ক্রিকেট লিজেন্ডস

গ্রায়েম পোলকঃ ব্যাটিং মহাবিদ্যালয়ের সেকেন্ড বয়

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 23:49 শুক্রবার, 27 এপ্রিল, 2018

পূর্ণাঙ্গ টেস্ট ক্যারিয়ার শেষে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যাটিং গড় কার? এ প্রশ্নের উত্তর সবারই জানা। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা হয়, দ্বিতীয় স্থানে কে আছেন? তাহলে অনেকে হয়ত বলবেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডাম ভোজেসের কথা। কিন্তু মিনিমাম ২০০০ রানের ক্রাইটেরিয়ার কথা মাথায় রাখলে উত্তরটা আসবে গ্রায়েম পোলক। ষাটের দশকের কিংবদন্তী এই ব্যাটসম্যান ২২৫৬ রান করেছেন ৬০.৯৭ গড়ে।

স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের চোখে ক্রিকেট ইতিহাসের 'সেরা' দুই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের একজন স্যার গ্যারি সোবার্স আর অন্যজন হলেন গ্রায়েম পোলক। 

অনেকের মতেই তিনি টেকনিক্যালি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচাইতে নিখুঁত বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। তাঁকে দক্ষিণ আফ্রিকার সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবেও মানেন অনেকেই। অথচ দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, সাবেক প্রোটিয়া অলরাউন্ডার শন পোলকের 'চাচা' গ্রায়েম পোলকের টেস্ট ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটেছিল মাত্র ২৬ বছর বয়সে। মাত্র ৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তিনি খেলতে পেরেছেন মোটে ২৩টা টেস্ট ম্যাচ যার সবকটিই ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। অবশ্য সেই অল্পসংখ্যক টেস্টেই নিজের অসামান্য ব্যাটিং প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন; নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন ক্রিকেটের সর্বকালের সেরাদের একজন হিসেবে।

আসল কারণটি না জানা থাকলে অবাকই হতে হয়, কেন মাত্র ২৩ টেস্টেই শেষ হয়ে গেল ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যানের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার? 

ক্রিকেটকে হয়তো আরও অনেক কিছুই দিতে পারতেন তিনি। কিন্তু ১৯৭০ সালে দেশটির সরকারের বিতর্কিত বর্ণবৈষম্য নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ আইসিসি তাদের সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৯১ সালে যখন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল, পোলকের বয়স তখন ৪৭। সেই বয়সে আর যাই হোক, ক্রিকেটে ফেরার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে প্রাপ্তির আনন্দের চেয়ে তাই অপ্রাপ্তির আক্ষেপটাই তাঁকে বেশি করে পোড়ায়। 

১৯৪৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি, ডারবান শহরের এক স্বনামধন্য ক্রিকেট পরিবারে জন্মেছিলেন গ্রায়েম পোলক; যে পরিবারের রক্তেই মিশে আছে ক্রিকেট! তাঁর পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে।

পোলকের বাবা অ্যান্ড্রু এবং চাচা রবার্ট প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অংশ নিয়েছেন 'অরেঞ্জ ফ্রি স্টেট' দলের হয়ে। এছাড়া তাঁর চাচাত ভাই পিটার পোলক এবং ভাতিজা শন পোলকও পরবর্তীতে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন টেস্ট ক্রিকেটে। গ্রায়েমের ছেলে অ্যান্থনি ও এন্ড্রুও ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট খেলেছেন ট্রান্সভালের হয়ে। 

ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা বাঁহাতি গ্রায়েম পোলক ছিলেন তাঁর সময়ের সবচাইতে প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। প্রায় সব প্রতিভাবান মানুষেরই বিশেষ কিছু যোগ্যতা থাকে। সেটা পোলকেরও ছিল। আর তা হল যেকোন মুহূর্তে বোলারদের ওপর আক্রমণ করার ক্ষমতা। সহজাত স্ট্রোক প্লেয়ার হওয়ায় রান বের করতে কখনও 'লুজ' বলের জন্য ওয়েট করতে হত না তাঁকে। বাজে বল, ভাল বল, সব বলেই মারতেন তিনি।

