বাংলাদেশ ক্রিকেট

শান্ত-লিটনের ভুল শুধরানো, হাথুরুসিংহের গোল মিটিং ও পাঁচ ঘণ্টা

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 22:16 শুক্রবার, 24 ফেব্রুয়ারি, 2023

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

মিডল অ্যান্ড লেগ স্টাম্পে পায়ের কাছের কয়েকটি বল সোজা ব্যাটে ডিফেন্স করেন লিটন দাস। ডাগ আউটে দাঁড়িয়ে তা দেখছিলেন চান্দিকা হাথুরুসিংহে। বাংলাদেশের প্রধান কোচের চেহারা দেখে অনুমান করা যাচ্ছিলো লিটনের এমন ডিফেন্সে সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না তিনি। এদিন প্রস্তুতি ম্যাচ না থাকলেও ম্যাচ আবহে শিষ্যদের অনুশীলন করেছেন হাথুরুসিংহে। প্রথম ৬ ওভারের ব্যাটিং শেষ করে ড্রেসিংরুমে ফেরার পর লিটনকে ডেকে নিলেন লঙ্কান এই কোচ।

লিটনও সাড়া দিয়ে চলে গেলেন হাথুরুসিংহের ক্লাসে। প্রায় মিনিট ত্রিশের সেশনে উইকেটে থাকাকালীন কি ভুল করেছেন লিটন, কোন দিকে বা কোন ভঙ্গিতে খেললে বাড়তি রান আসতো তা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখান লঙ্কান এই কোচ। লিটন-হাথুরুসিংহের ক্লাস চলাকালীন দ্বিতীয়ভাগে সে সময় ব্যাট করছিলেন নাজমুল হোসেন শান্ত ও তৌহিদ হৃদয়। কিন্তু কয়েক ওভার পরই তাইজুল ইসলাম ফিরতি ক্যাচ দিয়ে বসেন শান্ত।

তার আউটে ফের উইকেটে যান তামিম ইকবাল, ডাগ আউটে এসে লিটন-হাথুরুসিংহের সঙ্গে যোগ দেন বাঁহাতি এই ওপেনারও। এই তিনজনের মিটিংয়ে এসে যোগ দেন জেমি সিডন্স। লিটনের মতো শান্ত কোথায় ভুল শট খেলেছেন, বল বলে সামনের পায়ের জায়গায় পেছনের পা ব্যবহার করেছেন তা ব্যাট হাতে নিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলেন হাথুরুসিংহে। এক পর্যায়ে শান্ত থেকে ব্যাট নিয়ে সিডন্স শ্যাডো করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কি ভুল হয়েছে। তবে শান্তর চেয়ে হাথুরুসিংহে বাড়তি সিরিয়াস ছিলেন লিটনকে নিয়েই।

পাঁচ ঘণ্টার ম্যাচ আবহে ছয়টি সেশনে হাথুরুসিংহের ছিল তীক্ষ্ণ নজর। পুরো অনুশীলনে ড্রেসিংরুমে যাননি একবারও। ডাগআউটের সামনে চেয়ারে বসে বিচক্ষণ চোখে দেখেছেন তামিম-তাসকিন আহমেদদের অনুশীলন। মাঠে শিষ্যদের ভুল শুধরে দিয়েছেন তৎক্ষণাৎ! লাল-সবুজদের সঙ্গে নিজের দ্বিতীয় ইনিংসে হাথুরুসিংহে বাড়তি সিরিয়াসই বটে। শুরুর সেশনে তামিম ও লিটন মিলে ৬ ওভারে রান করেছিলেন ৩৪ রান।

তামিম ১৪ বলে ১১ ও লিটন ২২ বলে ছিলেন ২০ রান। তবে ২০ রানের মাঝে ছিল ৩টি চার ও একটি ৬। মোট ১৮ রান বাউন্ডারি থেকে এলেও স্ট্রেইট ড্রাইভ, ব্যাক ফুট পাঞ্চে চার মারার সঙ্গে সুইপ করেও ছক্কাও মেরেছিলেন এই ওপেনার। কিন্তু বাকি বলগুলোতে স্কোররিং শটস খেলতে পারেননি লিটন। এখানেই হয়ত সমস্যা দেখেছিলেন হাথুরুসিংহে। তাই তো ডাগ আউটে ফেরা লিটনকে নিয়ে ৩০ মিনিটের ক্লাসে বুঝিয়েছেন কীভাবে মিডল অ্যান্ড লেগ স্টাম্পের বলগুলো একটু শরীর ঝুঁকিয়ে সিঙ্গেল বের করা যায়।

