টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

সেরা বিশ্বকাপে কতটা ইমপ্যাক্টফুল বাংলাদেশ?

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 17:01 মঙ্গলবার, 08 নভেম্বর, 2022

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

অন্ধকার পেরিয়ে আবারও নতুন সূর্য উঠবে, এমন আশায় ১৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা। অবশেষে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে সেই আলোর ঝলকানি দিয়েছে সাকিব আল হাসানের দল। সাউথ আফ্রিকা, ভারত এবং পাকিস্তানের কাছে হারলেও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রত্যাশিতভাবেই জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। তাতে পুরো টুর্নামেন্টে ৫ ম্যাচ খেলা টাইগারদের পয়েন্ট মোটে চার। সুপার টুয়েলভের ২ নম্বর গ্রুপে থাকা ছয় দলের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান পাঁচ। টাইগারদের চেয়ে উপরে থেকে শেষ করে তুলনামূলক খর্বশক্তির দল নেদারল্যান্ডস। পাঁচে থাকলেও প্রথমবারের মতো কোন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার টুয়েলভে দুই জয় নিয়ে আসর শেষ করেছে লাল সবুজের দল।

এমন সাফল্যে এবারের টুর্নামেন্টকে নিজেদের সেরা বিশ্বকাপ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন সাকিব এবং শ্রীধরণ শ্রীরাম। কাগজে-কলমে হয়তো এটাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাস্তবতায় কি আসলেই বাংলাদেশ সেরা বিশ্বকাপ কাটিয়েছে? এটা নিয়ে ক্রিকেট অনুরাগী কিংবা বিশ্লেষকদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। বেশিরভাগই দাবি করছেন, এবারের বিশ্বকাপকে সেরা আসর বলার সুযোগ নেই। মাঠের পারফরম্যান্সে একমাত্র তাসকিন আহমেদ ছাড়া সেভাবে ছাপ রাখতে পারেননি কেউই। খানিকটা সুযোগ লুফে নিতে পেরেছেন নাজমুল হাসান শান্ত এবং হাসান মাহমুদরা।

পুরো বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটাররা হাফ সেঞ্চুরি করেছেন মোটে তিনটি। যেখানে শান্তর দুটির সঙ্গে রয়েছে লিটন দাসের একটি। লিটনের হাফ সেঞ্চুরি চোখের প্রশান্তি দিলেও অনেক প্রশ্ন রয়েছে শান্তর দুটি নিয়ে! স্ট্রাইক রেট বিবেচনায় পঞ্চাশ পেরোনো (দুটি হাফ সেঞ্চুরি মিলে) ধীরগতির ইনিংস খেলা ব্যাটারদের মাঝে তিনে আছেন শান্ত। তার উপরে রয়েছেন কেবল জিম্বাবুয়ের ক্রেইগ আরভিন এবং স্কটল্যান্ডের জর্জ মানসি। বাঁহাতি এই ব্যাটারের হাফ সেঞ্চুরি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে বোধহয় আর খুব বেশি পরিসংখ্যানের প্রয়োজন নেই। 

শান্ত থেকে খানিকটা পেছন ফিরে তাকানো যাক। এশিয়া কাপ শুরুর আগে বাংলাদেশের দায়িত্ব নেন শ্রীরাম। ভারতের সাবেক এই ক্রিকেটার বাংলাদেশের টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট হিসেবে যোগ দেয়ার পর থেকে এদেশে সবচেয়ে বেশি চর্চিত দুটি শব্দ 'ইমপ্যাক্ট' এবং 'ইন্টেন্ট'। দায়িত্ব নিয়েই ক্রিকেটারদের ইমপ্যাক্টফুল ইনিংস খেলতে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছেন এই ভারতীয় কোচ। তার অধীনে এশিয়া কাপ, ত্রিদেশীয় সিরিজ হয়ে বিশ্বকাপে খেলেছে বাংলাদেশ। 

বিশ্বকাপ এলেই বাংলাদেশের ক্রিকেটার, কোচ কিংবা বোর্ড কর্তারা একেকটা বাণী নিয়ে হাজির। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাটিতে অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মাসখানেক আগের মুহূর্তের কথাই ধরুন না, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে বাজে উইকেটে হারিয়ে অধিনায়ক জানিয়েছিলেন এই মোমেন্টামটা বিশ্বকাপে আমাদের অনুপ্রেরণা দেবে। অথচ ২০ ওভারের বিশ্বকাপে মাঠের পারফরম্যান্সে হয়েছে ঠিক উল্টোটা। মোমেন্টামের মতো এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য ছিল ক্রিকেটারদের ইন্টেন্ট এবং ইমপ্যাক্টফুল ইনিংস।  সেরা বিশ্বকাপ কাটিয়ে দেশে ফেরা বাংলাদেশে কতটা ইমপ্যাক্টফুল ক্রিকেট খেলল? সেটায় খানিকটা চোখ বুলানো যাক।

