আফগানিস্তান

হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার, হয়ে গেলেন বিশ্বসেরা স্পিনার

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 20:05 শুক্রবার, 30 অক্টোবর, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

বিশ্ব ক্রিকেটই যেন লেগস্পিনারদের বন্দনায় ব্যস্ত। একজন লেগস্পিনার যেকোনো দলের জন্য অপরিহার্য অংশ হয়ে পড়েছে। সময়ের পালাবদলে বিশ্ব ক্রিকেটে দাপট দেখাচ্ছেন স্পিন জাদুকররা। বর্তমান সময়ে যে কজন লেগস্পিনার ব্যাটসম্যানদের ত্রাস হয়ে উঠেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন রশিদ খান।

সময় যত গড়িয়েছে নিজেকে ততই আরও ঝাঁঝালো রূপে হাজির করেছেন সময়ের অন্যতম সেরা এই লেগস্পিনার। নিজের স্পিন জাদুতে খাবি খাওয়াচ্ছেন বিশ্বের বাঘা বাঘা ব্যাটসম্যানদের। আচ্ছা, একবার ভাবুন তো রশিদ যদি লেগস্পিনার না হয়ে ডাক্তার হতেন, তাহলে কেমন হতো?

ডাক্তার হলে হয়তো এখন আফগানিস্তানের কোন এক অজপাড়া গ্রামে গরীব-দুস্থদের চিকিৎসা দিতেন নয়তো দেশের কোন এক বড় হাসপাতালে চাকরি করতেন। জীবনের সূচনালগ্নে চিকিৎসকের মতো এক মহান পেশায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। 

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে ১৫০ কি.মি পূর্বের একটি প্রদেশ নানগারহার। ১৯৯৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রদেশটির রাজধানী জালালাবাদে তার জন্মগ্রহণ করেছিন রশিদ খান আরমান। ১০ ভাই-বোনের সংসারে রশিদ ছিলেন ষষ্ঠ। পরিবারে কোন ডাক্তার না থাকায় পরিবারের সদস্যদের স্বপ্ন ছিল ডাক্তার বানাবেন তাকে। মায়ের ইচ্ছে মতো নিজেও হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার।

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদের এক ভিডিওতে নিজের জীবনের অজানা সব গল্প জানিয়েছেন আফগানিস্তানের এই টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক। ডাক্তার হওয়া প্রসঙ্গে রশিদ বলেন, ‘আমার কাছে পরিবারের প্রত্যাশা ছিল, আমি আরও পড়াশোনা করব এবং একজন ডাক্তার হবো। আমিও তেমনটাই চেয়েছিলাম।’

পরিবারের এমন প্রত্যাশার কারণে খেলাধুলায় সেভাবে খেলাধুলা করার সুযোগ পাননি তিনি। হঠাৎ একদিন টিভিতে খেলা দেখার সময় ক্রিকেটের প্রেমে পড়েন এই তারকা ক্রিকেটার। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটে আমার ভালবাসা শুরু হয়েছিল যখন আমি টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখতাম।’

আস্তে আস্তে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন তিনি। যদিও তাতে পরিবারের সমর্থন ছিল না। শুরুর দিকে সমর্থন না থাকলেও পরবর্তীতে সমর্থন দিতে শুরু করেন ভাইয়েরা। যে কারণে ক্রিকেট খেলার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এনে দিতেন বড় ভাইয়েরা। 

রশিদের ভাষ্যমতে, ‘কিন্তু আমার ভাইয়েরা আমাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। আমার যা যা সরঞ্জাম প্রয়োজন হতো, ব্যাট বা বল ইত্যাদি। তারা আমার জন্য সেগুলো আনতেন।’

ক্রিকেটের সুচনালগ্নে বোলিংয়ের চেয়ে ব্যাটিংয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন রশিদ। সেই সময় মিডল অর্ডারের ব্যাট করতেন তিনি। যদিও ভাইয়ের পরামর্শে পরবর্তীতে বোলিংটা মনোযোগ সহকারে শুরু করেন। পরিবারের পুরোপুরি সমর্থন না থাকায় বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে গিয়ে খেলার সুযোগ ছিল না তাঁর। যে কারণে বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলাটা কঠিন ছিল। 

এ ব্যাপারে রশিদ বলেন, ‘আমি বেশি বোলিং করিনি। আমি সত্যিই ব্যাটিং পছন্দ করি। ক্রিকেটের শুরুতে আমার অনুমতি ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খেলাটা আমার পক্ষে খুব কঠিন ছিল। তবে আমি চুরি (গোপনে) করে খেলতাম।

