ক্রিকেট লিজেন্ডস

গর্ডন গ্রিনিজঃ ব্যাটিং আগ্রাসনের পূজারি

Online Desk

Online Desk
প্রকাশের তারিখ: 14:50 মঙ্গলবার, 17 জুলাই, 2018

ক্যারিবীয় ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে চলে আসে গর্ডন গ্রিনিজের নাম। তাঁকে মনে করা হয় ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ও বিধ্বংসী ওপেনারদের একজন। ডেসমন্ড হেইন্সকে সঙ্গে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন কালজয়ী এক উদ্বোধনী জুটি; যার কীর্তিগাথা আজও ক্রিকেটীয় রূপকথার অংশ হয়ে আছে।

ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ওপেনিং জুটির তালিকা করলে গর্ডন গ্রিনিজ-ডেসমন্ড হেইন্স জুটির স্থানটা ওপরের দিকেই থাকবে। ৮৯ টেস্টের ১৪৮ ইনিংসে উদ্বোধন করতে নেমে দুজনে মিলে সংগ্রহ করেছেন ৬৪৮২ রান যা টেস্ট ক্রিকেটে যেকোন ওপেনিং জুটিতে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড। এই জুটির ১৬টি শতরানের পার্টনারশিপের মধ্যে ৪টি ছিল দুই শতাধিক রানের। 

১৯৯০ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এন্টিগা টেস্টে সর্বোচ্চ ২৯৮ রানের জুটি গড়েছিলেন দুজন। গর্ডন গ্রিনিজের ধ্রুপদী ব্যাটিং টেকনিক এবং ফ্ল্যামবয়েন্ট স্ট্রোকপ্লে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর ব্যাটসম্যানশিপকে সংজ্ঞায়িত করা হয় এভাবে “ইংরেজ রক্ষণের সাথে ক্যারিবীয় আগ্রাসনের এক অদ্ভুত যুগলবন্দী”। 

১৯৫১ সালের ১লা মে, বার্বাডোজের সেন্ট পিটার নামক এলাকায় জন্মেছিলেন গ্রিনিজ। ক্রিকেটের হাতেখড়িটাও সেখানেই। তবে জীবিকার তাগিদে মাত্র ১৪ বছর বয়সে বারবাডোজ ছেড়ে মায়ের সাথে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডের রীডিং শহরে। ভর্তি হন বার্কশায়ার হাইস্কুলে। রক্ষণ সামলানোর যাবতীয় কলাকৌশল নাকি আয়ত্ত করেছিলেন সেখানেই। 

যার কারণে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তাঁর ছিল জমাট এবং নিশ্ছিদ্র রক্ষণ। তাছাড়া টিপিক্যাল ক্যারিবিয়ানদের মত গ্রিনিজ বরাবরই ছিলেন আগ্রাসনের পূজারি; আক্রমণই ছিল যার ব্যাটিংয়ের শেষ কথা। মারার বল পেলে একচুল পরিমাণও ছাড় দিতেন না তিনি। গ্রিনিজকে তাঁর সময়ের সবচেয়ে নিখুঁত ও ক্লিন হিটারদের একজন বলেও রায় দিয়েছেন অনেকে।

উইজডেনের চোখে, “He was a superb technician, who learned solid defensive techniques on the pudding pitches of his childhood in England and then allied them to an uninhibited Caribbean heritage.” 

পেস বোলিংয়ের বিপক্ষে গ্রিনিজ ছিলেন বরাবরই দারুণ সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী। শুরু থেকেই বোলারদের ওপর ডমিনেট করতে চাইতেন তিনি। টেকনিক্যালি সাউন্ড হওয়ার সুবাদে নতুন বলে সুইং সামলানোয় তাঁর ছিল অসাধারণ দক্ষতা। বলের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে যতটা সম্ভব সোজা ব্যাটে খেলতেন তিনি। নতুন বলে পেসারদের বিপক্ষে গ্রিনিজের খেলা স্ট্রেট ড্রাইভগুলো তাঁর স্কিল, টেকনিক ও সামর্থ্যের কথাই জানান দেয়।

