নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট

হকির স্ট্রাইকার থেকে ক্রিকেটের মারকুটে সেইফার্ট

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 17:19 বৃহস্পতিবার, 01 এপ্রিল, 2021

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

জীবনের শুরুটা যেমন একেকজনের একেক রকম তেমনি লক্ষ্যও থাকে একেবারে ভিন্ন। ধরুন, কেউবা হতে চান আলবার্ট আইনস্টাইন, কেউবা ডন ব্রাডম্যান, কেউবা নামকরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা ম্যারাডোনা, আবার কেউবা শেন ওয়ার্ন। গুটিকয়েকজনের নাম বললাম, এছাড়াও আরও অনেকেই আছেন জীবন চলার পথে যাদের আমরা অনুপ্রেরণার উৎস মনে করি।

তেমনি করেই তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে যাই সামনের দিকে। কেউ সফল হই, কেউবা প্রতিযোগিতার সঙ্গে দৌঁড়াতে না পেরে পিছিয়ে পড়ি। আবার কেউ কেউ ভিন্ন পথ বেছে নেই জীবনচলার তাগিদে। আবার হঠাৎ করেই জীবন চলার পথে অনেকের মোড় বেঁকে যায়। তৈরি হয় নতুন ইতিহাসের। ইতিহাসের পাতা ঘাটলে এমন গল্প হাজারটা হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে।

কোনো খেলাকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে নেয়ার আগে অনেকেই একাধিক খেলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এমন ঘটনাও নেহাত কম নয়। তবে সময়ের ব্যবধানে পছন্দ ও ভবিষ্যতের কথা ভেবে কোনো একটা বেছে নিতে হয়। ছোটবেলায় একই সঙ্গে দুটি ভিন্ন খেলায় একই রকম দাপট দেখিয়েছেন এমন খেলোয়াড়ের সংখ্যাও অনেক।

অন্য কোনো খেলায় বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট খেলার পর ক্রিকেটে এসে সাফল্যের গল্পও কম নেই। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি ক্রিকেটার এবি ডি ভিলিয়ার্স ও বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিল্ডার হিসেবে বিবেচিত জন্টি রোডস। তারা ক্রিকেটের আগে নিজ দেশের হকি দলের হয়ে বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট খেলার নজির গড়েছিলেন।

ভিলিয়ার্সতো ফুটবল, হকি এমনকি রাগবি দলের হয়েও দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আর রোডস দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় হকি দলের হয়েও খেলেছেন। ১৯৯২ সালের অলিম্পিক দলেও ছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর দল বাছাইপর্ব পার করতে পারেনি। ১৯৯৬ অলিম্পিকেও তিনি দলে জায়গা পেয়েছিলেন।

এমন গল্প রয়েছে নিউজিল্যান্ডের মারকুটে ব্যাটসম্যান টিম সেইফার্টেরও। বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায় যেমন ক্রিকেট খেলেছেন নিয়মিত, তেমন দাপট দেখিয়েছেন হকিতেও। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়কে বেছে নিয়ে হকি ও ক্রিকেট খেলাকে একসঙ্গে চালিয়ে যেতেন। গ্রীষ্ম মৌসুমে ক্রিকেট খেলার পর সেইফার্ট শীতকালে নেমে পড়তেন হকির স্টিক নিয়ে। সেই হকি দলের স্ট্রাইকার হিসেবেও দারুণ সুনাম কুড়িয়েছিলেন তিনি। 

কিছুদিন আগে এক সঙ্গে দুটি খেলাই চালিয়ে যাওয়ার গল্প ‍শুনিয়েছেন এক ভিডিও বার্তায়। এ প্রসঙ্গে সেইফার্ট বলেন, ‘আমি একজন হকি ও ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলাম। আমি গ্রীষ্মে ক্রিকেট আর শীতে হকি খেলতাম। আমার হকি ক্যারিয়ারের অনেকটা অংশ জুড়ে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছি। আমি স্ট্রাইকারদের ব্যাপারগুলো খুবই পছন্দ করতাম, আপনি জানেন যে ড্রাইভ করছেন, ফ্লিক করার চেষ্টা করছেন এবং গোল করছেন। ডিফেন্ডারকে বিট করে গোল দেয়া দারুণ অনুভূতি।’