পারফরম্যান্সের বিচারে ইমপ্যাক্টফুল দলের র‌্যাঙ্কিং। তথ্যসূত্র: ক্রিকভিজ

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মূলত ২০ ওভারকে তিনভাগে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। যেখানে ১-৬ ওভার পাওয়ার প্লে, ৭-১৬ ওভারকে মিডল এবং শেষের চারকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে ডেথ ওভার হিসেবে। সেটাকে আমলে নিয়ে এই তিন জায়গাতে বাংলাদেশের ব্যাটার এবং বোলাররা কতটা ইমপ্যাক্ট রাখতে পেরেছেন সেটাকে ধরেই করা হয়েছে র‌্যাঙ্কিং। যারা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী তাদের জন্য এটা বুঝতে হয়তো খানিকটা সুবিধা হতে পারে। ইমপ্যাক্ট নির্ধারণ করতে গিয়ে ১-১২ মান নিয়ে একটা স্কেল বিবেচনা করা হয়েছে। যেখানে ১-৬ পর্যন্ত মান পাওয়া গেলে সেটি ভালো আর ৭-১২ মানকে ধরা হয়েছে খারাপ পারফরম্যান্স হিসেবে। 

ভালোর ক্ষেত্রে মান যত কম হবে সেই দল সেখানে তত বেশি ইমপ্যাক্ট রাখতে পেরেছে। বাজে দিকের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। এখানে মান যত বেশি সেই দল তত বাজে ইমপ্যাক্ট রেখেছে। এতসব সমীকরণ নিয়ে সুপার টুয়েলভে থাকা ১২ দলের পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে দেখা যায় সবচেয়ে ইমপ্যাক্টফুল ছিল নিউজিল্যান্ড। একমাত্র দল হিসেবে তারাই কেবল ৬টি ধাপে সবুজ সংকেত পেয়েছে।

১২ দলের র‌্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ নম্বরে। সাকিবদের নিচে রয়েছে কেবল আয়ারল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে এবং আফগানিস্তান। বাংলাদেশের চেয়ে র‌্যাাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকলেও ইমপ্যাক্টে তাদের ছাড়িয়ে সাত নম্বরে রয়েছে নেদারল্যান্ডস। পুরো টুর্নামেন্টে টাইগারদের স্বস্তির জায়গা কেবল পাওয়ার-প্লে। যেখানে ব্যাটে-বলে পারফর্ম করেছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।

ওপেনিংয়ে জুটি নিয়ে লম্বা সময় ধরেই চিন্তিত বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের আগেও মেইক শিফট ওপেনার দিয়ে কাজ চালিয়েছে তারা। তবে বিশ্বকাপে এসে সেখান থেকে সরে দাঁড়ায় শ্রীরামের কোচিং প্যানেল। দলের সেরা ওপেনার লিটনকে সরিয়ে বিশ্বকাপে ইনিংসের গোড়াপত্তন করতে দেয়া হয় শান্ত এবং সৌম্য সরকারকে। শান্ত দুটি হাফ সেঞ্চুরি পেলেও নিজের ছাপ রাখতে পারেননি সৌম্য।

সুপার টুয়েলভ পর্যন্ত এবারের বিশ্বকাপে পাওয়ার প্লেতে সবচেয়ে বেশি উইকেট হারিয়েছে এমন দলের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশে (পুরো টুর্নামেন্ট বিবেচনায়)। যেখানে ভারত-পাকিস্তানের সমান ৮টি উইকেট হারিয়েছে শান্তরা। সবচেয়ে বেশি ২৩ উইকেট হারিয়েছে ৮ ম্যাচ (প্রথম পর্ব সহ) খেলা জিম্বাবুয়ে। এদিকে পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশের ব্যাটাররা রান তুলেছে ১৬৬। উইকেট এবং রান বিবেচনায় বাংলাদেশ ইমপ্যাক্ট ৪, অর্থাৎ খানিকটা ভালো করেছে তারা। পাওয়ার প্লেতে এবার অবশ্য দাপট দেখা গেছে বাংলাদেশের বোলারদের মাঝে। বিশেষ করে বেশিরভাগ ম্যাচেই দুর্দান্ত ছিলেন তাসকিন। 

পাওয়ার প্লেতে এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বোলাররা নিয়েছেন ১০ উইকেট। তাসকিন-হাসানদের সমান উইকেট নিয়েছে ভারতের আর্শদীপ সিং-ভুবনেশ্বর কুমাররাও। পাওয়ার প্লেতে উইকেট নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশ। তবে রান দেয়ার ক্ষেত্রে ট্রেন্ট বোল্ট, হারিস রউফ, জস হ্যাজেলউডদের চেয়ে এগিয়ে তাসকিনরা। প্রতি ২০.৩০ রানে এক উইকেট নেয়া বাংলাদেশের বোলাররা পুরো টুর্নামেন্টে পাওয়ার প্লেতে রান দিয়েছে ২০৩। ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়েও ৪ নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশ। 