ফাস্ট বোলারদের দ্রুতগতির বাউন্সারে মোটেও ভয় পেতেন না গ্রিনিজ। হুক ও পুল খেলার জন্য সবসময় প্রস্তুত রাখতেন নিজেকে। বারবাডোজের দ্রুতগতির বাউন্সি উইকেটে ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষে খেলে তিনি শিখেছেন কীভাবে বাউন্সার সামলাতে হয়। সামনের পা তুলে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে মোহনীয় ভঙ্গিমায় হুক আর পুলের মাঝামাঝি যে শটটি খেলতেন গ্রিনিজ, সেটা ছিল দেখার মত। 

গ্রিনিজের ট্রেডমার্ক শট ছিল ক্যালিপ্সো স্টাইলের 'ওয়ান লেগড পুল'। আর ছিল পাওয়ারফুল স্কয়ার কাট। পয়েন্ট ও গালির মাঝখান দিয়ে 'স্কয়ার কাট' খেলার রীতিমতো মাস্টার ছিলেন গ্রিনিজ। আর সেগুলোতে টাইমিং হত দুর্দান্ত; প্লেসমেন্ট ছিল নিখুঁত। তাঁর মত অমন ক্ষিপ্রতা সম্পন্ন স্কয়ার কাট ক্রিকেট ইতিহাসে খুব ব্যাটসম্যানই খেলতে পেরেছেন। তাছাড়া উইকেটের দুপাশেই চমৎকার ড্রাইভ খেলতেন গ্রিনিজ। স্কয়ার ড্রাইভ, কভার ড্রাইভ, স্ট্রেইট ড্রাইভ যাই খেলুন না কেন; তাঁর ড্রাইভগুলো হত বেশ পাওয়ারফুল। গ্রিনিজের 'ব্যাকফুট পাঞ্চ' আর 'অফ দ্য প্যাড' ফ্লিকও কম দর্শনীয় ছিল না।

গ্রিনিজ সবসময় বলতেন, "Strokeplay should be purposeful. If you're going to hit the ball, hit it.”

ষাটের দশকের কিংবদন্তী ওপেনার রয় ফ্রেডেরিকসকে আদর্শ মানতেন গ্রিনিজ। রয় সম্পর্কে গ্রিনিজের বক্তব্য ছিল, "Roy was a dashing player, would almost play a stroke at every ball he faced. He was very courageous. It didn't matter who was bowling, how quick, he would challenge them."

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে গ্রিনিজের অভিষেক ১৯৭০ সালে কাউন্টি দল হ্যাম্পশায়ারের হয়ে। একজন পরিপূর্ণ ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার শুরুটা হয়েছিল তখনই। সাসেক্সের বিপক্ষে কাউন্টি অভিষেকে তেমন বড় কোন ইনিংস খেলেন নি। তবুও তাঁর ছোট্ট কিন্তু সাহসী ইনিংসটা সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। ইংল্যান্ডের দুর্ধর্ষ ফাস্ট বোলার জন স্নো'র বাউন্সারে হুক করে বল আছড়ে ফেলেছিলেন গ্যালারির বাইরে। পাশের বাগান থেকে বলটা খুঁজে পেতে নাকি সময় লেগেছিল পাক্কা ৫ মিনিট! ১৯ বছরের প্রাণোচ্ছল তরুণ গ্রিনিজের ডেব্যু ইনিংসের ব্যাটিং সম্পর্কে উইজডেনের বক্তব্য ছিল, “one of the most promising innings on debut.”

হ্যাম্পশায়ারে থাকাকালীন উদ্বোধনী জুটিতে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বয়সে ৬ বছরের বড় প্রোটিয়া কিংবদন্তি ব্যারি রিচার্ডসকে। অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ কেমিস্ট্রি জমে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। রিচার্ডস-গ্রিনিজ জুটিকে কাউন্টির ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ওপেনিং জুটি মনে করেন অনেকে।

