ক্রিকেট লিজেন্ডস

স্যার রিচার্ড হ্যাডলিঃ নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের রূপকথার নায়ক

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 23:32 শুক্রবার, 31 আগস্ট, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

তাঁর সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে, “দ্য ফাইনেস্ট ক্রিকেটার নিউজিল্যান্ড হ্যাজ এভার প্রোডিউসড”। ক্রিকেট বিশ্বে তুলনামূলক খর্বশক্তির দল হিসেবে বিবেচিত নিউজিল্যান্ডকে তিনিই সর্বপ্রথম লড়াই করে জিততে শিখিয়েছেন। আশির দশকের সেরা চার অলরাউন্ডারের একজন তিনি। অথচ শুধুমাত্র ফাস্ট বোলার হিসেবেই তিনি সর্বকালের সেরাদের কাতারে থাকার যোগ্য। বলছিলাম টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ৪০০ উইকেট পাওয়া বোলার এবং কিংবদন্তি অলরাউন্ডার স্যার রিচার্ড হ্যাডলির কথা।

রিচার্ড হ্যাডলিকে মনে করা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে নিখুঁত ও কনসিস্টেন্ট ফাস্ট বোলারদের একজন। টেকনিক, বুদ্ধিমত্তা, স্কিল এবং ম্যাচ উইনিং অ্যাবিলিটির বিচারে তাঁর সমকক্ষ বোলার ক্রিকেট ইতিহাসে বিরল। সাবেক প্রোটিয়া অলরাউন্ডার ক্লাইভ রাইসের মতে সর্বকালের সেরা পাঁচজন ফাস্ট বোলারের একজন হলেন রিচার্ড হ্যাডলি।

ক্যারিয়ারের শুরুতে হ্যাডলি ছিলেন একজন জেনুইন ফাস্ট বোলার। লম্বা রানআপ এবং হাই আর্ম সাইড-অন একশনে যেকোন উইকেটে তুলতে পারতেন গতির ঝড়। সাবেক ইংলিশ গতিদানব ফ্রাঙ্ক টাইসনের মতে, হ্যাডলির গতি ছিল ম্যালকম মার্শাল কিংবা জোয়েল গার্নারের কাছাকাছি। তবে সময়ের সাথে রানআপ ও গতি কমিয়ে মনোযোগ দেন অ্যাকুরেসি, কন্ট্রোল এবং সুইংয়ের দিকে। উইকেটের দুপাশেই বলকে সুইং করাতে পারতেন, তবে আউটসুইংটা ছিল ন্যাচারাল।

উইজডেনের ভাষায়, “His lithe, whippy, side-on action made life uncomfortable for all the great batsmen of his era, as he extracted pace, bounce and movement from even the least responsive of surfaces.”

হ্যাডলির ক্রিকেটিং আইডল ছিলেন ফাস্ট বোলিং কিংবদন্তি ডেনিস লিলি। লিলিকে দেখেই নিজের অস্ত্রভাণ্ডারে ইনসুইং, অফ কাটার এবং লেগ কাটার যোগ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে স্লোয়ার ডেলিভারি এবং গুড লেন্থ থেকে বলকে আচমকা লিফট করানোর কৌশলও আয়ত্ত করেন। বাউন্সার এবং ইয়র্কারের ব্যবহার ছিল কদাচিৎ তবে কার্যকরী। 

হ্যাডলি বল রিলিজ করতেন স্টাম্পের খুব কাছ থেকে। এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিল, “When the ball shot through along a line drawn from middle stump to middle stump, even minimal movements through the air and off the pitch could produce devastating effect.”

১৯৫১ সালের ৩ জুলাই, ক্রাইস্টচার্চের একটি স্বনামধন্য ক্রিকেট পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রিচার্ড জন হ্যাডলি। তাঁর বাবা ওয়াল্টার হ্যাডলিও ছিলেন বেশ নামকরা ক্রিকেটার। নিউজিল্যান্ডের হয়ে ১১টি টেস্ট খেলা সাবেক এই ডানহাতি ওপেনারকে মনে করা হয় দেশটির ইতিহাসে অন্যতম সেরা অধিনায়ক।

