সাক্ষাৎকার

স্ট্রাইক রেট মধ্য-আশি ছাড়াতে চাইঃ তামিম

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 01:09 রবিবার, 26 আগস্ট, 2018

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

বাংলাদেশ দলের ওপেনার তামিম ইকবাল সফল উইন্ডিজ সফর শেষে দেশে ফিরেই এশিয়া কাপের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। উইন্ডিজ সফরে টেস্ট সিরিজে লজ্জার হারের পর ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি সিরিজ জয় করেছিল বাংলাদেশ। সীমিত ওভারের ক্রিকেট বাংলাদেশের সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারিগর ছিলেন তামিম ইকবাল। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দুইটি সেঞ্চুরি ও এক ফিফটিতে ম্যাচ অব দ্য সিরিজের পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। এরপর গুরুত্বপূর্ণ শেষ টি-টুয়েন্টিতে ম্যাচ জয়ী ফিফটি হাঁকিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের সিরিজে হারাতে বড় ভূমিকা রাখেন তামিম। আর এই স্বপ্নিল ফর্ম এশিয়া কাপেও ধরে রাখতে চান তিনি। তাই তো ২৭ তারিখ থেকে শুরু হতে যাওয়া এশিয়া কাপের ক্যাম্প শুরু হওয়ার আগেই অনুশীলনে ঘাম ঝরাচ্ছেন এই অভিজ্ঞ ওপেনার।  

সম্প্রতি এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে নিজের ব্যাটিং এর খুঁটিনাটি পরিবর্তন, ওপেনিং সঙ্গী, আসন্ন এশিয়া কাপ ও বিশ্ব ক্রিকেটের আরও অনেক ইস্যুতে বিস্তারিত কথা বলছেন তামিম ইকবাল। 

উইন্ডিজ সফরের আগেও রোজার ঈদের ছুটি বাদ দিয়ে অনুশীলন করেছিলেন, এই ঈদেও করছেন। এই অতিরিক্ত অনুশীলনের কারণ কী এবং অনুশীলন থেকে কি অর্জন করতে চাইছেন?

তামিম - আপনি কখনই সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না। এটা আমি সবসময় বিশ্বাস করি। কিন্তু আমি নিজেকে শতভাগ প্রস্তুত করতে পারি, এতে আমার কাজটা সহজ হয়ে যায়। আমি যদি চেষ্টা করেও ব্যর্থও হই, তাহলে নিজেকে বলতে পারব, 'আমি শতভাগ দিয়েছি, কিন্তু সেটা কাজে আসে নি। ভালো খেলার জন্য প্রস্তুতিটা আসল, এই জন্যই একটু অতিরিক্ত চেষ্টা করা। আমি মনে করি যখন ভালো সময় যায়, তখনই বেশি চেষ্টা করা উচিত। কারন বাজে সময়ে নিজেকে অনুপ্রাণিত করা কঠিন। এই জন্যই একটু অতিরিক্ত কাজ করা। 

আর অনুশীলনটা অনেকটা প্রয়োজন বুঝে (ফুল লেন্থ বলে ফ্রন্ট ফুটে খেলা) করা হয়। একেক সেশনে একেক বিষয় নিয়ে কাজ করি আমরা। উইন্ডিজ সফরের আগে শর্ট বলের বিপক্ষে ব্যাটিং নিয়ে অনুশীলন করেছি। এখন ভিন্ন কিছুটা মনোযোগ দিচ্ছি। উইকেট ও প্রতিপক্ষ কি পরিকল্পনা করবে আমাকে নিয়ে, সেটা আমাদের বিবেচনায় থাকে। 

বিশ্বের বেশীরভাগ ওপেনারের স্ট্রাইক রেট দেখা যায় একশ ছুঁই ছুঁই, আপনার স্ট্রাইক রেট ৮০। আধুনিক ক্রিকেটের উইকেট বিবেচনায় এই স্ট্রাইক রেট কতোটা গ্রহণযোগ্য?