১৯৭৩ সালের কথা। কাউন্টিতে ফর্মের তুঙ্গে থাকা গ্রিনিজকে দলে নিতে ইংল্যান্ড তখন মরিয়া। এদিকে তাঁর আজীবনের লালিত স্বপ্ন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট খেলবেন। তাঁর সামনে তখন দুটি রাস্তা খোলা। ইংলিশদের হয়ে টেস্ট ক্যারিয়ার গড়বেন নাকি ফিরে যাবেন জন্মভূমিতে, প্রতিনিধিত্ব করবেন ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের। শেষমেশ দ্বিতীয় রাস্তাটিকেই বেছে নিলেন তিনি। ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডের লোভনীয় প্রস্তাবকে উপেক্ষা করে ১৯৭৩ সালে তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমি বারবাডোজে। 

বারাডোজের ঘরোয়া লিগ 'শেল ট্রফি'তে দুই মৌসুম খেলে নিজেকে ক্যারিবিয়ান কালচারের সাথে মানিয়ে নিতে থাকেন গ্রিনিজ। সেখানকার ধারাবাহিক ও নজরকাড়া পারফরমেন্স দিয়ে অবশেষে সুযোগ পেয়ে যান ভারত সফরের টেস্ট দলে।

মজার ব্যাপার হল, ওই একই সফরে ডাক পেয়েছিলেন স্যার ভিভ রিচার্ডসও। ১৯৭৪ সালে বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে স্বাগতিক ভারতের বিপক্ষে একই ম্যাচে গ্রিনিজের সাথে টেস্ট ক্যাপ মাথায় তুলেছিলেন ভিভও। ডেব্যু টেস্টে ভিভ ব্যর্থ হলেও (দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৪ ও ৩ রান) অভিষেক লগ্নটাকে স্মরণীয় করে রাখতে মোটেও ভুল করেন নি গ্রিনিজ। প্রথম ইনিংসে ৯৩ রানে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে হাঁকিয়েছিলেন অনবদ্য এক সেঞ্চুরি (১০৩)।

১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল গ্রিনিজের ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এই ৮ বছরে খেলা ৫৪ টেস্টে তাঁর অর্জন ১০ সেঞ্চুরি আর ২৩ ফিফটিতে ৪১৪০ রান। ব্যাটিং গড় ৫৩.৭! যথারীতি ১৯৭৭ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কারও জিতেছিলেন গ্রিনিজ।

'৭৬ সালে ইংল্যান্ডকে তাঁদেরই ঘরের মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারানোয় বড় অবদান ছিল গ্রিনিজের। পাঁচ টেস্টে ৩ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিসহ ৬৫.৭৭ গড়ে গ্রিনিজের সংগ্রহ ছিল ৫৯২ রান।

ইংল্যান্ড সিরিজ থেকে পাওয়া দুর্দান্ত ফর্মটা গ্রিনিজ ধরে রেখেছিলেন ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজেও। ৫ টেস্টে ৫৩.৬০ গড়ে করেছিলেন ৫৩৬ রান। ১ সেঞ্চুরির সাথে হাঁকিয়েছিলেন ৪ হাফ সেঞ্চুরি। ক্যারিবিয়ানরা সিরিজ জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে।

১৯৮৩-৮৪ সালের বিখ্যাত 'রিভেঞ্জ' সিরিজে ভারতকে টেস্টে ৩-০ এবং ওয়ানডেতে ৫-০ ব্যবধানে হারায় ক্যারিবীয়রা। ৬ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে গ্রিনিজের সংগ্রহ ছিল ৫৭.৩৭ গড়ে ৪১১ রান। কানপুরের 'র‍্যাংক টার্নারে' গ্রিনিজ খেলেছিলেন ১৯৪ রানের অনবদ্য 'ম্যাচ উইনিং' এক ইনিংস।

১৯৮৪ সালের জুনে স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক সিরিজে দুটি ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান গ্রিনিজ। লর্ডসে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ২৯ চার ও ২ ছক্কায় ২৪২ বলে ২১৪ রানের 'মহাকাব্যিক' এক ইনিংস খেলেন তিনি। তাঁর অনবদ্য এই ইনিংসের সুবাদেই শেষদিনে মাত্র ৬৬.১ ওভারে ৩৪২ রানের চ্যালেঞ্জিং টার্গেট তাড়া করে জিতেছিল ক্যারিবিয়ানরা। উল্লেখ্য, লর্ডসের ইতিহাসেও ওটাই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়লাভের রেকর্ড।

গ্রিনিজের একটি 'পাওয়ারফুল' স্ট্রেট ড্রাইভ দেখে ধারাভাষ্যকার রিচি বেনো মন্তব্য করেছিলেন, “Every little bit of power you could imagine going into that (straight drive)”.

