বিদায় মরনে

মরনে মরকেলঃ পার্শ্বনায়কদের নায়ক

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 20:55 বুধবার, 04 এপ্রিল, 2018

তাঁকে বলা যেতে পারে সাউথ আফ্রিকান ক্রিকেটের 'আনসাং হিরো'। তিনি হয়ত জেনুইন উইকেট টেকার ছিলেন না তাই সেভাবে লাইমলাইটের নিচে আসতে পারেন নি কখনও, কিন্তু নীরবে নিভৃতে সবার অন্তরালে ঠিকই নিজের দায়িত্বটুকু পালন করে গেছেন। দলের প্রয়োজনে কখনও হাতে তুলে নিয়েছেন নতুন বল, কখনওবা এসেছেন চেঞ্জ বোলার হিসেবে। তবে ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে থার্ড সিমারের ভূমিকা। প্রয়োজনের মুহূর্তে দলকে কাঙ্খিত ব্রেকথ্রু যেমন এনে দিয়েছেন, তেমনি শর্টার ফরম্যাটে ডেথ ওভারে বোলিংয়ের গুরুদায়িত্বটাও সামলেছেন কৃতিত্বের সাথে।

অভিষেক টেস্টে ছিলেন শন পোলক, মাখায়া এনটিনি, আন্দ্রে নেলের মত সিনিয়রদের ছায়া হয়ে। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্টে এসেও তিনি 'সিরিজসেরা' কাগিসো রাবাদা, 'ম্যাচসেরা' ভারনন ফিল্যান্ডারদের ছায়া হয়েই থেকেছেন।

সমগ্র ক্যারিয়ারটাও তো কেটেছে একরকম 'পার্শ্বনায়কের' ভূমিকাতেই, 'নায়ক' আর হতে পারলেন কই! ক্যারিয়ারজুড়ে অসংখ্যবার যে তারকাদ্যুতিতে তাঁকে ম্লান করে দিয়েছেন তাঁরই সতীর্থ 'সময়ের সেরা' ফাস্ট বোলার ডেল স্টেইন! ঠিক সে কারণেই হয়ত প্রোটিয়াদের জার্সি গায়ে কখন যে তিনি 'এক যুগ' কাটিয়ে দিয়েছেন, বোঝাই যায় নি! 

বলছিলাম সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানো 'সদ্য সাবেক' ডানহাতি পেসার মরনে মরকেলের কথা। ক্ল্যাসিক 'হিট দ্য ডেক' বোলিংকে রীতিমতো শিল্পে পরিণত করেছিলেন যিনি। শারীরিক উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে যেকোন উইকেট থেকে বাড়তি বাউন্স ও ক্যারি আদায় করতে পারতেন ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা দীর্ঘদেহী এই প্রোটিয়া ফাস্ট বোলার। বিষাক্ত সুইং কিংবা বিধ্বংসী গতি নয়; ব্যাটসম্যানকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য গুড লেংথ থেকে আচমকা লাফিয়ে ওঠা মরকেলের ১৪০ কিমি গতির ডেলিভারিগুলোই ছিল যথেষ্ট। শার্প বাউন্সের সাথে যোগ করুন সহায়ক পিচ ও কন্ডিশনকে কাজে লাগিয়ে পাওয়া ল্যাটেরাল সিম মুভমেন্ট। মরকেলের দৈত্যাকার শরীর নিয়ে আঁটোসাঁটো লাইনের বোলিং, গুড লেন্থ থেকে অস্বাভাবিকভাবে বলকে লিফট করানোর ক্ষমতা, রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের ব্যবহার, বাউন্সার আর লেট সুইংয়ের সামনে নতজানু হন নি, এমন ব্যাটসম্যান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় নেই বললেই চলে।

একপ্রান্ত থেকে লম্বা স্পেলে বোলিং করে ব্যাটসম্যানদের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে গেছেন মরকেল আর অন্যপ্রান্ত থেকে উইকেট নিয়েছেন সতীর্থরা। অধিনায়ক ফাফ ডু প্লেসি যথার্থই বলেছেন, “Morne has almost been, for the most of the time of his career gone unnoticed. He was the work horse. He regularly got his two or three-fors and I should really appreciate for what Morne did for his team.”