বয়স যখন মাত্র ৬, তখনই ক্রিকেট বল খেলতে শুরু করেছিলেন সেইফার্ট। তবে প্রথমবার ‍যখন ক্রিকেট বল খেলতে নেমেছিলেন সেবার শূন্য রানেই ফিরতে হয়েছিল এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানকে। স্কুল ক্রিকেট শুরুর আগে রান্না ঘরে টেবিল টেনিস বল দিয়ে ক্রিকেট ও হকির শুরুটা হয়েছিল তাঁর। শূন্য রানে ক্রিকেট বল খেলা শুরু করা সেইফার্ট যখন স্কুল ক্রিকেটে শুরু করেন তখন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে রীতিমত দারুণ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি।

সংগৃহীতছবি: সংগৃহীত

সাউথওয়েল স্কুলের হয়ে দীর্ঘদিন খেলেছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। যেখানে দলটির হয়ে ৪৭ গড়ে করেছিলেন ২ হাজার ২৬৮ রান। এ ছাড়া উইকেটের পেছনে ১০০টি ডিসমিসাল করেছিলেন। এমন পারফরম্যান্সের সুবাদে সেন্ট পিটার্সের সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। সেবার জাতীয় জুনিয়র স্কুল টুর্নামেন্টে ৮৭ বলে অপরাজিত ১৪২ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেছিলেন।

যা ২০১০ সাল পর্যন্ত একজন সহ-অধিনায়ক হিসেবে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস হিসেবে টিকে ছিল সেই টুর্নামেন্টে। সেইফার্ট যখন প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। ওয়াইকাটো একাদশের হয়ে ফাইনালে সেঞ্চুরি করার সঙ্গে দলকে শিরোপা জিতিয়েছিলেন তিনি। তবে এমন সাফল্যের জন্য তাঁর বাবা-মার কৃতিত্বটা অনেক বেশি।

সেই গল্প বলতে গিয়ে সেইফার্ট বলেন, ‘বাবা-মা আমাকে এবং আমার বোনকে স্কটল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তারা সারা বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তারা কেবল নিউজিল্যান্ড নয় বিশ্বের অনেকটা অংশ জুড়ে ধারণা দিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, এটি দুর্দান্ত ছিল। আমি মনে করি রান্না ঘরে টেবিল টেনিস বল ও সাক্ষরকরািএকটি ব্যাট দিয়ে হাতে হকির স্টিক এবং ক্রিকেট ব্যাট হাতে তুলে নিয়েছিলাম। আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমার বয়স যখন ৬ তখন আমি প্রথম ক্রিকেট বল খেলেছি এবং আমি গোল্ডেন ডাক মেরে আউট হয়েছি। ক্রিকেট বল খেলার এটাই আমার প্রথম স্মৃতি।’

স্কুল হকি কিংবা বিভিন্ন লিগে স্টিক হাতে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন সেইফার্ট। ফ্রেশার-টেক সিনিয়র হকি দলের হয়ে মিডল্যান্ডস আন্তঃ প্রিমিয়ার লিগের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করে দলকে শিরোপা জিতেয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া সেই মৌসুমে ১৪ ম্যাচ খেলে ২৫বার স্কোরশিটে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি।

ওয়াইকাটো ও সেন্ট পিটার্স প্রথম একাদশের হয়ে খেলার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। যেখানে ওয়াইকাটোর হয়ে ৭৫ ম্যাচে ৯৯ আর সেন্ট পিটার্সের হয়ে ৪৪ ম্যাচে ৫৩ বার স্কোর শিটে নাম লিখিয়েছিলেন তিনি। এমন পারফরম্যান্সের সুবাদে খুব দ্রুতই জায়গা করে নেন নিউজিল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৮ হকি দলে।

ছবি: সংগৃহীত

সেই সঙ্গে ক্রিকেটে নিউজিল্যান্ডের যুব দলেও সুযোগ হয় তাঁর। সেবার যুব বিশ্বকাপের পরই শীতের মৌসুম শুরু। যে সময়টায় তিনি হকি খেলায় ব্যস্ত থাকেন সেই সময়টায় ক্লাব ক্রিকেট খেলতে ইংল্যান্ড থেকে প্রস্তাব আসে ২৬ বছর বয়সি এই ক্রিকেটারের।