উইজডেন সাময়িকীর রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “Throughout the innings, balls had continued to be hit with immense power and immaculate placement that characterised the batsman.”

ওল্ড ট্রাফোর্ডে সিরিজের ৪র্থ টেস্টেও ২২৩ রানের দারুণ একটি ইনিংস খেলেন তিনি। ক্যারিবিয়ানরা সেবার সিরিজ জিতেছিল ৫-০ ব্যবধানে। পরবর্তীকালে সিরিজটি 'ব্ল্যাকওয়াশ' নামে পরিচিতি লাভ করে।

টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষদিকে এসেও নিয়মিত রান পেয়েছেন গ্রিনিজ। ১৯৯১ সালে গায়ানার ব্রিজটাউনে তাঁর বিদায়ী টেস্টের আগের টেস্টে, বারবাডোজে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলেছিলেন ক্যারিয়ার সেরা ২২৬ রানের অসাধারণ ইনিংস। তাঁর ওই ইনিংসের সৌজন্যেই অ্যালান বোর্ডারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে ৩৪৩ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ডেভিড বুন, মার্ভ হিউজ, ডিন জোন্স, ক্রেইগ ম্যাকডারমট, ওয়াহ ব্রাদার্সদের নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়া রীতিমতো খড়কুটোর মত উড়ে গিয়েছিল সে ম্যাচে।

গ্রিনিজের ২২৬ রানের মাস্টারক্লাস সম্পর্কে ক্রীড়ালেখক ড্যানিয়েল হ্যারিস বলেছিলেন, “Gordon Greenidge’s 226 at Barbados, his highest Test score, in his penultimate Test match, to clinch a series; was the last flickering of greatness from a master batsman.”

প্রায় ১৭ বছরের ক্যারিয়ারে গ্রিনিজ খেলেছেন ১০৮ টি টেস্ট ও ১২৮টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

১০৮ টেস্টে ৪৪.৭২ গড়ে গ্রিনিজের সংগ্রহ ৭৫৫৮ রান। ৩৪টি ফিফটির পাশে সেঞ্চুরি ১৯টি, যার ৪টিই ছিল ডাবল সেঞ্চুরি। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২২৬ রান। 

উল্লেখ্য, টেস্ট ক্যারিয়ারে মোট ৬৭টি ছক্কা হাঁকিয়েছেন গ্রিনিজ! তিনি ঠিক কোন পর্যায়ের হার্ডহিটার ছিলেন সেটা বুঝতে কারোর বাকি থাকার কথা নয়।

গর্ডন গ্রিনিজ তাঁর টেস্টের সাফল্যটাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও। সাদা পোশাকের মতো রঙিন পোশাকের ক্রিকেটেও খেলেছেন দাপটের সাথে। পরিসংখ্যানও তাঁর হয়েই কথা বলছে।

‘৭৫ আর ‘৭৯ বিশ্বকাপ জয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অপরিহার্য সদস্য গ্রিনিজ ১২৮ ওয়ানডেতে ৪৫.০৩ গড়ে রান করেছেন ৫১৩৪। ১১ টি সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি আছে ৩১টি। সর্বোচ্চ ইনিংস অপরাজিত ১৩৩ রানের।

ক্যারিবিয়ানদের হয়ে '৭৫ থেকে '৮৩ পর্যন্ত মোট ৩টি বিশ্বকাপ খেলেছেন গ্রিনিজ। বিশ্বকাপের ১৫ ম্যাচে গ্রিনিজের সংগ্রহ ৪৫.৫৬ গড়ে ৫৯১ রান। ৪টি ফিফটির সাথে আছে ২টি সেঞ্চুরিও। প্রথমটা ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের অভিষেক সেঞ্চুরি; ১৯৭৫ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে এজবাস্টনে। আর দ্বিতীয় শতরানটি এসেছিল ১৯৮৩ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্যারিয়ারের শততম ম্যাচে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্বটি গর্ডন গ্রিনিজের। ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপরাজিত ১০২ রানের ইনিংস খেলার পথে এই কীর্তি গড়েন তিনি।

