মাটিতে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৩২ রানে ৫ উইকেট পেয়েছিল। আমি নতুন এই পেস বোলার সম্পর্কে খানিকটা পড়েছি। প্রথমত তার বোলিং অ্যাকশনটা একেবারে আরামদায়ক, অ্যাপ্রোচটাও বেশ ভালো। বলতে গেলে একেবারে সহজ একটা অ্যাকশন। প্রথম যে তিনটা বল সে করেছিল সেটা খানিকটা অ্যাওয়ে সুইং ছিল।

এরপর রিস্ট পজিশনে সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন করে এবং ইনসুইং একটা ডেলিভারি করে। সেই বলে অবশ্য আগের তিন বলের তুলনায় পেস খানিকটা বেশি ছিল। সেই ওভারে সে তিনটি অ্যাওয়ে সুইং আর তিনটি ইনসুইং ডেলিভারি করেছিল। এরপর অ্যান্ড্রু বালবির্নিকে সে যে বলটা করল সেটা সত্যিই দুর্দান্ত। রিস্ট পজিশনে একটু পরিবর্তন এনে সে এমন একটা ডেলিভারি করেছিল যা বেশ ভালো। 

আপনি তখনই একজন ভালো বোলার হতে পারবেন যখন আপনি আত্মবিশ্বাসী থাকবেন। আপনাকে প্রয়োজন অনুযায়ী রিস্ট পজিশনও পরিবর্তন করতে পারতে হবে। আমার কাছে খুবই সম্ভাবনাময়ী একজন। তার অ্যাকশন আপনি পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন এবং তাকে দেখে মনে হয় সে ভেতর থেকে বল করে। আপনি যখন দীর্ঘ সংস্করণ অর্থাৎ টেস্ট ক্রিকেটের কথা বলবেন তখন আমার মনে হয় সে লম্বা স্পেলে বোলিং করতে পারবে। এটা দারুণ ব্যাপার হবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার কি মনে হয় যে সে শুধু দক্ষই না ইনসুইং আর আউট সুইংয়ের ক্ষেত্রে বুদ্ধিদীপ্ত এবং ম্যাচিউড?

অ্যালান উইলকিন্স: সে চিন্তাশীল বোলার। সে শুধু বোলিং করার জন্য দৌড়ায় না, সে বোলিংয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা করে। আপনি আসলে তার মাথায় কৌশল দেখতে পারবেন। তার বেশ কিছু আউট সুইংগার এবং ইনসুইংগার দেখে খানিকটা গ্লেন ম্যাকগ্রার মতো মনে হয়েছে। গ্লেন ম্যাকগ্রা যেমন আউট সুইং করতেন তারপর এভাবেই হুট করে ইনসুইং করতেন। আমি এর চেয়ে বেশি কিছু বলে প্রশংসা করতে পারি না যে সে আমার কাছে খানিকটা মিনি গ্লেন ম্যাকগ্রা। সে একই ধরনের অ্যাকশন পেয়েছে।

আমি বলতে চাচ্ছি যে গ্লেন ম্যাকগ্রা লম্বা বোলার। সে তার মতো অ্যাকশনই পেয়েছে এবং রিস্ট পজিশন পরিবর্তন ও পেস এমনভাবে ব্যবহার করে যেটা আমরা গ্লেন ম্যাকগ্রাকে করতে দেখতাম। জেমস অ্যান্ডারসন যেমনটা ইংল্যান্ডের হয়ে করে। জিমি হয়ত আরও বেশি সুইং পায় তবে ওই ব্যাপারটা তার মাঝে আছে। সে চিন্তাশীল বোলার এবং কি ধরনের ডেলিভারি সে করবে সেই পরিকল্পনা তার মাথায় আছে। আমার কাছে হাসান এমন একজন যার কিনা দারুণ সব পরিকল্পনা আছে এবং সেটা কাজে লাগাতে পারে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: হাসানের সঙ্গে এবাদত হোসেন, শরিফুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ এবং মুস্তাফিজুর রহমান রয়েছে। বাংলাদেশের পেস ইউনিটকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

অ্যালান উইলকিন্স: যখন আমি প্রথমবার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, আমি ২০০০/২০০১ সালের কথা বলছি। আমি সম্মানের সাথেই বলছি, বাংলাদেশের তখন কোনো পেস বোলার ছিল না। এটা নিয়ে আমি সমন্বয় ঘোষের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলছিলাম। আর সে আমাকে তাপস বৈশ্যর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। খালেদ মাহমুদ সুজনও তখন পেস বোলিং করতো তবে একেবারে সাদামাটা গতিতে। তখন বাংলাদেশের সবাই প্রায় স্পিনার ছিল। এখন বাংলাদেশের পেস বোলিং ব্যাটারিটা দারুণ।

এখানে অ্যালান ডোনাল্ড আছে। আপনি যদি র‌্যাঙ্ক করতে বলেন তাহলে ডোনাল্ডের চেয়ে ভালো কাউকে পেস বোলিং কোচ হিসেবে পাবেন না। আমার মনে হয় বাংলাদেশের সব ইউনিট এখন পরিপূর্ণ। দারুণ ব্যাটিং, স্পিনার বোলার, অলরাউন্ডার এবং এখন পেস বোলারও আছে। আপনি যাদের কথা বললেন তাদের মাঝে আবার প্রতিযোগিতা চলছে। ভুলে গেলে চলবে না প্রথম ম্যাচে শরিফুল ইসলাম খেলেছে এবং মুস্তাফিজুর (রহমান) খেলেনি। আমি আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে মুস্তাফিজ বেঞ্চে বসে থাকলেও খেলার জন্য মুখিয়ে ছিল।

