বাংলাদেশ ক্রিকেট

চায়নাম্যানের ‘হাহাকারে’ বাবার হাতে পুত্রের অভিষেক

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 17:45 বৃহস্পতিবার, 18 এপ্রিল, 2024

|| ক্রিকেট করেসপনডেন্ট ||

কদিন আগে চৈত্রকে অতীত করে বৈশাখে পা দিয়েছে বাংলা বছর। নববর্ষ আসতেই যেন রোদের প্রখরতা বেড়েছে। শীতের সময়টায় বেলা ৯ টা নাগাদ যখন কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে, বৈশাখে তখন আলোর ঝলকানি। নারায়ণগঞ্জে তখন ঝলমলে আকাশ, প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব এবং গাজী টায়ার্সের ম্যাচ তখনও শুরু হয়নি। বাউন্ডারি সীমানার একটু বাইরে, ড্রেসিং রুমের সামনে গাজী টায়ার্সের জার্সিতে গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন লিকলিকে গড়নের এক তরুণ!

যেহেতু ম্যাচের জার্সি পড়েছেন, ম্যাচ যে খেলবেন সেটা তো প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়! সেটা নিশ্চিত হওয়া গেছে একটু পরই। তরুণ এই ক্রিকেটারের পাশে তখন দাঁড়িয়ে আছেন গাজী টায়ার্সের টিম ম্যানেজমেন্টের দুই সদস্য। টকটকে লাল রঙের ক্যাপ হাতে দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনও। দেশের ক্রিকেটে তাকে চেনেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। ম্যাচ শুরুর আগে সেখানে দাঁড়িয়ে তরুণ সেই ক্রিকেটারের মাথায় পড়িয়ে দিলেন লাল রঙের ক্যাপটি। সালাহউদ্দিন যাকে ক্যাপ পড়িয়ে দিলেন তার নাম নুহায়েল সানদিদ।

এমন মুহূর্তের কথা কল্পনা করে আপনি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেতেই পারেন। আপনার মাঝে এমন প্রশ্ন আসতেই পারে গাজী টায়ার্সের ক্রিকেটারকে কেন ক্যাপ পড়িয়ে দিলেন প্রাইম ব্যাংকের প্রধান কোচ সালাহউদ্দিন। প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারের হাত থেকে অভিষেক ক্যাপ নেন, এমন ঘটনা তো বিরলই। ফতুল্লায় অবশ্য এমন ঘটনাই ঘটেছে। তবে এমন ছবি কিংবা মুহূর্তের আলাদা একটা বিশেষত্ব আছে।

সানদিদের বড় পরিচয় দেশসেরা কোচ হিসেবে পরিচিত সালাহউদ্দিনের ছেলে। বাবার পড়িয়ে দেয়া ক্যাপে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) অভিষেক হলো সানদিদের। দেশের ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হলো একজন চায়নাম্যান স্পিনারেরও। লেগ স্পিনারের হাহাকারে চায়নাম্যানের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছে বাংলাদেশ। সবশেষ কয়েক বছরে ক্রিকেটার, কোচ আর বোর্ড কর্তাদের হাহাকার নিয়ে একটা গল্প লেখা গেলে সেখানে বোধহয় লেগ স্পিনার শব্দটাই বেশি পাওয়া যাবে।

এনামুল হক মনি, মোহাম্মদ রফিক, আব্দুর রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান, তাইজুল ইসলাম থেকে এখন রাকিবুল হাসান, হাসান মুরাদ। বাঁহাতি স্পিনের আঁতুড়ঘর হিসেবে বেশ পরিচিত বাংলাদেশ। অথচ বাঁহাতি স্পিনারের দেশে নেই একজন তারকা চায়নাম্যান। তারকা শব্দটা আপনি একপাশে সরিয়ে রাখলে যত্ন নেবেন, আশার আলো দেখবেন এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া কঠিন। অথচ সত্তরের দশকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিকেও খেলে গেছেন চায়নাম্যান স্পিনার।

ক্রিকেটার গড়ার কারিগর ও খ্যাতিমান ক্রিকেট লেখক জালাল আহমেদ চৌধুরির চোখে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা একাদশের একজন, নাম নজরুল কাদের লিন্টু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রিকেটও খেলতেন তিনি। ইয়াং পেগাসাসের হয়ে ক্রিকেটার হিসেবে শুরু করা সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন অল্প সময়ই। দেশের ক্রিকেটের ‘সর্বকালের সেরা’ চায়নাম্যান হলেও ২১ বছর বয়সেই দেশ ছেড়েছিলেন।