গর্ডন গ্রিনিজ ছিলেন একজন সত্যিকারের ম্যাচ উইনার। টেস্টে ৬ বার আর সীমিত ওভারের ম্যাচে ১৮ বার জিতেছেন ম্যাচসেরার পুরস্কার। 

গ্রিনিজের ১১ ওয়ানডে সেঞ্চুরির ৯টিতেই জিতেছে তাঁর দল। আর টেস্টে? গ্রিনিজ সেঞ্চুরি করেছেন এমন একটি টেস্টও হারে নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ! অর্থাৎ তাঁর ১৯টি টেস্ট সেঞ্চুরির সবকটিতেই অপরাজিত ছিল ক্যারিবিয়ানরা! 

১৯৯১ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া গ্রিনিজ পরবর্তীতে সফলতা পেয়েছেন কোচ হিসেবেও। টাইগারদের ঐতিহাসিক '৯৭ আইসিসি ট্রফি জয় এবং '৯৯ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফরমেন্সের নেপথ্য নায়কও ছিলেন এই বার্বাডিয়ান ভদ্রলোক।
১৯৯৬ সালে গর্ডন গ্রিনিজের মতো একজন বিখ্যাত ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব যখন বাংলাদেশের কোচ হয়ে এলেন, তখন পুরো জাতি বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নে বিভোর। কেনিয়াতে অনুষ্ঠিত '৯৪ আইসিসি ট্রফির ব্যর্থতা যখন আমাদের '৯৬ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্নকে ভুলণ্ঠিত করেছিল, তখন এদেশের ক্রিকেটকে সাফল্যের মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে সুদূর বার্বাডোজ থেকে এসেছিলেন ক্যারিবীয় ক্রিকেটের স্বর্ণযুগের কাণ্ডারি গর্ডন গ্রিনিজ।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ার এসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। এসিসি ট্রফির সাফল্যের পরপরই বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড আটঘাট বেঁধে নামে জাতীয় দলকে বিশ্বকাপে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্যকে সফল করতে অসাধারণ এক পদক্ষেপ ছিল ক্যারিবীয় গ্রেট গ্রিনিজকে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। তৎকালীন বোর্ড সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই কেবল সম্ভব হয়েছিল সেটা। গ্রিনিজের জন্যও সেটি ছিল প্রথম কোন জাতীয় দলের হয়ে দায়িত্ব নেওয়া। তাঁর আসাটা এদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে দারুণ উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে গ্রিনিজের ব্যাটিং দেখার সুখস্মৃতি তখনকার প্রজন্মের অনেকের মনেই ছিল টাটকা।

মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত '৯৭ আইসিসি ট্রফির পুরোটা সময় জুড়ে গ্রিনিজ ছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে। সেমিফাইনালে ওঠার পথে গ্রুপ পর্বের সবচেয়ে কঠিন ম্যাচটা ছিল হল্যান্ডের বিপক্ষে; পেন্ডুলামের মতো দুলছিল সে ম্যাচের গতি-প্রকৃতি। হল্যান্ডের মামুলি টার্গেট তাড়া করতে নেমে মাত্র ১৫ রানেই প্রথম ৪ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকছিল বাংলাদেশ। পরবর্তীতে বৃষ্টির আনাগোনা, ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়ে বাদ পড়ার আশঙ্কা, মিলিয়ে ভয়ংকর স্নায়ুক্ষয়ী এক ম্যাচ ছিল সেটি। এই ম্যাচ হারলে যে বিশ্বকাপ স্বপ্নটাও ধূলিসাৎ হয়ে যেত! অধিনায়ক আকরাম খানের অনবদ্য ৬৮ রানের ইনিংসের সৌজন্যে হল্যান্ড বাধা পেরিয়ে সেমিফাইনালে উঠে বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূরণের পথে অনেক দূর এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। 

হল্যান্ডের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর সেই জয়ের ওপর ক্রিকইনফোর ম্যাচ রিপোর্টে বলা হয়েছিল-

“Gordon Greenidge crying. Just imagine a win that makes Greenidge cry; a man who had come from a different country, a different culture. The owner of one of the fiercest square-cuts ever seen, the man with the double-century on one leg, the man whose image first comes to mind when the words “beware the wounded batsman" are said; Greenidge cried after that win. That's how much it meant to the team.”

