নারী এশিয়া কাপ

ছোটবেলা থেকেই জয়াসুরিয়ার মতো হতে চেয়েছি: আতাপাত্তু

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 01:31 বৃহস্পতিবার, 06 অক্টোবর, 2022

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট, সিলেট থেকে ||

১৯৯৬ সালে বিশ্বকাপ জয় বদলে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ইতিহাস। সেই বিশ্বকাপ জয়ে শুধু ছেলেরাই নয় মেয়েরাও অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ক্রিকেট খেলার প্রতি। তখনকার ৬ বছরের চামারি আতাপাত্তুর ক্রিকেটে আসার পেছনের গল্পটাও সেই বিশ্বকাপ ঘিরে। এরপর নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে হয়ে শ্রীল্কার মেয়ে ক্রিকেটের কান্ডারি হয়েছেন আতাপাত্তু। শ্রীলঙ্কাকে নেতৃত্ব দেয়া আত্তাপাত্তু দেশটির নারী ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আইকনও।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজিতেও দাপট দেখাচ্ছেন অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার। ভারতের উইমেন্স টি-টোয়েন্টি চ্যালেঞ্জ খেলার পাশাপাশি খেলেছেন বিগ ব্যাশ, সিপিএলের মতো টুর্নামেন্টেও। প্রতিনিয়ত ছাপ রেখে চলেছেন নারী ক্রিকেটে। সিলেটে এশিয়া কাপ খেলতে এসে ক্রিকফ্রেঞ্জিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মমিনুল ইসলামকে শুনিয়েছেন ক্রিকেটে উঠে আসার গল্প, শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার এবং সানাৎ জয়াসুরিয়ার প্রতি তার আবেগ-অনুভূতি গল্প। যার প্রথম পর্ব থাকছে আজ।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: ক্রিকেটের শুরুটা কিভাবে?

আমি যখন ক্রিকেট খেলা শুরু করি তখন আমার বয়স মাত্র ৬ বছর। সেসময় আমরা ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। সেটা আমাদের জন্য বিশেষ কিছু ছিল। কারণ এটি আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। আমাদের প্রধান কোচ হাসান তিলকারত্নেও সেই দলের সদস্য ছিল। তার কাজ করতে পারায় আমি খুশি। ৯৬ এর বিশ্বকাপ জয় আমাদের শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ইতিহাস বদলে দিয়েছে এবং তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছে। সেই বিশ্বকাপ জয়ের কারণেই আমি আজ তারকা হয়েছি।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: কিন্তু সেসময় মেয়ে হিসেবে ক্রিকেট খেলাটা তো কঠিন ছিল...

হ্যাঁ, অনেকটা কঠিন ছিল। আমি আসলে আমার আঙ্কেলের কারণে ক্রিকেট খেলা শুরু করি। সে ক্রিকেট কোচ ছিল। সে কারণেই মূলত ক্রিকেট খেলা শুরু করি। আমি যখন শুরু করি তখন ছেলেদের সঙ্গে খেলতাম। আমি যখন স্কুল পর্যায়ে আসলাম তখন মেয়েদের সঙ্গে খেলতে শুরু করি। কারণে আমাদের স্কুলের ম্যানেজমেন্ট মেয়েদের ক্রিকেট শুরু করে। আমি তখন জাতীয় স্কুল দলে যোগ দিয়েছিলাম।

কিন্তু এটা কঠিন ছিল। কারণ তখন বেশিরভাগই ছেলেরা ক্রিকেট খেলতো। মেয়েদের সংখ্যাটা খুবই কম ছিল। আমার গ্রাম থেকে ক্রিকেট খেলা আমিই একমাত্র মেয়ে। কঠিন সময় হলেও আমি ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। আমি স্বপ্নের পেছনে ছুঁটতাম। অবশেষে আমি জাতীয় দলে এবং আমি অধিনায়কত্ব করছি। আমি খুবই খুশি।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: তখন নিশ্চয় আশেপাশের মানুষের কটু কথা শুনতে হতো...