ইংলিশদের ডেরায় খেলতে যাওয়ার কারণে সেই মৌসুমে অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে হকির স্টিক হাতে আর মাঠে নামা হয়নি তাঁর। সেখান থেকেই শুরু হয় সেইফার্টের হকি ছেড়ে ক্রিকেটার হওয়ার পথচলা। দুইটা খেলাতেই ভালো করা পরও বাধ্য হয়েছে যেকোনো একটা বেছে নিতে হয়েছিল তাঁকে। সেখানে বুদ্ধির সঙ্গে ক্রিকেটকে বেছে নেন তিনি। তাঁর ধারণা ক্রিকেট বাদ দিয়ে হকি খেললে তিনি এতটা স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন পেতেন না।

হকি খেলোয়াড় থেকে ক্রিকেটার হওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে সেইফার্ট বলেন, ‘আমার বয়স তখন ১৮ কিংবা ১৯। নিউজিল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে অভিষেক হয় এবং সেখানে খেলার জন্য এটি দারুণ একটি সুযোগ। বিশ্বকাপের পরই সেবার শীত শুরু হয়। ক্লাব ক্রিকেটে ইয়র্কশায়ার হাডারফিল্ড লিগ খেলার জন্য আমি ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পাই। সেবারই প্রথমবারের মতো পুরো বছর জুড়ে ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি সেই শীতে হকি খেলতে পারিনি কারণ আমি তখন ইংল্যান্ড সফরে ছিলাম। ক্রিকেটের দিকে ধাবিত হওয়ার শুরুটা সেখানেই।’

‘এখনও আমি হকি খেলা এবং সেই প্রতিযোগীদের মিস করি। আমি মিডল্যান্ডস ও নিউজিল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়ে খেলার সুযোগ মিস করি। তুমুল প্রতিযোগিতার হকিকে মিস করি কিন্তু অন্য দিক দেখলে মিস করি না.....। আমি জানতাম হকি আমাকে দারুণ লাইফ স্টাইল দিতো না। সম্ভবত ক্রিকেটের মতো জীবনে এতো সুযোগও দিতো না। এটা (হকি খেলা চালিয়ে যাওয়া) বুদ্ধিমানের কাজ হতো না।’

নর্দান ড্রিস্ট্রিক্টের হয়ে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর জাতীয় দলে ‍সুযোগ পেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। দলটির হয়ে ওয়েলিংটনের বিপক্ষে ৪০ বলে সেঞ্চুরিও আছে তাঁর। সাম্প্রতিক সময়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছেন সেইফার্ট। তবে আলাদাভাবে চেনাচ্ছে ব্যাট হাতে তাঁর বিচিত্র শট।

সুইপ, রিভার্স সুইপ, সুইচ-হিট, কাট, ড্রাইভ, স্লগ সুইপ এবং প্যাডেলস, সবটাই দখলে রয়েছে তাঁর। ছোট বেলা থেকে হকি খেলার কারণেই শটের এমন বৈচিত্র এসেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। সেটি আরও বিস্তর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রস টেলর ও বিজে ওয়াটলিংয়ের উদাহরণ টেনেছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি কিন্ডা আপনাকে স্কয়ার উইকেটে ‍সুইচ হিট, প্যাডেলস খেলার সুযোগ করে দেয়। কারণ এগুলো আক্ষরিক অর্থে হকির শট। আপনি যদি দেখেন অনেক খেলোয়াড় আছে। রস টেলর, বিজে ওয়াটলিংরাও হকি খেলোয়াড় ছিল। তারা স্কয়ার উইকেটে দারুণ করে কারণ এটি (হকি খেলা) খুবই সহায়তা করে।’

সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর বেশ কিছু ঝড়ো ইনিংস দেখে অনেকেই ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সঙ্গে তুলনা করছেন। তিনি অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে জানিয়েছিলেন সেই ম্যাককালামই কিনা তাঁর শৈশবের নায়ক। এ প্রসঙ্গে সেইফার্ট বলেছিলেন, ‘আমি একজন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। স্বাভাবিকভাবেই আমার সবচেয়ে পছন্দের ক্রিকেটারের নাম ব্রেন্ডন ম্যাককালাম। ছোটবেলা থেকেই ওর খেলা দেখেছি। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের জন্য ও অনেক কিছু করেছে। ওর মতো ইনিংস খেলতে চাই আমিও।’