বাংলাদেশ ক্রিকেট

মানুষকে বুঝতে হবে আমরা পক্ষপাতিত্ব করতে পারব না: শরফুদ্দৌল্লা

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক
প্রকাশের তারিখ: 20:57 বৃহস্পতিবার, 28 মার্চ, 2024

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

আইসিসির এলিট প্যানেলে বাংলাদেশের কেউ না থাকাটা আক্ষেপ হয়ে ছিল লম্বা সময় ধরেই। অবশেষে সেই আক্ষেপ ঘুচেছে শরফুদ্দৌল্লা ইবনে শহীদ সৈকতের কল্যাণে। বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে যুক্ত হয়েছেন সাবেক এই বাঁহাতি স্পিনার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইসিসির বিভিন্ন টুর্নামেন্ট এবং দ্বিপাক্ষিক সিরিজে নিজের যোগ্যতা প্রমাণের ফলই পেলেন শরফুদ্দৌল্লা।

নব্বই দশকে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলেছেন শরফুদ্দৌল্লা। ১৯৮৯-৯০ সালে নবম শ্রেণিতে পড়তেন সাবেক এই স্পিনার। সেই তরুণ বয়সেই সূর্যতরুণের জার্সিতে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে অভিষেক হয় তার। এসএসসি পাশ করার পর জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ১৯৯৪ সালে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের আসর আইসিসি ট্রফিতে খেলেছিলেন শরফুদ্দৌল্লা।

যদিও সেবার বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব পেরিয়ে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। এদিকে জাতীয় দলের হয়ে অধিনায়ক থাকার সময়ই অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েও খেলেছেন শরফুদ্দৌল্লা। সবমিলিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ১৭ থেকে ১৮ বছর খেলেছেন সাবেক এই বাঁহাতি স্পিনার। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১০ ম্যাচে শরফুদ্দৌল্লার শিকার ৩১ উইকেট। তবে পিঠের চোটের কারণে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হয় তাকে। ঘরোয়া কিংবা জাতীয় দলে খেললেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয়নি ৪৭ বছর বয়সি এই আম্পায়ারের। চোটের কারণে পরবর্তীতে চাকরি কিংবা পড়াশোর কথা ভাবলেও শেষ পর্যন্ত আম্পায়ারিংয়ে আসেন তিনি।

নিজের ক্রিকেট ক্যারিয়ারের কথা বলতে গিয়ে শরফুদ্দৌল্লা বিসিবির ভিডিওতে বলেন, ‘আমি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলতে আসি ১৯৮৯-৯০ সালে যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। প্রিমিয়ার লিগে আমার প্রথম ম্যাচ সূর্যতরুণের হয়ে খেলি। তারপর যখন আমি এসএসসি পাশ করলাম বাংলাদেশ দলে খেলি ১৯৯২ সালে। এখন চিন্তা করলে মনে হয় ৩০ বছরের বেশি, তখন অনেক ছোট ছিলাম। স্কুল পাশ করে আমি সার্ক ক্রিকেটে খেলি, ১৯৯৪ সালে আমি আইসিসি ট্রফিতে খেলি। যেখানে আমরা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারিনি।

‘মজার বিষয় হচ্ছে, জাতীয় দলের হয়ে খেলার পর আমি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলি যখন আমি অধিনায়ক ছিলাম বাংলাদেশ দলের আরকি। তো খুব বেশি চালিয়ে যেতে পারিনি কিন্তু প্রিমিয়ার লিগ খেলেছি প্রায় ১৭-১৮ বছর। প্রথম শ্রেণি খেলেছি একটা সিরিজ ওই যে পিঠের চোটের জন্য। পরে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি হয়তবা চাকরি করব, পড়াশোনো। পরে যেটা হলো আম্পায়ারিংয়ে আসলাম।’