ওয়াল্টার হ্যাডলির পাঁচ সন্তানের সবাই ছিলেন ক্রিকেটার। এদের মধ্যে তিনজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রতিনিধিত্ব করেছেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে। ব্যারি হ্যাডলি (ব্যাটসম্যান), ডেল হ্যাডলি (ফাস্ট বোলার) আর রিচার্ড হ্যাডলি (অলরাউন্ডার) তিন ভাই একসাথে খেলেছেন ১৯৭৫ বিশ্বকাপে। মজার ব্যাপার হল, স্যার রিচার্ড হ্যাডলির সাবেক স্ত্রী কারেন হ্যাডলিও ১৯৭৮ সালে একটি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন নিউজিল্যান্ড প্রমীলা ক্রিকেট দলের হয়ে!

স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক ১৯৭১ সালে, ক্যান্টারবুরির হয়ে। প্রথম টেস্ট খেলেন ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়েলিংটনে। ওয়ানডে অভিষেকটাও একই বছর একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, ঘরের মাঠ ক্রাইস্টচার্চে।

১৯৭৩ সালে অভিষেক হলেও তাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলার শুরুটা তেমন মসৃন ছিল না। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ক্যারিয়ারের প্রথম ১৭ টেস্টে তাঁর শিকার ছিল মাত্র ৬১ উইকেট, ৩৫.৫৭ গড়ে! আর ব্যাট হাতে ২২.৮৫ গড়ে তাঁর সংগ্রহ ছিল মাত্র ৬১৭ রান। 

তবে এই সাদামাটা ক্যারিয়ারেই নিজের বোলিং প্রতিভা এবং অলরাউন্ড সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি। এবং সেটাও অস্ট্রেলিয়া, ভারতের মত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে টেস্ট জেতানোর মধ্য দিয়ে।

হ্যাডলির অভিষেকের পূর্বে তৎকালীন ক্রিকেটের 'বিগ থ্রি' বলে বিবেচিত ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়াকে কখনোই হারাতে পারে নি নিউজিল্যান্ড। অথচ হ্যাডলির আবির্ভাবের কিছুদিন পরই ইতিহাসে প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর স্বাদ পায় তারা। ১৯৭৪ সালে হ্যাডলির বোলিং নৈপুণ্যেই (৩/৫৯ ও ৪/৭১) ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ইতিহাস গড়েছিল কিউইরা। উল্লেখ্য, এটা ছিল বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট জয়!

১৯৭৬ সালে সিরিজ নির্ধারণী ওয়েলিংটন টেস্টে ভারতের বিপক্ষে ইনিংস ব্যবধানে জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। বিধ্বংসী বোলিংয়ে স্যার রিচার্ড হ্যাডলি একাই নিয়েছিলেন ১১ উইকেট (৪/৩৫ ও ৭/২৩)। অথচ সুনীল গাভাস্কার, দিলীপ ভেংসরকার, মহিন্দর অমরনাথ, গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথে সমৃদ্ধ ভারতের তৎকালীন ব্যাটিং লাইনআপ ছিল বেশ শক্তিশালী। 

স্যার রিচার্ড হ্যাডলির ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা যেতে পারে ১৯৭৮ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া ঐতিহাসিক টেস্ট জয়কে। দীর্ঘ ৪৮ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল নিউজিল্যান্ড। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে স্যার রিচার্ড হ্যাডলির অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যে ব্ল্যাক ক্যাপসরা জিতেছিল ৭২ রানে। দুই ইনিংস মিলিয়ে হ্যাডলির শিকার ছিল ১০ উইকেট (৪/৪৭ ও ৬/২৬)। 

অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের পর হ্যাডলির নিউজিল্যান্ডের পরবর্তী শিকার ছিল ক্লাইভ লয়েডের দোর্দন্ড প্রতাপশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ১৯৭৯-৮০ সালে মূলত হ্যাডলির 'একক' নৈপুণ্যেই ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। 

তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটা হয়েছিল ডানেডিনে। সফরকারী ক্যারিবীয়দের দেয়া ১০৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস এক জয় পায় নিউজিল্যান্ড। ঐতিহাসিক এই বিজয়ে ব্যাটে-বলে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। বল হাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে ১১ উইকেট (৫/৩৪ ও ৬/৬৮) নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে খেলেছিলেন ৫৩ ও ১৭ রানের 'মহামূল্যবান' দুটো ইনিংস।  