তামিম - আমরা বেশীরভাগ ম্যাচ খেলি মিরপুরে, আমাদের ঘরের মাঠে। এখানে দ্রুত রান তোলা একটু কঠিন। এটাই একমাত্র মাঠ যেখানে আপনি এখনো ২৬০-২৭০ রান করেও জয় পাবেন। এমন স্কোর আবার বিশ্বের অন্য কোথাও যথেষ্ট নয়।

আর দলে আমার একটা নির্দিষ্ট দায়িত্ব আছে, এটা আরেকটা ব্যাপার। আমাকে ইনিংস গড়ে দেয়ার কাজটা করতে হয়। আমি ঝুঁকিহীন ব্যাটিং এর সাথে স্ট্রাইক রেট বাড়ন্ত রাখার চেষ্টা করতে হয়। আমি এইসব নিয়ে কাজ করছি। এক রাতেই এর সমাধান হবে না। আমি যদি সফল হই তাহলে দলই উপকৃত হবে। স্ট্রাইক রেট যদি ৮৬-৮৭ এর ঘরে নিতে পারি, তাহলে খুবই ভালো হবে। 

বিশ্বের অনেক ব্যাটসম্যান আছে, যেমন ভিরাট কোহলি, তাদের স্ট্রাইক রেট ৯০ এর আশাপাশে, যা এক কথায় অসাধারণ। আমার স্ট্রাইক রেট ৮০ থেকে ৮৫ তে নিতে হলে আমাকে কিছু জায়গায় কাজ করতে হবে। তবে আমি এখন দলের জন্য যা করছি, সেটা বিসর্জন দিয়ে নয়। আমি ব্যাটসম্যান হিসেবে তো ১০-১৫% উন্নতি করতে পারি, তাহলে এইসব বিষয় এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি যেভাবে ব্যাট করে এসেছি, সেই হিসেবে আমার এখনকার ব্যাটিং অনেকটাই ভিন্ন। অভিজ্ঞতার সাথে সাথে আমি অনেক কিছুই মানিয়ে নিয়েছি। আমাকে দলের চাহিদা বুঝতে হবে। 

সময়ের সাথে সাথে আমার দায়িত্ব বদলেছে। আমি ওয়ানডে ও টেস্টে ইনিংসের শুরুতে নিজেকে ২০ বল দিতে চাই (টি-টুয়েন্টি ছাড়া)। আমি ২০-৩০ বল খেলে ফেললে আমার রান করার হার বেড়ে যায়। ইনিংসের শুরুতে আমার আউট হওয়ার হার বেশি। এইসব পরিবর্তন আমার ব্যাটিং এ আনার চেষ্টা করেছি, গত তিন-চার বছরে। আমি নিজেকে ২০ বল দেই, তারপর দেখি কি হয়।

বিশ্বকাপ খুব কাছেই, এখনো ওপেনার হিসেবে কাউকে খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ। দ্রুত সমাধানের উপায় কী?

তামিম - জুটি বেঁধে খেলার ক্ষেত্রে হয় কি, একজন ধরে খেললেও আরেকজন দ্রুত রান তোলার চেষ্টা করে। এখন কোন তরুন ব্যাটসম্যান যদি আমার সাথে ওপেন করে, তাহলে তাকে দ্রুত তোলার দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়াও যৌক্তিক না। কারণ নতুন ক্রিকেটার হিসেবে সে চাইবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জায়গা পাকা করতে। কিন্তু আপনার যদি এমন কেউ থাকে, যে কিনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্থায়ী এবং নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে ধারনা রাখে, তাকে এই দায়িত্ব দেয়া যায়। ওপেনিং পার্টনারশিপ যদি এমন হয়, তাহলে দলের জন্য সুবিধা। আমি আলাদা করে কারো নাম নিতে চাই না, তবে আমি গত কয়েক বছরে সৌম্য সরকারের সাথে অনেক ব্যাটিং করেছি। সে আমার উপর থেকে চাপ সরানোর ক্ষেত্রে অনেক সাহায্য করত।

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ থেকে এমন যোগ্য ব্যাটসম্যান বের হয়ে আসছে না কেন?

তামিম - বিপিএলে বেশির ভাগ বিদেশি ক্রিকেটার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। এক থেকে চার পর্যন্ত ব্যাটিং পজিশন তারাই দখল করে রাখে। এটা আমাদের কাজ একটু কঠিন হয়ে যায়। তরুন ব্যাটসম্যানরা যদি বিদেশি ফাস্ট বোলারের বিপক্ষে রান করতে পারে, তাহলে সেটা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় দলের হয়ে সেই একই বোলারকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলতে গেলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। কারন আপনি জানেন, বিপিএলে সেই একই বোলারের বিপক্ষে চার-ছক্কায় রান করেছেন... যা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। আইপিএলের মধ্য দিয়ে ভারতীয়রা এই কাজটাই করছে দারুনভাবে। তাদের ব্যাটসম্যানরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পরীক্ষিত বোলারের বিপক্ষে রান করছে, যা পরবর্তীতে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

এশিয়া কাপে বাংলাদেশের সুযোগ কেমন থাকবে?