চুরি করে খেলতে যাওয়ার ব্যাপারে একটি ঘটনার কথা জানিয়েছেন। পরিবারের মানুষ যেন না জানে সে কারণে বাসার পিছন গেটে খেলার সরঞ্জাম রাখতেন তিনি। যা বাসা থেকে বের করার জন্য ভাতিজির সহায়তা নিতেন। ভাতিজিকে বলে রাখার পর বাসার বাইরে এসে অপেক্ষা করতেন তিনি। 

যা নিয়ে পরবর্তীতে মাঠে খেলতে যেতেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাতিজিকে বলেছিলাম সরঞ্জামগুলো পিছনের গেট থেকে আমার কাছে আনতে। কারণ আমি ওইখানে আমি অপেক্ষা করছিলাম।’

পড়াশোনায় ভালো থাকায় দশম শ্রেণিতে ওঠার পর কোচিংয়ে ক্লাস নিতে শুরু করেন। কিন্তু পুরোপুরিভাবে ক্রিকেটে আসার পর তা ছেড়ে দেন। টেনিস বলে খেলতে খেলতে একটা সময় ক্লাবে খেলার সুযোগ হয়। সেখানে ভালো খেলার ফলস্বরুপ ঘরোয়া ক্রিকেটে দল পান। 

ঘরোয়া ক্রিকেটে দল পেয়েই সরাসরি লিগে খেলার সুযোগ হয় তাঁর। এরপর আফগানিস্তান অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলার জন্য ডেকেছিল আফগানিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (এসিবি)। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে মাত্র দুটি সফরে করেছিলেন, আর সেখানে নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করেছিলেন। 

রশিদ খান বলেন, ‘আমি ক্লাব ক্রিকেটে ভাল খেলতে শুরু করেছিলাম। আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে দল পেয়েছিলাম এবং আমি সরাসরি ঘরোয়া লিগে খেলেছি। আমাকে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের জন্য ডাকা হয়েছিল। আমি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের দুটি ট্যুরে গিয়েছিলাম এবং সেখানে খুব ভাল পারফর্ম করেছিলাম।’

সেখানে ভালো করার বদৌলতে জায়গা হয় আফগানিস্তান-এ দলে। ক্যাম্পে যোগ দিলেও কোন ম্যাচ খেলতে পারেননি। তারপরের গল্পটা যেন আরও কঠিন।কোন ম্যাচ না খেলিয়েই এ দলের স্কোয়াড  থেকে বাদ দেয়া হয় তাকে। এভাবে দল থেকে বাদ পড়ায় হতাশ হয়ে পড়েন রশিদ। 

হতাশার কবলে পড়ে একটা সময় ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শুধু তিনিই নন, কোন ম্যাচ না খেলিয়ে বাদ দেয়ায় তার ভাই রেগে গিয়ে বলেছিলেন, খেলা বাদ দিয়ে পড়াশোনা করতে। যদিও পরবর্তীতে মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, মায়ের অনুপ্রেরণায় আবারও ক্রিকেটে ফেরেন তিনি। 

ক্রিকেটে ফিরেই ঘরোয়া ক্রিকেটে দাপট দেখান। একটি ঘরোয়া টুর্নামেন্টে মাত্র ৩ ম্যাচ খেলে ২১ উইকেট নিয়েছিলেন। তারপরই ২০১৫ সালে জাতীয় দলের হয়ে ডাক পান রশিদ।  

তিনি বলেন, ‘আমাকে আফগানিস্তান-এ দলের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, আমি ক্যাম্পে যোগ দিয়েছি কিন্তু কোনও ম্যাচ খেলার সুযোগ পাইনি। তারপর আমাকে স্কোয়াড থেকে বাদ দিয়েছিল। আমিও ক্রিকেট ছাড়তে চেয়েছিলাম। আমার ভাই সত্যিই রেগে গিয়েছিলেন এবং তিনি আমাকে বলেছিলেন, ক্রিকেট ছেড়ে তোমার পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা উচিত।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমি তখন আমার মাকে কল করেছিলাম, তিনি আমাকে বলেন, তুমি যাও এবং তোমার খেলাটি উপভোগ করো। ফলাফল যাই হোক না কেন, যদি কাল ফলাফল নাও পাও তবে তুমি কোন একদিন পাবে।  তারপরে একটি ঘরোয়া প্রতিযোগিতা খেলেছিলাম, আর সেখানে আমি তিন ম্যাচে ২১ উইকেট পাই। আমি যখন সেখানে পারফর্ম করি, তারপর ২০১৫ সালে আমি জাতীয় দলের হয়ে সুযোগ পাই।’

২০১৫ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়। তবে সবার নজরে আসেন ২০১৬ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে। মাত্র ৩ রান দিয়েই তুলে নিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ উইকেট।

ভারতে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তার পারফর্মেন্স ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৭ এর জুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে ১৮ রান দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। যা কি-না তাঁর ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি রশিদকে।