পরের দুটি ম্যাচ ড্র হলে সিরিজ জয়ের ট্রফি ঘরে তোলে স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড এবং তাতে হ্যাডলির অবদান ছিল ১৭৮ রান এবং ১৯ উইকেট। 

উল্লেখ্য, ঘরের মাঠ ক্রাইস্টচার্চে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি তুলে নেন রিচার্ড হ্যাডলি। আট নম্বরে নেমে রবার্টস-হোল্ডিং-গার্নার-ক্রফটের মত দানবীয় ফাস্ট বোলারদের পিটিয়ে খেলেন ৯২ বলে ১০৩ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। 

১৯৮০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারে নিউজিল্যান্ড। তবে দল ব্যর্থ হলেও ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে উজ্জ্বল ছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি। দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ মাত্র ১৯.১৬ গড়ে তুলে নেন ১৯ উইকেট। 

১৯৮২ সালে অজিদের বিপক্ষে ফিরতি সিরিজের প্রথম ম্যাচ ড্রয়ের পর দ্বিতীয় টেস্টটা জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে হ্যাডলির ৮ উইকেট শিকারের (৩/৩৮ ও ৫/৬৩) কল্যাণেই অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারাতে পেরেছিল তারা। পরের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জিতলে সিরিজে আসে ১-১ সমতা। মাত্র ১৬.১৪ গড়ে ১৪ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন হ্যাডলি। 

১৯৮৩ সালে হেডিংলি টেস্টে ল্যান্স কেয়ার্নসের বিধ্বংসী বোলিংয়ে (৭/৭৪ ও ৩/৭০) স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ উইকেটের অবিস্মরণীয় এক জয় তুলে নেয় নিউজিল্যান্ড। উল্লেখ্য, এটাই ছিল ইংল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টেস্ট জয়। বল হাতে উইকেটশূন্য হ্যাডলি এ ম্যাচে আলো ছড়িয়েছিলেন ব্যাট হাতে। ৭ নম্বরে নেমে খেলেছিলেন ৭৫ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস। 

শেষ পর্যন্ত ৩-১ ব্যবধানে সিরিজ হারলেও ব্যাটে-বলে দলের সেরা পারফর্মার ছিলেন হ্যাডলিই। ব্যাট হাতে ৪ ফিফটিসহ ৩০১ রান এবং বল হাতে দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ নিয়েছিলেন ২১ উইকেট। 

ফিরতি সিরিজ খেলতে পরের বছরই ইংলিশরা আসে নিউজিল্যান্ড সফরে। এবং সেবারই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের (১-০) গৌরব অর্জন করে নিউজিল্যান্ড। যার সিংহভাগ কৃতিত্ব স্যার রিচার্ড হ্যাডলির।

হ্যাডলির 'ঘরের মাঠ' ক্রাইস্টচার্চে এক ইনিংস ও ১৩২ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করেছিল নিউজিল্যান্ড। বল হাতে ৮ উইকেট (৩/১৬ ও ৫/২৮) নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ৮১ বলে ৯৯ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস খেলেছিলেন হ্যাডলি। ডেভিড গাওয়ার, অ্যালান ল্যাম্ব, ইয়ান বোথাম, মাইক গ্যাটিং, বব উইলিস, ডেরেক র্যান্ডালের মত ক্রিকেটার সমৃদ্ধ ইংল্যান্ডকে বরণ করতে হয়েছিল দুই ইনিংসেই  ১০০'র নিচে অলআউট হওয়ার লজ্জা!