চলুন এক নজরে দেখে নিই মরনে মরকেলের প্রোফাইল, পরিসংখ্যান ও বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার হাইলাইটস।

#প্রোফাইলঃ

★ পুরো নামঃ মরনে মরকেল
★ জন্মঃ ৬ অক্টোবর, ১৯৮৪, ভেরিনিগিং, ট্রান্সভাল 
★ উচ্চতাঃ ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি (১.৯৬ মিটার)
★ ডাকনামঃ মোরাস, হেইডোস, লবস্টার
★ ব্যাটিং স্টাইলঃ বামহাতি 
★ বোলিং স্টাইলঃ ডানহাতি ফাস্ট
★ প্রধান দলসমূহঃ দক্ষিণ আফ্রিকা (২০০৬-২০১৮), ইস্টার্ন প্রভিন্স, টাইটান্স, কেন্ট, ইয়র্কশায়ার, রাজস্থান রয়্যালস, দিল্লি ডেয়ারডেভিলস, কলকাতা নাইট রাইডার্স, সেন্ট লুসিয়া জুকস
★ জার্সি নাম্বারঃ ৬৫
★ পরিবারঃ বাবা অ্যালবার্ট মরকেল, মা মারিয়ানা মরকেল, বড় দুই ভাই মালান মরকেল ও অ্যালবি মরকেল, স্ত্রী রোজ কেলি, পুত্র অ্যারিয়াস ফ্লিন মরকেল। 

#পরিসংখ্যানঃ

★ ৮৬ টেস্টে ৩০৯ উইকেট। বোলিং গড় ২৭.৬৬। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৮ বার, ৪ উইকেট ১৮ বার। সেরা বোলিং ২৩ রানে ৬ উইকেট।

★ ১১৭ ওয়ানডেতে ১৮৮ উইকেট। বোলিং গড় ২৫.৩২। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ২ বার, ৪ উইকেট ৭ বার। সেরা বোলিং ২১ রানে ৫ উইকেট।

★ ৪৪ টি২০ ম্যাচে ৪৭ উইকেট। বোলিং গড় ২৫.৩৪। ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়েছেন ২ বার। সেরা বোলিং ১৭ রানে ৪ উইকেট।

#ক্যারিয়ার_হাইলাইটসঃ

★ ২০০৬ সালে ডারবানের কিংসমিডে ভারতের বিপক্ষে 'বক্সিং ডে' টেস্ট দিয়ে মরকেলের আন্তর্জাতিক অভিষেক। দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের ৩০০ তম টেস্ট ক্যাপটা মাথায় উঠেছিল তাঁর। অভিষেক টেস্টে বল করেছিলেন এক ইনিংসে, আর তাতে ৬৮ রান খরচায় নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। সাদা পোশাকের ক্যারিয়ারে তাঁর প্রথম শিকার ছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। 

★ ৬ জুন, ২০০৭ তারিখে মরকেলের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক, আফ্রো-এশিয়া কাপ সিরিজে আফ্রিকা একাদশের হয়ে এশিয়া একাদশের বিপক্ষে। টেস্টের মত ওডিয়াই অভিষেকেও বল হাতে শিকার করেছিলেন ৩ উইকেট। 

পরের ম্যাচেই বড় ভাই অ্যালবি মরকেলকে সাথে নিয়ে বোলিং উদ্বোধন করেন তিনি, যা ওয়ানডে ইতিহাসে প্রথমবারের মত দুই ভাইয়ের একসাথে বোলিং ওপেন করার 'বিরলতম' ঘটনা।

★ ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড টুয়েন্টি২০ চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধনী আসরে দারুণ বোলিং করেছিলেন মরনে। ৫ ম্যাচে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট; বোলিং গড় ১৩.৩৩, ইকোনমি রেট ৬.০০। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ১৭ রানের বিনিময়ে ৪ উইকেট নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত জিতেছিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

★ অভিষেকের প্রায় দেড় বছর পর ২০০৮ সালে মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বিপক্ষে খেলতে নামেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট। টেস্টে প্রথমবারের মত ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেন সেই ম্যাচেই। বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৫০ রানের বিনিময়ে তুলে নেন ৫ উইকেট। মরকেলের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে ধরাশায়ী হয়ে সেদিন একে একে প্যাভিলিয়নে ফেরত গিয়েছিলেন হাবিবুল বাশার, শাহরিয়ার নাফীস, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও মোহাম্মদ রফিক।

★ ২০০৯-২০১০ সিজনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ নির্ধারণী শেষ টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে মরকেলের শিকার ছিল ৭ উইকেট (৩/৩৯ ও ৪/৫৯); দলকে এনে দিয়েছিলেন অবিস্মরণীয় এক জয়। টেস্ট ক্যারিয়ারে সেবারই প্রথমবারের মত অর্জন করেন ম্যাচসেরার স্বীকৃতি। 