তামিম - এশিয়া কাপে কি হয় কিছু নিশ্চিত করে বলা যায় যায়। দ্বিতীয় রাউন্ডে যেতে হলে দুটি ম্যাচ খেলতে হবে। একটি ম্যাচ হারলে ও এক ম্যাচে জয় পেলে কি হবে কে জানে। আমার চোখ প্রথম দুই ম্যাচে, আমরা সুপার ফোরে জায়গা করে নেয়ার জন্য যোগ্য দল। সুপার ফোরে আমাদের সেরা খেলা খেলতে হবে, সেখানে সব ভালো দল থাকবে। 

আমাদের অবশ্যই ভালো সুযোগ থাকবে। আমরা শেষ তিন এশিয়া কাপে ভালো খেলেছি, দুইবার ফাইনাল খেলেছি। সম্প্রতি উইন্ডিজ সিরিজেও ভালো করেছি আমরা। এছাড়া ওয়ানডে ফরম্যাটে আমরা ভালো দল, এই ফরম্যাটে আমরা সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। নির্ভর করবে আমরা ম্যাচের সময় কি কি পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। আমরা যদি বেশীরভাগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে আমাদের ভালো সুযোগ থাকবে। 

রিস্ট স্পিনার সামলানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে কেন? রাশিদ খান এশিয়া কাপে বড় হুমকি হবে...

তামিম - আপনি যদি অনুশীলন না করেন, আপনি যদি না জানেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই কাজটা কঠিন হবে। আমাদের সব বোলার যদি ১২৫ কিমিঃ গতিতে বল করে, আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিয়ে ১৪৫ কিমিঃ গতির বল সামলাতে হয়...যেমনটা ছিল দশ বছর আগে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনি মানিয়ে নিতে পারবেন না। এখন আমাদের দুই-তিনজন বোলার আছে যারা ১৩৫ থেকে ১৪০ কিমিঃ এ বল করে, যা আমাদের মানিয়ে নিতে সাহায্য করে, কারণ এখন তেমন কোন পার্থক্য নেই। 

রিস্ট স্পিনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলব। আমাদের দেশে যথেষ্ট লেগ স্পিনার নেই। ফলে আমাদের লেগ স্পিনার খেলার অভিজ্ঞতাও কম। 

টি-টুয়েন্টি থেকে ওয়ানডে ভিন্ন, যদিও রাশিদের বোলিং পরিবর্তন হবে না। তাকে সামলানো কঠিন হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ওয়ানডেতে তাকে দেখে খেলার সময় পাবেনা আপনি। একজন বোলারকে দেখে খেলতে পারবেন আপনি। একই সাথে নির্দিষ্ট কোন বোলারকে দেখে খেলা বা একেবারে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে খেলার পরিকল্পনা করলে ভুল হবে। সে ভালো বোলার এর মানে এই নয় যে সে বাজে বল করে না। বিশ্বের সব ভালো বোলার ভুল করে থাকে। সুতরাং আমাদের বাজে বলের অপেক্ষা করতে হবে, ফায়দা নিতে হবে, বাউন্ডারি নয়তো সিঙ্গেল নিতে হবে। একদম ধরে খেলা বা সব বলে আগ্রাসী মেজাজে খেলা আদর্শ পরিকল্পনা নয়। 

টি-টুয়েন্টির সমস্যা সমাধানে কতটুকু এগিয়েছে বাংলাদেশ?

তামিম - এই ফরম্যাটে আমাদের সামর্থ্য নিয়ে সবসময় প্রশ্ন ছিল। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন উইন্ডিজদের হারিয়ে আমরা সেখান থেকে এক ধাপ এগিয়েছি। এর মানে এই নয় যে আমরা ভালো দলে পরিনত হয়ে গেছি। তবে উইন্ডিজদের সাথে ভালো করার ফলে আমরা সেই প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকে একটু হলেও অগ্রসর হয়েছি। এখন আমরা জানি আমাদের ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেলের মত গেইম চেইঞ্জারের প্রয়োজন নেই। আমরা স্মার্ট ক্রিকেট খেলে টি-টুয়েন্টি সিরিজ জিততে পারি।

চার-ছক্কা মারাই টি-টুয়েন্টি নয়। প্রান্ত বদল করার মাঝে বাউন্ডারির মিশেলে আপনি টি-টুয়েন্টি জিততে পারবেন। আমি সম্প্রতি বলেছি, আমরা বাংলাদেশ ব্র্যান্ডের টি-টুয়েন্টি খেলার চেষ্টা করছি, যা আমাদের জন্য মানানসই। ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ কি করছে তার দিকে চোখ না দিলেও চলবে।