সেমিতে স্কটল্যান্ডকে সহজেই হারিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণ হয় বাংলাদেশের অগণিত ক্রিকেটভক্তের। ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে আরও এক ইতিহাস গড়ে বাংলাদেশ। আরও একটি বৃষ্টিবিঘ্নিত উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে কেনিয়াকে ২ উইকেটে হারিয়ে বাংলাদেশ ঘরে তোলে স্বপ্নের আইসিসি ট্রফির শিরোপা। সেই জয়ও আসে শেষ বলের নাটকীয়তায়!

একের পর এক স্নায়ুক্ষয়ী সেই মুহূর্তগুলো বাংলাদেশ সফলভাবে উতরাতে সমর্থ হয়েছিল কেবল গ্রিনিজের দূরদর্শিতা আর অভিজ্ঞতার গুণেই। বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে অভিভাবক হিসেবে তাঁর মতো একজন ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি দলের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিল। চাপের মুহূর্তে মাঠের বাইরে থেকে যেভাবে তিনি খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিতেন, মনে সাহস জোগাতেন তা আজও অনেক ক্রিকেটারের স্মৃতিতে অম্লান। দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতেন গর্ডন। অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠ ও মাঠের বাইরে খেলোয়াড়দের সাথে তাঁর একটা আবেগময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

আইসিসি ট্রফি জয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ গ্রিনিজকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়া হয়। বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীর পর বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পাওয়া দ্বিতীয় ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ছিলেন গ্রিনিজ। নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে গর্ডনকে দেওয়া হয়েছিল একটি পাসপোর্ট। গ্রিনিজ সেই পাসপোর্টটি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন যত্নের সঙ্গে। 

'৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ের পর গ্রিনিজের অধীনেই বাংলাদেশ পেয়েছিল ওয়ানডে স্ট্যাটাস। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপের আগে বেশ কয়েকটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগও পেয়েছিল। ১৯৯৮ সালের মে মাসে তাঁর হাত ধরেই কেনিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ পেয়েছিল ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে জয়। গ্রিনিজের অধীনে সাফল্য-ব্যর্থতা হাতে হাত মিলিয়েই এগিয়েছে। তবে তাঁর সময়ের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখার সুযোগ খুব কমই। বরং এদেশের ক্রিকেটে সাফল্য আসার রাস্তাটা নির্মিত হয়েছিল তাঁর হাতেই। গ্রিনিজের সময়েই ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিল বাংলাদেশ; মেহরাব হোসেন অপির ব্যাটে।

অচেনা ও কঠিন ইংলিশ কন্ডিশনে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। টুর্নামেন্টে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্থানীয় কাউন্টি দলগুলোর বিপক্ষে সেবার তিনটি ম্যাচ খেলেছিলাম আমরা। এসেক্স আর আর মিডলসেক্সের বিপক্ষে দুটি জয় বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল বাড়তি আত্মবিশ্বাস। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম জয়টা আসে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে । তবে এরই মধ্যে ঘটে যায় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের শেষ ম্যাচটি ছিল নর্দাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে। সেবারই প্রথমবারের মতো একটি টেস্ট দলকে হারালাম আমরা। ঐতিহাসিক জয়ের সেই ম্যাচটির কয়েক ঘণ্টা আগে গ্রিনিজের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল বরখাস্তের নোটিশ। চাকরি হারানো গ্রিনিজ তবু সেদিন এসেছিলেন মাঠে; দেখা করে গিয়েছিলেন প্রাণপ্রিয় শিষ্যদের সঙ্গে। যে কিনা দলটার পেছনে এতো পরিশ্রম করল, অথচ এত বড় একটা বিজয় উদযাপিত হয়েছিল সেই মানুষটিকে ছাড়াই!