১৯৮৪ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে হ্যাডলির শিকার ছিল দুইবার ইনিংসে ৫ উইকেট ও একবার ম্যাচে ১০ উইকেটসহ ২৩ উইকেট; মাত্র ১০.০ গড়ে! কিউইরা সিরিজ জিতেছিল ২-০ ব্যবধানে।

রিচার্ড হ্যাডলির অনবদ্য বোলিং নৈপুণ্যের সৌজন্যেই ১৯৮৫ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ট্রান্স-তাসমান ট্রফি ঘরে তোলে নিউজিল্যান্ড। ব্রিসবেনে সিরিজের প্রথম টেস্টে হ্যাডলির আগুনঝরা বোলিং তোপে (৯/৫২ ও ৬/৭১) এক ইনিংস ও ৪১ রানের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয় অ্যালান বোর্ডারের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া। বল হাতে একাই ১৫ উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে তিনি খেলেছিলেন ৪১ বলে ৫৪ রানের একটি ঝড়োগতির ইনিংস। 

উল্লেখ্য, জর্জ লোহম্যানের (৯/২৮) পর টেস্টে যেকোন ফাস্ট বোলারের সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ডটি (৯/৫২) এখনও অব্দি স্যার রিচার্ড হ্যাডলির দখলে।

সিডনিতে দ্বিতীয় ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়া জিতলেও শেষ টেস্টে ১১ উইকেট নিয়ে কিউইদের ঐতিহাসিক সিরিজ জয় (২-১) নিশ্চিত করেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। তিন ম্যাচের সিরিজে হ্যাডলি একাই নিয়েছিলেন ৩৩ উইকেট; মাত্র ১২.১৫ গড়ে! ম্যাচে ১০ উইকেট ২ বার আর ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন ৫ বার! 

এ প্রসঙ্গে উইজডেন লিখেছিল, “In that summer of 1985, Sir Hadlee had become the Wizard of Oz in the Land of Oz.”

পরের বছর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ফিরতি সিরিজটাও ১-০ ব্যবধানে জিতে নেয় ব্ল্যাক ক্যাপ্সরা। যেখানে হ্যাডলির অবদান ছিল বল হাতে ১৬ উইকেট এবং ব্যাট হাতে ২১৬ রান। 

১৯৮৬ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথমবারের মত টেস্ট সিরিজ জেতে নিউজিল্যান্ড। কিউইদের একমাত্র জয়টা এসেছিল ট্রেন্টব্রিজে। জয়ের নায়ক ছিলেন যথারীতি স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। বল হাতে ১০ উইকেট (৬/৮০ ও ৪/৬০) নেয়ার পাশাপাশি ব্যাট হাতে খেলেছিলেন ৬৮ রানের দায়িত্বশীল এক ইনিংস। 

বল হাতে ১৯ উইকেট এবং ব্যাট হাতে ১৬৭ রান নিয়ে সিরিজসেরার পুরস্কারটাও উঠেছিল হ্যাডলির হাতে।

১৯৮৭ সালে নিজেদের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ড্র (১-১) করে নিউজিল্যান্ড। ক্রাইস্টচার্চে সিরিজের শেষ ম্যাচটা তারা জিতেছিল ৫ উইকেটে। দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। স্যার ভিভ রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স, রিচি রিচার্ডসন, ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার, কোর্টনি ওয়ালশদের মত ক্রিকেটারের সমন্বয়ে গড়া ক্যারিবীয় দলটা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। 

১৯৮৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় শতরানের দেখা পান স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। তাঁর ২৪০ বলে অপরাজিত ১৫১ রানের অনবদ্য ইনিংসটির সৌজন্যেই কলম্বো টেস্ট ড্র করতে সমর্থ হয়েছিল ব্ল্যাক ক্যাপসরা।

১৯৮৭-৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মেলবোর্নের ঐতিহাসিক 'বক্সিং ডে' টেস্টে ১০ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। কিউইদের দেয়া ২৪৭ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে অস্ট্রেলিয়া একসময় ৯ উইকেট হারিয়ে ফেললেও শেষ পর্যন্ত ম্যাচ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল দুই টেলএন্ডারের দৃঢ়তায়। 

১৯৮৮ সালে ইতিহাসে মাত্র 'দ্বিতীয়বারের' মত (প্রথমবার ১৯৬৯ সালে) ভারতের মাটিতে টেস্ট জয়ের কীর্তি গড়ে নিউজিল্যান্ড। মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের ব্যাটিং স্বর্গেও দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। তাঁর ১০ উইকেট লাভের (৬/৪৯ ও ৪/৩৯) সৌজন্যেই ১৩৬ রানের এক স্মরণীয় জয় পেয়েছিল কিউইরা। উল্লেখ্য, এখনও পর্যন্ত ভারতের মাটিতে এটাই তাদের সর্বশেষ টেস্ট জয়।