★ ২০১০ সালে আবুধাবি টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ উইকেট জুটিতে এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিয়ে গড়েছিলেন ১০৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি; যা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে ১০ম উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড।
★ ২০১০ সালে আবুধাবি টেস্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ উইকেট জুটিতে এবি ডি ভিলিয়ার্সকে নিয়ে গড়েছিলেন ১০৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি; যা দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে ১০ম উইকেটে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড। ৫ বাউন্ডারির সাহায্যে মরকেল অপরাজিত ছিলেন ৩৫ রানে, আর ডি ভিলিয়ার্স খেলেছিলেন ২৩ চার ও ৬ ছক্কায় সাজানো ২৭৮* রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস।

★ ২০১১ সালে পোর্ট এলিজাবেথে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাত্র ২২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথমবারের মত অর্জন করেছিলেন ম্যাচসেরা হবার গৌরব।

★ ২০১১ সালেই প্রথমবারের মত পেয়েছিলেন আইসিসির ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ বোলারের স্বীকৃতি।

★ ২০১২ সালে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত ৫ উইকেট পেয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কে স্বাগতিকদের বিপক্ষে মাত্র ৩৮ রান খরচায় ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন তিনি; প্রোটিয়ারা হেসেখেলে জিতেছিল ৬ উইকেটের ব্যবধানে।

★ মরকেলের টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং ফিগারটি এসেছিল ২০১২ সালে ওয়েলিংটনে বেসিন রিজার্ভে, স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। মাত্র ২৩ রানে তুলে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ড্র হলেও ম্যাচসেরা হয়েছিলেন মরনে মরকেল।

★ ১৬ নভেম্বর, ২০১৪ তারিখে পার্থের ওয়াকায় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মরকেল গড়েন তাঁর ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। ২১ রানে ৫ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। সেই ম্যাচে মরকেলের অসাধারণ বোলিং নৈপুণ্যেই ৩ উইকেটের রুদ্ধশ্বাস এক জয় পেয়েছিল সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকা।

★ দেশের হয়ে একটা বৈশ্বিক শিরোপা জেতার স্বপ্নটা তাঁর চিরকালই অধরা থেকে যাবে। যার সর্বোচ্চ প্রয়াসটুকু তিনি চালিয়েছিলেন ২০১৫ বিশ্বকাপে; অর্জন করেছিলেন বিশ্বকাপের এক আসরে প্রোটিয়াদের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড। ৮ ম্যাচ খেলে ১৭.৫৯ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট।

কিন্তু অকল্যান্ডের সেমিফাইনালে ৪ উইকেটে হেরে জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল বিশ্বকাপ স্বপ্ন। দলের সেরা বোলার হয়েও সইতে হয়েছিল পরাজয়ের গ্লানি, বিদায় নিতে হয়েছিল চোখের জলে।

★ মরকেলের টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা ম্যাচ ফিগারটি এসেছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে। কেপটাউন টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে মরকেল পেয়েছিলেন ৯ উইকেট (৮৭/৪ ও ২৩/৫)। প্রোটিয়ারা জিতেছিল ৩২২ রানের বিশাল ব্যবধানে।

বয়স সবে তেত্রিশ পেরিয়েছে, খেলা চালিয়ে যেতে পারতেন আরও বেশ কিছুদিন। অনায়াসে আগামী বিশ্বকাপটাও খেলে যেতে পারতেন চাইলেই। কিন্ত একমাস আগেই অকস্মাৎ ঘোষণায় জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সদ্য সমাপ্ত টেস্ট সিরিজটাই হতে চলেছে তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক সিরিজ।

সিরিজ শুরু করেছিলেন ৮৩ টেস্টে ২৯৪ উইকেট নিয়ে; থামলেন ৮৬ টেস্টে ৩০৯ উইকেটে। ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়ে ৩ এপ্রিল শেষ হওয়া জোহানেসবার্গ টেস্টে অর্জন মাত্র ৩ উইকেট। বিদায়বেলাটা রাঙিয়ে যেতে না পারলেও ক্যারিয়ারের শেষ সিরিজ, শেষ ম্যাচে মাঠ ছেড়েছেন বিজয়ীর বেশে, একমাত্র সান্ত্বনা বোধহয় এটাই।

২০০৬ সালে অভিষিক্ত মরকেলের শুরুটা হয়েছিল শূন্য থেকে। ২০১৮ সালে এসে আজ যখন বিদায় নিচ্ছেন, ক্রিকেটের তিন সংস্করণ মিলিয়ে তিনি ৫৪৪ উইকেটের মালিক; প্রোটিয়া টেস্ট ইতিহাসের ৫ম আর ওয়ানডে ইতিহাসের ৬ষ্ঠ সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বোলার।

গুডলাক এন্ড গুডবাই, মরনে মরকেল।

সত্যি বলছি, খুউব....খুউব মিস করব আপনাকে।