পোলকের ব্যাটিংয়ে স্ট্রং পয়েন্ট বলতে ছিল ভারসাম্যপূর্ণ বডি ব্যালান্স, দুর্দান্ত ফুটওয়ার্ক, চমৎকার রিস্টওয়ার্কের সাথে নিখুঁত টাইমিং।

তুলনামূলক ভারি ব্যাট ব্যবহার করা গ্রায়েম পোলকের প্রিয় শট ছিল কাভার ড্রাইভ। পাশাপাশি স্কয়ার কাট, অন ড্রাইভ আর পুল শটটাও দারুণ খেলতেন। 'লম্বা ফরোয়ার্ড স্ট্রাইড' আর 'এক্সটেন্ডেড রিচ' কাজে লাগিয়ে বলের 'পিচ অফ দ্য ডেলিভারি'তে চলে যেতে পারতেন অনায়াসেই। ফলে শরীর থেকে অনেক দূরের বলেও ড্রাইভ খেলতে কোন সমস্যাই হত না। 

আপরাইট' ব্যাটিং স্টান্স, হাই ব্যাকলিফটের সাথে টিপিক্যাল লেফট হ্যান্ডার্স এলিগেন্স! একবার কল্পনা করুন তো! চোখের সামনে স্টাইলিশ দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে কিনা!

বিখ্যাত ক্রীড়া সাহিত্যিক মার্টিন জেনকিন্স একবার বলেছিলেন, "Pollock  does not need a half-volley or a long hop to score fours: he will drive on the up, or cut, force and pull anything even fractionally short of a good length."

পোলকের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক মাত্র ১৬ বছর বয়সে, ইস্টার্ন প্রভিন্সের হয়ে। বর্ডারের বিপক্ষে অভিষেকেই হাঁকিয়েছিলেন ফিফটি (৬১), কাটা পড়েছিলেন রান আউটে।

ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে 'সাউথ আফ্রিকান' হিসেবে সর্বকনিষ্ঠ 'সেঞ্চুরিয়ান' ও 'ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের' কীর্তিটাও গ্রায়েম পোলকের দখলে। 

১৯৬২-৬৩ মৌসুমে ইস্টার্ন প্রভিন্সের হয়ে সম্মিলিত বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে হাঁকান ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি (২০৯)। বিপক্ষ দলটিতে ছিলেন রিচি বেনো, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জির মত খ্যাতিমান ক্রিকেটাররা। ১৮ বছরের 'তরুণ' গ্রায়েম পোলকের দুর্দান্ত ওই ইনিংসটি সম্পর্কে বেনোর বক্তব্য ছিল, "I knew I was watching a champion."

১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ব্রিসবেনের গ্যাবায় বৃষ্টিবিঘ্নিত এক ম্যাচে গ্রায়েম পোলকের টেস্ট অভিষেক, মাত্র ১৯ বছর বয়সে। গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জির বলে 'ক্লিন বোল্ড' হওয়ার আগে 'অভিষেক' ইনিংসে পোলকের ব্যাট থেকে আসে ২৫ রান; বাউন্ডারি মেরেছিলেন ৫টা।
এরপর রান পেলেন না মেলবোর্নে পরের টেস্টেও (১৬ ও ২ রান)।

সিডনিতে সিরিজের তৃতীয় টেস্টের আগে তাঁর বাদ পড়া নিয়ে একটা জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু প্রোটিয়া টিম ম্যানেজমেন্ট শেষ পর্যন্ত এই তরুণ তুর্কির ওপর ঠিকই আস্থা রেখেছিল। এবং ব্যাট হাতে গ্রায়েমও সেই আস্থার যথাযোগ্য প্রতিদান দিয়েছিলেন দারুণ এক সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে।

ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা করার দিন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর ৩১৭ দিন! যা টেস্টে এখনও পর্যন্ত কোন দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটসম্যানের পক্ষে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড। 

১৯ চার ও ২ ছক্কায় সাজানো পোলকের ১২২ রানের 'মনোমুগ্ধকর' ইনিংসটা মাঠে উপস্থিত সবাইকেই মুগ্ধ করেছিল। ম্যাচ শেষে স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যান নাকি তাঁকে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, "Next time you decide to play like that, send me a telegram".