'৯৯ বিশ্বকাপের আগে থেকেই এদেশের ক্রিকেট প্রশাসকদের সঙ্গে কিছু ব্যাপারে গ্রিনিজের টানাপোড়েন চলছিল। বাংলাদেশ তখন টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে ব্যাকুল। অথচ বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো ছিল অনুন্নত; আমাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট শুরুই হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে তাই টেস্ট মর্যাদার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন গর্ডন। গ্রিনিজের মত ছিল, টেস্ট খেলার জন্য বাংলাদেশ এখনো তৈরি নয়। আর তাতেই ক্রিকেট বোর্ডের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরাগভাজন হন তিনি। 

তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছিল এমন একটা দিনে যার একদিন পরেই জাতীয় দলের সঙ্গে তাঁর চুক্তি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ব্যাপারটি লজ্জা দিয়েছিল সবাইকে। লজ্জার মাত্রাটা আরো বেড়ে গিয়েছিল, গর্ডন গ্রিনিজ বিশ্ব ক্রিকেটের একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব বলে। গর্ডন গ্রিনিজ যে মাপের ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব, তাঁকে এভাবে বিদায় করে দিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটই অসম্মানিত হয়েছে।

বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেলল, ভালো করল অথচ গ্রিনিজ বিদায় নিলেন নিরবে, নিভৃতে, মাথা হেঁট করে। এই ঘটনাটি জাতি হিসেবে আমাদের মাথা উঁচু তো করেইনি, বরং গর্ডনের সেই বিদায় জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট করে দিয়েছিল।

বিদায়টা খুব সুখের না হলেও গ্রিনিজের মনে যে বাংলাদেশের জন্য একটা আলাদা জায়গা আছে, তার প্রমাণ মেলে ২০০০ সালে; বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকের স্বর্ণালি লগ্নে। সেবার বিসিবির বিশেষ আমন্ত্রণে তিনি সস্ত্রীক বাংলাদেশে এসেছিলেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়েই। সবকিছু ভুলে এদেশের মাটিতে তিনি সেবার পা রেখেছিলেন বাংলাদেশের একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবেই। অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের দারুণ পারফরম্যান্স দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন গ্রিনিজ। উচ্ছ্বসিত গলায় বলেছিলেন, "I am very happy for Bangaldesh and its players, who have done wonderfully well".

অভিষেক টেস্টে শতক হাঁকানো সাবেক ছাত্র আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে নিজের হোটেল রুমে ডেকে নিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন গ্রিনিজ। পরম মমতায় বুকে টেনে নিয়ে স্নেহের আলিঙ্গনে সিক্ত করেছিলেন প্রিয় শিষ্যকে। আর বলেছিলেন, "Well played, but why did you get out? You should have kept your patience. After all it is not every day that you get a chance to make a real big score."

বাংলাদেশের কোচ হিসেবে কাটানো তিনটে বছর গ্রিনিজ কখনোই ভুলবেন না। শুধু ক্রিকেট নয়, এ দেশের মানুষের কাছে যে ভালোবাসা পেয়েছেন, সেটাও হয়ত কোনদিন ভুলবেন না গ্রিনিজ। 

এক সাক্ষাতকারে গ্রিনিজ বলেছিলেন, "বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের দায়িত্বটা ছিল কোচ হিসেবে আমার ক্যারিয়ারের প্রথম বড় দায়িত্ব। আমার সময়ে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জিতেছিল, যা তাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সুযোগ করে দেয়। বাংলাদেশের কোচ হিসেবে আমার রয়েছে অনেক স্মৃতি। আমরা সবাই মিলে যা যা অর্জন করেছিলাম, তার জন্য আমি আজও গর্ববোধ করি। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ আমার হৃদয়ের অনেকটা জায়গাজুড়েই আছে।"

গর্ডন গ্রিনিজকে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে নিবেদিত প্রাণ বিদেশি কোচ বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। এদেশের ক্রিকেটের আজকের এই উত্থানের পেছনে গ্রিনিজের অবদানকে তাই অস্বীকার করবার কোন উপায়ই নেই।