কিউই ব্যাটসম্যানদের স্পিন দুর্বলতা এবং ভারতীয় স্পিনারদের নৈপুণ্যে শেষ পর্যন্ত ভারত সিরিজ জিতেছিল ২-১ ব্যবধানে। মাত্র ১৪ গড়ে ১৮ উইকেট নিয়েছিলেন হ্যাডলি। ভারতের মাটিতে ৩৭ বছরের 'বুড়ো' হ্যাডলির অসাধারণ পারফরম্যান্স ক্রিকেটের বোদ্ধা মহলে দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল।

এ সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে উইজডেন লিখেছিল, “Hadlee ran in, the ball darted around in ways that had never been witnessed in India as far as memory and fancy stretched. It veered away deceptively, jagged back with menace, sometimes mischievously held its line. The batsmen were never certain, the edge connected far more frequently than the middle. On occasions it moved early, often it curled late. Once in a while a sudden short one reared at the body. And some broke back off the pitch, right into the batsman.”

১৯৯০ সালে ক্রাইস্টচার্চে ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসাবে টেস্ট ক্রিকেটে ৪০০ উইকেট অর্জনের মাইলফলক স্পর্শ করেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। তাঁর ৪০০তম উইকেটটি ছিলেন সঞ্জয় মাঞ্জারেকার।

১৯৯০ সালের ৫ জুলাই, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এজবাস্টনে ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন তিনি। বিদায়ী টেস্টেও অসাধারণ বোলিং করেছিলেন তিনি। প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট শিকারের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট; ম্যাচসেরা এবং সিরিজসেরা দুটো পুরস্কারই উঠেছিল তাঁর হাতে। অথচ হ্যাডলির বয়স তখন ৩৯ বছর!

হ্যাডলির অবসরের পর উইজডেন লিখেছিল, “Hadlee was a phenomenon — one of a kind, and will perhaps never be repeated.”

প্রায় দেড় যুগের বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি খেলেছেন ৮৬টি টেস্ট এবং ১১৫টি ওয়ানডে। টেস্টে মাত্র ২২.২৯ গড়ে তিনি নিয়েছেন ৪৩১ উইকেট। স্ট্রাইক রেট ৫০.৮। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৩৬ বার আর ম্যাচে ১০ উইকেট শিকার করেছেন ৯ বার। 

উল্লেখ্য, ফাস্ট বোলারদের মধ্যে টেস্টে সবচেয়ে বেশিবার ম্যাচে ১০ উইকেট আর ইনিংসে ৫ উইকেট পাওয়ার রেকর্ডটা স্যার রিচার্ড হ্যাডলির দখলে।

এছাড়া ওয়ানডেতে ২১.৫৬ গড়ে তাঁর অর্জন ১৫৮ উইকেট। ইকোনমি রেট মাত্র ৩.৩০। ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন ৫ বার। সেরা বোলিং ২৫ রানে ৫ উইকেট, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা।

উল্লেখ্য, ওয়ানডেতে কমপক্ষে ১৫০ উইকেট পাওয়া বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিং গড় হ্যাডলির (২১.৫৬)। 

স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ছিলেন তাঁর সময়ের সেরা হার্ডহিটারদের একজন। ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ব্যাট করেছেন মূলত লোয়ার অর্ডারে। তবে দলের প্রয়োজনে ধরেও খেলতে দেখা গেছে তাঁকে।

উইজডেনের ভাষায়, “His batting was the picture of simplicity. His idea was to hit it as hard as possible, and to choose the ball to whack after careful consideration.”

টেস্টে ব্যাট হাতে তাঁর সংগ্রহ ২৭.১৬ গড়ে ৩১২৪ রান। ২টি শতকের পাশাপাশি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন ১৫টি। 

এছাড়া ওয়ানডেতে ২১.৬১ গড়ে করেছেন ১৭৫১ রান। অর্ধশতক ৪টি। ক্যারিয়ার সেরা ৭৯ রান (৬৪ বলে), ১৯৮৩ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত মোট তিনটি বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছেন তিনি। বিশ্বকাপের ১৩ ম্যাচে তাঁর শিকার ২২ উইকেট; মাত্র ১৯.১৩ গড়ে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তাঁর ইকোনমি রেট মাত্র ২.৮৮! মেডেন ওভারের সংখ্যা ৩৮টি!