সিরিজের শেষ ম্যাচটা হয়েছিল অ্যাডিলেডে। ওই ম্যাচেই এডি বারলোকে নিয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৩৪১ রানের 'রেকর্ড' পার্টনারশিপ গড়েন পোলক। বারলো হাঁকিয়েছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি (২০১) আর পোলকের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৭৫ রানের 'ঝকঝকে তকতকে' একটি ইনিংস। 

উল্লেখ্য, চমৎকার ওই পার্টবারশিপের সুবাদেই অস্ট্রেলিয়াকে ১০ উইকেটে হারিয়ে সিরিজে ১-১ সমতা আনতে সমর্থ হয়েছিল প্রোটিয়ারা।

বিদেশের মাটিতে অভিষেক সিরিজে গ্রায়েম পোলকের অর্জন ছিল ২ সেঞ্চুরিসহ ৫৭.০ গড়ে ৩৯৯ রান। 

১৯৬৪-৬৫ মৌসুমে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হোম সিরিজটা ২-১ ব্যবধানে হেরে গিয়েছিল প্রোটিয়ারা। সেখানে ব্যাট হাতে পোলকের অবদান ছিল ৫৭.৩৭ গড়ে ৪৫৯ রান। সেঞ্চুরি মাত্র ১টি হলেও পঞ্চাশ পেরিয়েছিলেন ৪ বার।

পোর্ট এলিজাবেথে সিরিজের শেষ ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১৩৭ রানের একটি 'ক্ল্যাসিক' ইনিংস খেলেছিলেন পোলক। উইজডেন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাকের চোখে ইনিংসটা ছিল এরকম, "A splendid century, distinguished by some majestic drives past cover and mid-on." 

১৯৬৫ সালে প্রথমবারের মত ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিলেন গ্রায়েম পোলক। ইংলিশ কন্ডিশনে সুইং সামলানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও লর্ডসে সিরিজের প্রথম টেস্টেই হাঁকিয়েছিলেন দারুণ এক ফিফটি (৫৬)। 

দ্বিতীয় ম্যাচটা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ট্রেন্টব্রিজে। সেখানকার উইকেট কিছুটা ভেজা থাকায় বলে প্রচুর মুভমেন্ট পাচ্ছিলেন সিমাররা। ডানহাতি পেসার থমাস কার্টরাইটের জোড়া আঘাতে ইনিংসের শুরুতেই দুই ওপেনারকে হারিয়ে বসে সফরকারীরা।

পোলক যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন, দলের স্কোর তখন ১৬/২। এরপর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকলে একসময় তাঁদের সংগ্রহ গিয়ে দাঁড়ায় ৮০/৫। 'পেস ফ্রেন্ডলি' কন্ডিশনে ইংলিশ সিমার ত্রয়ী 'কার্টরাইট-স্নো-লার্টার' রীতিমতো আগুন ঝরাচ্ছিলেন। সেখান থেকে অলআউট হবার আগপর্যন্ত দলের স্কোর ২৬৯ রানে নিয়ে যাওয়ার পুরো কৃতিত্বটা ছিল পোলকের। কার্টরাইট একাই নিয়েছিলেন ৬ উইকেট।

সিমিং উইকেটে ইংলিশ পেসারদের 'সুইং'য়ের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করে পোলক সম্ভবত তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসটা খেলেছিলেন ওইদিনই। 

১২৫ রানের 'মাস্টারক্লাস' ইনিংসটা খেলতে তিনি সময় নিয়েছিলেন ১৪০ মিনিট। যার শেষ ৯১ রান এসেছিল মাত্র ৭০ মিনিটে!

পোলকের 'ডমিনেটিং' ও 'কাউন্টার এটাকিং' স্টাইলের অনবদ্য ইনিংসটি সম্পর্কে বিখ্যাত ক্রীড়া সাংবাদিক জন উডকক তাঁর বইতে লিখেছেন, "Not since Bradman's day could anyone recall having seen an English attack treated in such cavalier style." 

দ্য টাইমস পত্রিকায় লিখেছিল, "I can think of no innings played against England since the Second World war which was so critical and commanding."