হ্যাঁ। কারণ মানুষ ভাবতো ক্রিকেট মেয়েদের খেলা নয়। এটা শুধু ছেলেরা খেলতে পারে। কিন্তু এখন সবকিছু বদলে গেছে। কারণ শ্রীলঙ্কাতে এখন অনেক মেয়ে ক্রিকেট খেলছে। কিন্তু আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন খুবই কঠিন ছিল।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: তখন তো অনেকে কটু কথা বলতো। এখন গ্রামে গেলে মানুষ কি বলে?

এখন তো পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। আপনাকে যেটা বললাম এখন আমি বাড়ি বা গ্রামে গেলে অনেক মানুষ আমাকে দেখিয়ে নিজেদের মাঝে বলাবলি করে সে শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলছে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলছে এবং শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক। অনেক মানুষ আমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে। কারণ আমি এখন অনেক তরুণীদের অনুপ্রাণিত করছি। অনেকে অল্প মেয়ে এসে আমার কাছে জানতে চায় কিভাবে তারা ভালো ক্রিকেটার হবে। এটা সত্যিই ভালো লাগার।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার সময়কার ও এখনকার মাঝে কতটা পার্থক্য দেখছেন...

এখন আসলে মেয়েদের জন্য অনেক প্রোগ্রাম আছে। আমরা এখন অনূর্ধ্ব-১৭ ও অনূর্ধ্ব-১৯ খেলার সুযোগ পাচ্ছি। এখন স্কুল ক্রিকেট শুরু হয়েছে। অনেক স্কুল মেয়েদের ক্রিকেট চালু করেছে। যখন আমি খেলা শুরু করি আমার মনে আছে অল্প কিছু মেয়ে খেলতো। অল্প কয়েকটা স্কুলে মেয়েদের ক্রিকেট হতো। সেসময় খুব বেশি ক্লাবও ছিল না। কিন্তু এখন অনেক ক্লাবই মেয়েদের নিয়ে কাজ করছে।

আমি যখন একাডেমিতে যেতাম তখন দেখতাম ১০ জন খেলোয়াড় খেলছে, ছেলে ক্রিকেট খেলছে, অনুশীলন করছে। কিন্তু সেখানে কোন মেয়ে ছিল না। এখন এটা একেবারে ভিন্ন। এখন যদি আমি ১০ জন ছেলে দেখি, ৫ জন মেয়েও দেখতে পারবো। এটা সত্যিই দারুণ ব্যাপার। আশা করছি এসএলসি তাদের এই প্রক্রিয়া ধরে রাখবে। পরবর্তী দুবছর আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার মনে হয় অনেক মেয়ে ক্রিকেটারকে তারা বিশ্বে পরিচয় করি দিতে পারবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি নতুন ক্রিকেটারের কথা বললেন। হার্ষিতা এবং কাভিশাকে কেমন দেখছেন?

হার্ষিতা শ্রীলঙ্কার অন্যতম সেরা ইয়াং ক্রিকেটার। এই সফর (নারী এশিয়া কাপ) থেকে সে আমাদের সহ-অধিনায়ক কিন্তু সত্যিই সে দারুণ ক্রিকেটার। আমরা দেখেছি সে কতটা ভালো ক্রিকেটার। সে আজকে (থাইল্যান্ডের বিপক্ষে) এবং সবশেষ দুই ম্যাচেও ভালো করেছে। আশা করি পরের ম্যাচগুলোতেও সে তার এই পারফরম্যান্স ধরে রাখবে।

আমি কাভিশা দিলহারির কথা বলতে পারি। আমার মনে হয় সে শ্রীলঙ্কার বেস্ট ইয়াং অলরাউন্ডার। ভবিষ্যতে তারা অনেক ভালো ক্রিকেটার হবে, তাদের মাঝে আমি সেটা দেখতেও পাচ্ছি। আমি একজন মেয়েকে মিস করছি। ওর নাম বিশমী গুনারত্নে। তার মাত্র ১৬ বছর বয়স কিন্তু ইনজুরির কারণে সে এই সফরে আসতে পারেনি। তারও ভালো করার সক্ষমতা আছে। এই তিনজনই শ্রীলঙ্কার জন্য দারুণ ক্রিকেটার। আশা করছি তারা ভবিষ্যতে ভালো ক্রিকেট খেলবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: অল্প বয়সি মেয়েরা যখন দলে আসে তখন নিশ্চয় অনেক প্রশ্ন করে, অনেক কিছু জানতে চায়...