পাওয়ার প্লেতে ভালো করলেও মাঝের ওভারে এবং শেষের দিকে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই বাজে। ইমপ্যাক্টের হিসেবে মাঝের ওভারে বাংলাদেশের মান ১১। অর্থাৎ ব্যাটিংয়ের মতো বোলিংয়েও একেবারে বাজে পারফর্ম করেছে তারা। পুরো আসরে ১৯ ‍উইকেট হারানো বাংলাদেশের ব্যাটাররা রান করেছেন ৩৫৬। অর্থাৎ প্রতি ১৮.৭৩ রান তুলতে একটি করে উইকেট হারিয়ে টাইগাররা। যেখানে দলের ভিত গড়তে হবে সেখানেই নড়বড়ে বাংলাদেশ। 

ছবি- আইসিসি

বোলারদের ক্ষেত্রে সেটা আরও হতাশার। মাঝের ওভারে পুরো আসরে ১১ উইকেট নেয়া বাংলাদেশ রান দিয়েছে ৪১৯। অর্থাৎ প্রতিটি উইকেট নিতে বাংলাদেশের বোলাররা খরচ করেছে ৩৮.০৯ রান। প্রাথমিক পর্বের তিন ম্যাচ খেলা বাদ পড়া নামিবিয়া, স্কটল্যান্ড এবং আরব আমিরাতের বোলাররাও মাঝের ওভারে মুস্তাফিজুর রহমানদের চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন।

ডেথ ওভারে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স বরাবরই বাজে। ২০ ওভারের ক্রিকেটে সেখানে কখনই দাপট দেখাতে পারেনি সাকিবের দল। ডেথ ওভারে ১৩ উইকেট নিলেও ৯.৪৬ ইকনোমি রেটে রান বিলিয়েছেন। যদিও উইকেট নেয়ার ক্ষেত্রে এবং রান দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান এবং অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। ডেথ ওভারে পাকিস্তানের ১১, সাউথ আফ্রিকার ৯ এবং ভারতের ৮ এবং অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা নিয়েছেন মোটে ৪ উইকেট। তবে ম্যাচে ইমপ্যাক্ট রাখতে না পারায় বাংলাদেশের স্কোর ১০। যেখানে নেদারল্যান্ডসের বোলারদের ইমপ্যাক্ট ৫, জিম্বাবুয়ের ৯, আয়ারল্যান্ড ৭ এবং আফগানিস্তানের ৩।

এখানে তাসকিন-মুস্তাফিজের চেয়ে খারাপ করেছে কেবল শ্রীলঙ্কা এবং অস্ট্রেলিয়া। বাংলাদেশের বোলাররা যে খুব বেশি ভালো করেনি এটাই তার প্রমাণ। ব্যাটিংয়েও নিজেদের ছাপ রাখতে পারেননি নুরুল হাসান সোহান, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতরা। ডেথ ওভারে বাংলাদেশের চেয়ে বাজে ব্যাটিং করেছে কেবল শ্রীলঙ্কা ও সাউথ আফ্রিকা। যেখানে তাদের চেয়ে এগিয়ে আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস এবং জিম্বাবুয়ের মতো র‌্যাঙ্কিংয়ের নিচের সারির দল।

ডেথ ওভারে বাংলাদেশের ব্যাটাররা মাত্র ৮৫ রান তুলেছে। যেখানে তারা উইকেট হারিয়েছে ১২টি। অর্থাৎ প্রতি উইকেটে বাংলাদেশ রান তুলেছে মাত্র ৭.০৮ করে। সুপার টুয়েলভে খেলা দলের মাঝে ডেথ ওভারে বাংলাদেশের চেয়ে কম তুলেছে কেবল ইংল্যান্ড। খানিকটা বিস্ময় জাগানিয়া! তবে বাংলাদেশের চেয়ে কম বল খেলেছে জস বাটলারের দল। পুরো হিসেব-নিকেশ শেষে ৬ বিভাগের মাঝে মাত্র দুটিতে টেনেটুনে পাশ করেছে বাংলাদেশ। 

সাকিবদের আত্মতৃপ্তি আর ফলাফল আমাকে শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। প্রাইমারিতে পড়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে ৬ বিষয়ের মাঝে একটি বা দুটি ফেল করলে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করে দিতেন শিক্ষকরা। সাকিব কিংবা শ্রীরাম স্কুলের শিক্ষক হলে চার বিষয়ে ফেল করা ছাত্রদের পরের ক্লাসে উঠতে দিতেন?