১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করলেও সেই দলে ছিলেন না শরফুদ্দৌল্লা। চোটের কারণে সেবার খেলা হয়নি তার। চোট ক্রমশই ঝামেলা পাকাতে থাকায় ক্রিকেটের বাইরের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবতে থাকেন সাবেক এই বাঁহাতি এই স্পিনার। শুরুতে কোচিং করানোর কথা ভাবলেও পরবর্তীতে শরীরের ওপর চাপ পড়তে পারে এমন ভাবনা থেকে সরে আসেন শরফুদ্দৌল্লা।

এরপরই মূলত আম্পায়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখেন ৪৭ বছর বয়সি এই আম্পায়ার। সেই সময় শরফুদ্দৌল্লার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ একদিন টেস্ট স্ট্যাটাস পাবে এবং তারা সেখানে আম্পায়ারিং করবেন। ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর স্বপ্ন ছোঁয়ার সুযোগ তৈরি হয় তার। বিশ্বকাপে আম্পায়ারিংয়ের স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা শরফুদ্দৌল্লা ২০০৬ সাল থেকেই আছেন আইসিসির ইন্টারন্যাশনাল প্যানেলে।

আম্পায়ারিংয়ে আসার শুরুর গল্প বলতে গিয়ে শরফুদ্দৌল্লা বলেন, ‘আসলে ‍শুরুটা হয় যখন আমরা ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপের জন্য কোয়ালিফাই করি। আমি ১৯৯৪ সালে আইসিসি ট্রফিতে ছিলাম, ওইবার আমরা কোয়ালিফাই করতে পারিনি। তখন থেকে আমার একটা ইনজুরি ছিল, ৯৭ সালে কোয়ালিফাই করার জন্য আমি দলে না থাকায় একটা দুঃখের কারণ ছিল।’

‘যেহেতু বিশ্বকাপ খেলা হবে না তখন চিন্তা করলাম যদি ক্রিকেট না খেলতে পারি তাহলে কী করা যায়। কোচিং করব চিন্তা করলাম কিন্তু ওইটা একটা শারীরিক চাকরি ছিল। তখন চিন্তা করলাম হয়তবা বাংলাদেশ একদিন টেস্ট স্ট্যাটাস পাবে আমরা হয়ত টেস্ট আম্পায়ার হতে পারব, বিশ্বকাপে আম্পায়ারিং করতে পারব। ওই চিন্তা থেকেই আম্পায়ারিংয়ে আসা।’

ঘরোয়া ক্রিকেটে আম্পায়ারিং করলেও শরফুদ্দৌল্লা প্রথমবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাঠে নামেন ২০১০ সালে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতকে নিয়ে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে অভিষেক হয় তার। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার ওয়ানডে ম্যাচে শরফুদ্দৌল্লা সাথে অনফিল্ড আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন আইসিসির বর্ষসেরা সাইমন টাফেল। প্রথম ম্যাচে পেসারদের জোরে বোলিং করতে দেখে ভড়কে গিয়েছিলেন শরফুদ্দৌল্লা। পরবর্তীতে সেটা মানিয়ে নিলেও একেবারে সহজ যে ছিল না সেটা জানিয়েছেন তিনি নিজেই।

আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথমবার আম্পায়ারিংয়ের অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণে শরফুদ্দৌল্লা বলেন, ‘একদমই মনে আছে। আমার খুব পছন্দের আম্পায়ার ছিল সাইমন টাফেল। তখন আইসিসির আম্পায়ার অব দ্য ইয়ার হয়। সেটা ২০১০ সালে শ্রীলঙ্কার সাথে, খুব সম্ভবত ৮ ই জানুয়ারি। মিরপুরে শ্রীলঙ্কার সাথে একটা ত্রিদেশীয় সিরিজ ছিল বাংলাদেশ-ভারত। ওইখানে আমার প্রথম অভিষেক হয়।