সাধারণত প্রত্যেক তরুণীই আমার মতো হতে চায়। শ্রীলঙ্কা দলের অনেকেই আমার কাছে আসে। তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কারণ সবার সঙ্গে আমি মানুষ হিসেবে খুবই বিনয়ী। শুধু তরুণদের ক্ষেত্রে নয়, সিনিয়রদের সঙ্গেও একইরকম। তাই তারা আমার কাছে এসে জানতে চায় কিভাবে ভালো ক্রিকেটার হতে পারবো।

আমরা কিভাবে এমনটা হতে পারি। আমি বলি, নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখো, নিজের যোগ্যতা অনুসারে খেলো তাহলে তুমি ভালো ক্রিকেটার হতে পারবে। তোমাকে নেটেও প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করলে ভালো ক্রিকেটার হতে পারবে। আমি তাদের অনুপ্রাণিত করবো।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আচ্ছা, এখন তো অনেকেই আপনার মতো হতে চায়। আপনি কার মতো হতে চেয়েছিলেন।

সানাৎ (জয়াসুরিয়া) আমার আইডল। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন তার (জয়াসুরিয়া) মতো হতে চেয়েছি। সে আমার সবসময়ের হিরো এবং পছন্দের। এখন শ্রীলঙ্কার অনেক তরুণী ক্রিকেটার আমার মতো হতে চায়। এটা সত্যিই ভালো লাগার।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: সানাৎ জয়াসুরিয়াকে এতো পছন্দের কোন বিশেষ কারণ?

হ্যাঁ। আমি তার আক্রমণাত্বক স্ট্রাইল পছন্দ করি। সে যদি একেবারে প্রথম বলেই বাজে বল পায় তাহলে সে ছক্কা মারবে। যে কারণে আমিও এটা সবসময় করি। সে আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। এজন্যই আমি তাকে পছন্দ করি। আমি সবসময় বলি সে আমার অলটাইম হিরো।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি বাঁহাতি অর্থোডক্স বোলারও হতে চেয়েছিলেন...

হ্যাঁ। তার জন্যই আমি বাঁহাতি হয়েছি। আপনি দেখুন আমি ডান হাতে লিখি, খাই। কিন্তু আমি বাঁ’হাতে ব্যাটিং করি। আমি কিন্তু জেনুইন বাঁহাতি না। স্বাভাবিকভাবে আমি সবকিছুই ডান হাতে করি। কিন্তু সানাৎ এর জন্য আমি বাঁহাতে খেলি।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার জন্মদিনে তো একবার তার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। কি বলেছিলেন সেদিন?

একদিন আমি নেটে ব্যাটিং করতেছিলাম। তখন পাশের নেটে সানাৎও ব্যাটিং করছিলো। তাকে দেখিয়ে আমি আমার কোচকে বলেছিলাম তার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই। আমার প্রধান কোচ তখন বলেছিল, ‘ওকে, তুমি তার সঙ্গে কথা বলতে পারো।’ আমি বলেছিলাম না। কিন্তু কোচ তখন তাকে পেয়ে বলেছিল, ‘এই ছোট মেয়েটা তোমাকে পছন্দ করে। আজকে তার জন্মদিন।’

এরপর সানাৎ বলেন, ‘শুভ জন্মদিন চামারি। আমি কি কেক পাবো?’ এরপর আমি গিয়ে এক টুকরো কেক এনে তাকে দিলাম। ধন্যবাদ দিয়ে সে আমাকে একটা ব্যাট, লেগ গার্ড এবং গ্লাভস দিয়েছিলেন। এই তিনটি এখনও আমার আলমারিতে রয়েছে। কারণ এটা আমার জন্য দারুণ একটি মুহূর্ত।