উল্লেখ্য, একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেটের ডাবল অর্জনকারী প্রথম ক্রিকেটার হলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। 

ডানহাতি বোলার, বাঁহাতি ব্যাটসম্যান স্যার রিচার্ড হ্যাডলি ছিলেন একজন জাত ম্যাচ উইনার। টেস্টে ১১ বার এবং ওয়ানডেতে ১০ বার ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। এছাড়া টেস্টে সিরিজসেরা হয়েছেন ৮ বার। তাঁর চেয়ে বেশিবার সিরিজসেরা হয়েছেন শুধুমাত্র মুত্তিয়া মুরালিধরন (১১ বার) এবং জ্যাক ক্যালিস (৯ বার)। 

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, হ্যাডলির অভিষেকের পূর্বে ১০২ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ৪৬টি হারের বিপরীতে জয় ছিল মাত্র ৭টি। আর হ্যাডলির খেলা ৮৬ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের ২৮ হারের বিপরীতে জয়ের সংখ্যা ২২টি। পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট, নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে সেরা ম্যাচ উইনার স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে হ্যাডলির ইম্প্যাক্ট কিংবা গুরুত্ব বোঝাতে এই একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট।

এ প্রসঙ্গে উইজডেন বলছে, “He single-handedly converted New Zealand from a bunch of faceless amateurs to a world class fighting unit.”

শুধু তাই নয়, এই ২২ ম্যাচে হ্যাডলির শিকার ১৭৩ উইকেট; মাত্র ১৩.০৬ গড়ে! উল্লেখ্য, জেতা ম্যাচে কমপক্ষে ১৫০ উইকেট নেওয়া বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিং গড়ের রেকর্ডটাও স্যার রিচার্ড হ্যাডলির দখলে। 

আরেকটা উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান হল, হ্যাডলির খেলা টেস্টসমূহে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের যত উইকেট পড়েছে তার ৩৬% একাই নিয়েছেন হ্যাডলি। আর জেতা ম্যাচে সেটা প্রায় ৪১%!

স্যার রিচার্ড হ্যাডলির প্রিয় প্রতিপক্ষ ছিল ট্রান্স-তাসমান প্রতিবেশী অস্ট্রেলিয়া। কিউইদের পুরনো শত্রু অজিদের বিপক্ষে মাত্র ২৩ টেস্টে তাঁর শিকার ১৩০ উইকেট; ২০.৫৬ গড়ে। ইনিংসে ৫ উইকেট ১৪ বার এবং ম্যাচে ১০ উইকেট পেয়েছেন ৩ বার। উইজডেনের ভাষায়, “When it comes to wrecking the psyche of Australia, there was none better than Sir Hadlee.”

মজার ব্যাপার হল, বল হাতে হ্যাডলির হোম রেকর্ডের তুলনায় অ্যাওয়ে রেকর্ডই বেশি সমৃদ্ধ। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ২০১ উইকেট নিতে উইকেটপ্রতি যেখানে তিনি খরচ করেছেন ২২.৯৬ রান, সেখানে নিউজিল্যান্ডের বাইরে ২৩০ উইকেট নিয়েছেন মাত্র ২১.৭২ গড়ে!

সাবকন্টিনেন্টের মরা উইকেটেও সফল ছিলেন স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। ১৩ ম্যাচে নিয়েছেন ৬৮ উইকেট; মাত্র ২১.৫৮ গড়ে। ম্যাচে ১০ উইকেট পেয়েছেন ২ বার।

সম্মাননাঃ

★ ১৯৮২ সালে উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার লাভ করেন,

★ ১৯৯০ সালে ক্রিকেটে বিশেষ অবদানের জন্য সম্মানসূচক 'নাইটহুড' উপাধি গ্রহণ করেন, 

★ ২০০২ সালে উইজডেন তাঁকে শতাব্দীর দ্বিতীয় সেরা বোলারের স্বীকৃতি প্রদান করে, 

★২০০৯ আইসিসির 'হল অফ ফেমের' গর্বিত সদস্যপদ অর্জন করেন।