‘প্রথম দুটো ম্যাচে আমি সাইমন টাফেলের সঙ্গে আম্পায়ারিং করি। খুবই এক্সাইটমেন্ট ছিল। যখন আমি দাঁড়ালাম প্রথম ম্যাচে দেখলাম বোলার যে জোরে বোলিং করছে, অনেক জোরে বোলিং করছে। মনে হচ্ছে ওই বলটা আমি ফেস করিনি ঘরোয়া ক্রিকেটে। এটা আমার কাছে মানিয়ে নেয়া একটু কঠিন ছিল। ’

চলতি বছরে নিজের সাফল্যের মোড়কে আরও একটি পালক যোগ করেছেন শরফুদ্দৌল্লা। এনামুল হক মনির পর বাংলাদেশের প্রথম আম্পায়ার হিসেবে দেশের বাইরে টেস্ট ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সবশেষ অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে অনফিল্ড আম্পায়ারদের একজন ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক এই বাঁহাতি স্পিনার। এখন পর্যন্ত ১০ টেস্ট, ৬৩ ওয়ানডে ও ৪৫ টি-টোয়েন্টি পরিচালনা করেছেন দেশের এই আম্পায়ার।

দ্বিপাক্ষিক সিরিজ ছাড়াও আইসিসির টুর্নামেন্টে আম্পায়ারিং করার অভিজ্ঞতা আছে শরফুদ্দৌল্লার। ২০১৭ ও ২০২১ নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০১৮ নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং সবশেষ ২০২৩ সালে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠেয় ওয়ানডে বিশ্বকাপে অনফিল্ড আম্পায়ারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলের ম্যাচে আম্পায়ারিং করলেও বাংলাদেশের ম্যাচে বেশি চাপ দেখেন শরফুদ্দৌল্লা।

বাংলাদেশের অনেক ম্যাচের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক এই স্পিনার। দেশের ম্যাচে আম্পায়ারিং করলেও সমর্থকরা বাংলাদেশের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়ার প্রত্যাশা করেন বলে জানান তিনি। দায়িত্বের জায়গা থেকে এমনটা করা সম্ভব নয় শরফুদ্দৌল্লার কাছে। অনেক সময় অনেক সিদ্ধান্ত দেশের বিপক্ষে গেলে তোপের মুখে পড়তে হয় আম্পায়ারদের। যদিও মানুষের ধারণা বদলে যেতে শুরু করেছে বলে বিশ্বাস তার। সেই সঙ্গে আম্পায়ারিং যে কঠিন একটা চাকরি সেটাও মনে করিয়ে দিয়েছেন শরফুদ্দৌল্লা।

আইসিসির এলিট প্যানেলে জায়গা পাওয়া ৪৭ বছর বয়সি এই আম্পায়ার বলেন, ‘এখানে আম্পায়ারিং করাটা আসলে চাপের হয়ে যায়। আমরা তো ক্রিকেট পাগল জাতি। সবাই চায় দেশটা জিতুক, দলটা জিতুক, আমরাও চাই দিনশেষে। কিন্তু আমাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে যে আমরা যখন মাঠে যাই তখন আমাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। আমরা কখনই পক্ষপাতিত্ব করতে পারব না। দিনশেষে বাংলাদেশ দল জিতলে আমাদেরও খুশি লাগে।’

‘আমি নিজেও বাংলাদেশি, বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলেছি, ম্যাচ জিতলে হয়তবা আমাদেরও খুশি লাগে। মানুষ হয়ত খুশি হয় না হয়ত আমাদের এরর অব জাজমেন্ট হয়। এটা আমাদের জীবনের, আম্পায়ারিংয়ে এবং ক্রিকেটের অংশ। এটা মানুষের মেনে নিতে হবে। মানুষের আস্তে আস্তে ধারণাটা পরিবর্তন হচ্ছে যে আম্পায়ারিং একটা কঠিন চাকরি। এটা মানতে হবে যে আম্পায়ারও মানুষ, আম্পায়ারও ভুল করে। এটাই স্বাভাবিক।’