প্রথম ইনিংসে ১২৫ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসেও করেছিলেন ৫৯ রান । দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছিল ৯৪ রানে। ওই জয়ের সুবাদে সিরিজটাও শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল সফরকারী প্রোটিয়াদের ঘরেই (১-০)।

উল্লেখ্য, ওই একই ম্যাচে দু'ইনিংস মিলিয়ে বল হাতে ১০ উইকেট নিয়ে জয়ের মুহূর্তটাকে আরও স্মরণীয় করে রেখেছিলেন 'বড় ভাই' পিটার পোলকও। 

ব্যাট হাতে দুরন্ত পারফরম্যান্সের পুরস্কারস্বরূপ ১৯৬৬ সালে উইজডেন মনোনীত 'বর্ষসেরা ক্রিকেটারের' খেতাব জিতেছিলেন তিনি। উইজডেন এক বিবৃতিতে পোলক সম্বন্ধে লিখেছিল, "one of the most accomplished batsmen in contemporary cricket"

১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ খেলতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আসে বব সিম্পসনের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়া। 

জোহানেসবার্গে সিরিজের প্রথম টেস্টে ১২৬ রানে পিছিয়ে থেকেও দ্বিতীয় ইনিংসে ৬২০ রান তুলেছিল স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা। জিতেছিল ২৩৩ রানের বড় ব্যবধানে।

'উইকেটকিপার' ডেনিস লিন্ডসের 'অনবদ্য' ১৮২ রানের পাশাপাশি ওই ম্যাচে গ্রায়েম পোলকের ব্যাট থেকে আসে ১০৪ বলে ৯০ রানের দাপুটে এক ইনিংস। যে ইনিংস সম্পর্কে উইজডেন সাময়িকীতে রিপোর্ট এসেছিল, "His timing, placing and wristwork were an object lesson for the purist."

কেপটাউনে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে হাঁকান টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি (২০৯)। ফলোঅনে পড়ে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ৬ উইকেটে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

সিরিজের শেষ ম্যাচেও সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন গ্রায়েম পোলক। তাঁর সেঞ্চুরিতে ভর করেই ৭ উইকেটে ম্যাচ জিতেছিল প্রোটিয়ারা; আর সেই সাথে সিরিজটাও (৩-১) নিজেদের করে নিয়েছিল।

পাঁচ ম্যাচে ৭৬.৭১ গড়ে ৫৩৭ রান করে সিরিজের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক হয়েছিলেন গ্রায়েম পোলক; দুই সেঞ্চুরি আর দুই ফিফটির সৌজন্যে।

১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলা হোম সিরিজটাই ছিল পোলকের ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ। 

কেপটাউনে সিরিজের প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসে করেছিলেন ৪৯ ও ৫০ রান। কিন্তু ডারবানে অনুষ্ঠিত পরের টেস্টেই ২৭৪ রানের 'কালজয়ী' এক ইনিংস খেলে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। ৪০১ বলে ২৭৪ রানের 'ক্যারিশম্যাটিক' ইনিংসটাতে বাউন্ডারি ছিল ৪৩টা! ওই ইনিংসের সুবাদেই দক্ষিণ আফ্রিকা  জিতেছিল এক ইনিংস ও ১২৯ রানের ব্যবধানে।

জোহানেসবার্গে সিরিজের তৃতীয় টেস্টের দুই ইনিংসেও খেলেন ৫২ ও ৮৭ রানের কার্যকরী দুটো ইনিংস। ৩০৭ রানের বিশাল জয় তুলে নেয় প্রোটিয়ারা। 

চতুর্থ ও শেষ টেস্টে ব্যাট হাতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হলেও (১ ও ৪) ব্যারি রিচার্ডসের ১২৬ ও ৮১ রানের 'দুটো' অসাধারণ ইনিংসের সৌজন্যে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছিল ৩২৩ রানের বড় ব্যবধানে। 

চার ম্যাচে ৭৩.৮৬ গড়ে ৫১৭ রান করে 'আরও একবার' সিরিজের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী হয়েছিলেন গ্রায়েম পোলক। অস্ট্রেলিয়াকে ৪-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা।

নিজেদের মাটিতে 'একপেশে' সিরিজে প্রতিপক্ষের ওপর রীতিমত 'স্টিম রোলার' চালিয়েছিল প্রোটিয়ারা। গ্রায়েম পোলক, পিটার পোলক, মাইক প্রোক্টর, ব্যারি রিচার্ডস, এডি বারলো, আলী ব্যাখার, লি আর্ভাইন, ডেনিস লিন্ডসেদের নিয়ে গড়া দক্ষিণ আফ্রিকার তখনকার দলটা ঠিক কতটা শক্তিশালী ছিল সেটা কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। ইয়ান চ্যাপেল, বিল লরি, ইয়ান রেডপ্যাথ, ডাগ ওয়াল্টার্স, গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি, অ্যাশলি ম্যালেটদের মত তারকাসমৃদ্ধ অস্ট্রেলিয়াও যাদের সামনে খড়কুটোর মত উড়ে গিয়েছিল!