আপনি সবসময় খেলতে চাইবেন কারণ আপনি সেখানে (বেঞ্চে) বসে থাকতে চাইবেন না। যদিও এটা একটা স্কোয়াড সিস্টেম। এই প্রতিযোগিতা দলের জন্য খুবই ভালো। তাসকিন এখানে নেই কিন্তু আপনাকে জায়গা পেতে লড়াই করতে হবে। আপনি যখন জায়গা পাওয়ার জন্য লড়াই করবেন তখন আপনার সেরাটা বেরিয়ে আসবে। আমার মনে হয় এটাই হওয়া উচিত। আমার কাছে বাংলাদেশের পেস বোলিং এখন অনেক মানসম্পন্ন এবং তাদের গভীরতাও আছে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি বললেন বাংলাদেশকে ২০০০/২০০১ সালে দেখেছেন। এখন ২০২৩ সাল, এই সময়টায় ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিংয়ে ইউনিট হিসেবে বাংলাদেশ কতটা এগিয়েছে?

অ্যালান উইলকিন্স: এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। তারা সব দলকেই হারিয়েছে। ভারত, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া যেই হোক না কেন বাংলাদেশে গিয়ে হেরেছে। ঘরের মাঠে বাংলাদেশ খুব কঠিন প্রতিপক্ষ। তাই আমার মনে হয় চেমসফর্ডের মতো মাঠে খেলা বাংলাদেশের জন্য উপকারে আসবে। কারণ এই ধরনের কন্ডিশনে খেললে আপনি আরও জানবেন, শিখবেন। পরবর্তীতে এটা আপনার আরও কাজে আসবে।

শুধু আর্থিক দিক দিয়েই বাংলাদেশ বিনিয়োগ করেনি, সব দিকেই করেছে। পেস বোলার খুঁজে বের করেছে, স্পিনারদের উন্নয়নে কাজ করেছে। নেতা তৈরি করেছে। সাকিব লম্বা সময় ধরেই টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডেতে অলরাউন্ডার হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করছে। মুশফিকেরও অবদান দিতে হয়, এসব ক্রিকেটারই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছে। তবে এটা অল্প দিনে হয়নি, বাংলাদেশ হোঁচট খেলেও শিখেছে, এগিয়েছে। এখন তারা বিশ্বমঞ্চে নিজেদের চেনাচ্ছে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ হবে। আপনি তো তাদের খেলতে এবং পারফর্ম করতে দেখলেন। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কতটা দূরে যেতে পারে বলে মনে হয়...

অ্যালান উইলকিন্স: যেহেতু ৫০ ওভারের খেলা, যেকোন কিছুই হতে পারে। তবে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলার সামর্থ্য রাখে। স্কোয়াডে দক্ষ পেসার আছে, স্পিনাররা আছে, ভালো মানের একাধিক অলরাউন্ডার আছে। তাই আমার মনে হয় ভারতে খুব ভালো করবে বাংলাদেশ। কারণ কন্ডিশন বাংলাদেশের পক্ষে থাকবে।

ঢাকা, সিলেট বা চট্টগ্রামের সাথে ভারতের কন্ডিশন ও উইকেটের বেশ মিল আছে। তামিম দলের নেতা, লম্বা সময় ধরে দলের সাথে আছে। আমার মনে হয় সে দলের সবাইকে এটা বিশ্বাস করাতে পারবে যে তারা ভারত বিশ্বকাপে বড় কিছু করে ফেলতে পারে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি শরিফুলের কথা বলছিলেন, এখানে তাওহীদ হৃদয়ও আছে। যারা কিনা যুব বিশ্বকাপে খেলেছে যেখানে আপনি ছিলেন। তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখে কেমন লাগছে এবং তারা কতদূর যেতে পারবে বলে ধারণা করছেন...

অ্যালান উইলকিন্স: তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখতে পারাটা দারুণ ব্যাপার। আমার শরিফুলের কথা মনে আছে যে কিনা লম্বা, বাঁহাতি, দ্রুতগতির বোলিংয়ে ২০২০ সালে সাউথ আফ্রিকায় নিজের ছাপ রেখেছিল। মৃত্যুঞ্জয়ও সেখানে ছিল কিন্তু ইনজুরির কারণে সে ফাইনাল খেলতে পারেনি। তারও আগে আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ২০১৬ সালে মেহেদি হাসান মিরাজ অধিনায়ক ছিল। এটা দেখে ভালো লাগছে কিভাবে দারুণ অনূর্ধ্ব-১৫ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়টি কিভাবে কাজ করছে।

যখন এই ধরনের ক্রিকেটার বেরিয়ে আসবে তখন আপনার বিসিবিকে অভিনন্দন জানাতে হবে। কারণ এটা ঠিকঠাক কাজ করছে। পুরো প্রক্রিয়াটাই কাজে দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি কেমন অনুভূব করছি সেটা নিশ্চয় আমার মুখের হাসি দেখেই বুঝতে পারছেন। আমার কাছে উন্নয়ন দেখতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৮ সালে প্রথম আমি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ করেছিলাম। যখন ভারত জিতেছিল।

সেসময় বিরাট কোহলি ভারতের অধিনায়ক ছিল। সেই দলে রবীন্দ্র জাদেজাও ছিল। তখন নিউজিল্যান্ড দলে কেন উইলিয়ামসন, টিম সাউদির মতো দারুণ কয়েকজন ক্রিকেটার ছিল। এই প্রক্রিয়াটা বেশ ভালো। প্রতিটা দেশ এখানে বিনিয়োগ করছে এবং ছেলেরা উচ্চ পর্যায়ে আসছে। তাতে করে দল উপকৃত হচ্ছে।