১৯৭৯ আইসিসি ট্রফি সুযোগ না পাওয়ার পরই পড়ার টানে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটে গিয়েছিলেন লিন্টু। সেদিন নিজে যাওয়ার সঙ্গে যেন নিয়ে গিয়েছিলেন চায়নাম্যান স্পিনকেও। বাংলাদেশে এত এত বাঁহাতি স্পিনার এলেও চায়নাম্যান হিসেবে আসেননি কেউই। নিজের ছোট্ট ক্যারিয়ারে লিন্টু সেই সময় প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ব্যাটসম্যান কনরাড হান্ট, এমসিসির অধিনায়ক ইয়ান ক্লার্ক এবং ডেকান ব্লুজের ব্যাটার অজিত ওয়াদেকারের।

অথচ সেই দেশেই এখন চলছে চায়নাম্যানের জন্য হাহাকার। মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টির জন্য মানুষের যেমন হাহাকার হয় আরকি। ৪৫ বছর পর চায়নাম্যানের জন্য মরুভূমি হয়ে ওঠা বাংলাদেশে প্রশান্তিময় বৃষ্টি হয়ে আসতে পারেন সানদিদ। বাবা সালাহউদ্দিন দেশের অন্যতম সেরা কোচ, তাই ভালো করে জানেন প্রয়োজনটা কোথায়। যেমনটা সালাহউদ্দিন বোঝেন সাকিব, তামিম ইকবাল কিংবা সৌম্য সরকারদের। সানদিদের শুরুটা হলো ‘বাবার ক্লাব’ প্রাইম ব্যাংকের বিপক্ষে।

ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামে প্রথমবার বোলিংয়ে আসেন ইনিংসের ১৪তম ওভারে। নিজের প্রথম ওভারে দিয়ে গেছেন ৯ রান। সব মিলিয়ে এদিন বোলিং করেছেন ৬ ওভার, রান দিয়েছেন ৪১ এবং সানদিদের শিকার ২ উইকেট। নিজের অভিষেক ম্যাচেই ‘বিগ ফিশ’ হিসেবে পেয়েছেন মোহাম্মদ মিঠুন এবং শেখ মেহেদীর উইকেট। সানদিদের লেগ স্টাম্পের বাইরে পড়ে ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে হাঁটু গেড়ে সুইপ খেলার চেষ্টা করেছিলেন মিঠুন। বলের লাইন মিস করে প্রাইম ব্যাংকের অভিজ্ঞ ব্যাটার বোল্ড হয়ে ফিরলেন তরুণ সানদিদের স্পিনে।

শেখ মেহেদীকে আউট করেছেন গালিতে ক্যাচ বানিয়ে। তাদের দুজনকে আউট করা সানদিদ এদিন কঠিন পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করেছেন মুশফিকুর রহিমেরও। বাঁহাতি এই চায়নাম্যান স্পিনারের মিডল স্টাম্পে পড়ে বেরিয়ে যাওয়া ডেলিভারিতে যেন ‘ভড়কে’ গেলেন দেশের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা এই ব্যাটারও! বলটা খেলার পর নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সালাহউদ্দিন পুত্রকে দেখে অতীতে ফিরে গেলেন জালাল ইউনুস।

ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে লিন্টুকে টেনে ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের সময় একজন ছিল চায়নাম্যান স্পিনার, তার নাম ছিল নজরুল কাদের লিন্টু। মাঝে তো সেভাবে কাউকে দেখিনি। অনেক বছর পর আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে একজন চায়নাম্যান দেখলাম, সালাহউদ্দিনের ছেলে, সানদিদ। এটা আমাদের জন্য ভালো ব্যাপার।’

ডিপিএলের গ্রুপ পর্বের যেখানে শেষ, সানদিদের সেখানে ক্যারিয়ারের শুরু। বাংলাদেশের লিন্টু কিংবা বিশ্ব ক্রিকেটে দাপট দেখানো এলিস এডগার ‘পুস’ আচং, স্যার গ্যারি সোবার্স, ব্র্যাড হজ, কুলদীপ যাদব, নূর আহমেদ হয়ে উঠতে অনেকটা পথ অবশ্য পাড়ি দিতে হবে সালাহউদ্দিন পুত্রকে। তবুও সানদিদকে নিয়ে তো স্বপ্ন দেখাই যেতে পারে, আশায় বুক বাঁধতেই পারেন কেউ কেউ। একদিন হয়ত সানদিদই হয়ে উঠবেন বাংলার কুলদীপ নয়ত গ্যারি সোবার্স। এমন দিনের জন্য আপনি কেবল অপেক্ষাই করতে পারেন...