ওই সিরিজের ঠিক পরপরই দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের বিতর্কিত বর্ণবাদনীতির বিরুদ্ধে শাস্তিস্বরূপ ক্রিকেট থেকে দেশটির ওপর ২২ বছরের নির্বাসন জারি করে আইসিসি।

বর্ণবাদের ভয়াল থাবায় জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল গ্রায়েম পোলকসহ আরও অনেক প্রতিভাবান দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটারের ভবিষ্যত। ষাটের দশকের প্রোটিয়া দলটির মতো হতভাগ্য 'দল' ক্রিকেট ইতিহাসে আর ক'টাই বা ছিল বলুন!

১৯৬০ সালে শুরু, ১৯৮৭ সালে শেষ। দীর্ঘ ২৭ বছরের ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ার! ২৬২ টি প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে গ্রায়েম পোলকের সংগ্রহ ৫৪.৬৭ গড়ে ২০,৯৪০ রান। ৬৪টি সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি আছে ৯৯ টি। 

ইংলিশ কাউন্টির বিভিন্ন ক্লাব থেকে জীবনে বহুবার খেলার প্রস্তাব পেয়েছেন কিন্তু প্রতিবারই তাঁর উত্তর ছিল 'না'।

কাউন্টি না খেললেও সাউথ আফ্রিকায় 'বিদ্রোহী ট্যুরে' আসা বিভিন্ন দলের বিপক্ষে খেলেছেন ১৬টি আন-অফিশিয়াল টেস্ট। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলংকার বিপক্ষে সেসব ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৬৫.৫২ গড়ে ১৩৭৬ রান। 

ফার্স্ট ক্লাসের পাশাপাশি কীর্তিমান এই বাঁহাতি ব্যাট হাতে আলো ছড়িয়েছেন ঘরোয়া সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও। ১১৯ টি 'লিস্ট এ' ম্যাচে ৫১.৪৮ গড়ে করেছেন ৪৭৮৮ রান। ১৩টি সেঞ্চুরির সাথে ফিফটি আছে ২৫টি। 

উল্লেখ্য, আইসিসি স্বীকৃত লিস্ট 'এ' ক্রিকেটের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ান হলেন গ্রায়েম পোলক। এ রেকর্ডটির কথা হয়ত অনেকেই জানে না। আজ থেকে ৪২ বছর আগে সেই ১৯৭৪-৭৫ মৌসুমে ইস্টার্ন প্রভিন্সের হয়ে বর্ডারে বিপক্ষে একটি সীমিত ওভারের ম্যাচে করেছিলেন ২২২ রান।

টেস্ট ইতিহাসে চার নম্বর পজিশনে সেরা ব্যাটিং গড়ের অধিকারী ব্যাটসম্যানদের তালিকায় শীর্ষে থাকা এভারটন উইকসের (৬৩.৬২) ঠিক পরের স্থানটিতেই আছেন গ্রায়েম পোলক। ব্যাটিং অর্ডারের ৪ নম্বর পজিশনে খেলা ৩৭ ইনিংসে পোলকের মোট রান ২০৬৫; গড় ৬২.৫৮।

১৯৯৯ সালে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটার মনোনীত হন গ্রায়েম পোলক।

এরপর ২০০৯ সালে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আইসিসি ক্রিকেট 'হল অব ফেমে'।

কিন্তু তাতে কি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা লম্বা করতে না পারার আক্ষেপ ঘুচবে তাঁর?

শেষ করব মজার একটি তথ্য দিয়ে। ছেলেবেলায় গ্রায়েম পোলকের বেশ মজার একটা ডাকনাম ছিল 'লিটল ডগ'। আর তিন বছরের বড় পিটারের ডাকনাম ছিল 'বিগ ডগ'।