তা না হলে সুইপ বা রিভার্স সুইপের মত শটসও খেলা যেতে পারে। দূর থেকে কথা স্পষ্ট শোনা না গেলেও আকার-ইঙ্গিতে এমন ধারণা পাওয়া স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছিল। লিটনও তার গুরুর কথা বেশ মনোযোগ সহকারে শুনেছেন। তাই তো বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ একজন থ্রোয়ার নিয়ে হাথুরুর দেখিয়ে দেয়া বিষয়গুলোই করার চেষ্টা করছিলেন। যার মধ্যে ৪-৫টি বল শরীর ঝুঁকিয়ে এবং বা পা এগিয়ে লেগ সাইডে পুশ করেছেন। আবার একটু সোজা আসা বল শরীর ঝুঁকিয়ে ডিফেন্সও করেছেন।

লিটনের এমন ব্যাটিং চলাকালীন নেট বোলার হিসেবে থাকা এক ক্রিকেটার ক্রিকফ্রেঞ্জিকে বলেন, 'আসলে দুজনের মাঝে তো অনেক কথাই হয়েছে। তবে লিটন ভাইয়ের কোথায় হালকা সমস্যা হয় তাই তিনি হাথুরুকে বলছিলেন, সেটাই আরকি ঠিক করে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি।'

লিটন ছাড়াও এদিন হাথুরুসিংহের ক্লাসের ছাত্র ছিলেন শান্ত। দ্বিতীয় ভাগে ব্যাটিংয়ে নামা হৃদয় ও শান্তকে হয়ত আক্রমণাত্মক খেলারই অনুমতি দিয়েছিলেন প্রধান কোচ। তাই তো তাসকিন আহমেদের প্রথম বলটি ব্যাকফুটে হালকাভাবে কাট করতে গিয়ে মিস করলেও দ্বিতীয়টিতে একই ভঙ্গিতে জোড়ে ব্যাট চালিয়েছিলেন এই হৃদয়। কিন্তু ব্যাটে-বলে না হওয়ায় তা চলে যায় উইকেটরক্ষকের হাতে। তৃতীয় বলটিও মিস করেন তিনি।

চার নম্বর বলটি ওয়াইড হলেও বাই থেকে ২ রান নেন শান্ত ও হৃদয়। অপরপ্রান্তে হৃদয়কে এমন ব্যাটিং করতে দেখে নিজেও নেমে পড়লেও আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে। আগের বলের ভুল শুধরে তাসকিনকে ব্যাকফুটে গিয়ে স্কোয়ার কাটে চার মেরে রানের খাতা খোলেন শান্ত। তার সঙ্গী হৃদয়ও পরের ওভার থেকেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং চালিয়ে যান। মেহেদি হাসান মিরাজকে সামনে এগিয়ে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে একটি ছক্কা হাঁকান, এবাদতকে ব্যাকফুটে গালি অঞ্চল দিয়ে হাঁকান আরও একটি বাউন্ডারি।

কিন্তু ওপর প্রান্তে থাকা শান্ত তাইজুলকে চতুর্থ ওভারে দলীয় ৪০ রানে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে বসেন। সঙ্গী হারালেও ২২ বলে ৩৩ রানে ডাগ আউট ছাড়েন হৃদয়। আবারও ব্যাটিংয়ে নামা তামিম এবার অপরাজিত থাকেন এক রানে। ২ ওভারে ২৭ রান দিয়ে এক উইকেট শিকার করেন তাইজুল। এদিন ম্যাচ আবহ তৈরি করে খেলার আগে বেলা ১২টা থেকে মিরপুরের ইনডোর মাঠে প্রায় ৪০ মিনিটের মত ব্যাটিং অনুশীলন করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিম।

সবার আগে বেলা ১১টার একটু পর মাঠে এসে ব্যাটিংটা ঝালাই করে নেন মুশফিক। এরপর ১২টা নাগাদ তামিম ও মাহমুদউল্লাহ চলে যান সেই নেটে। একজন লেগ স্পিনার ও থ্রোয়ারদের নিয়ে মাহমুদউল্লাহ ব্যাটিং অনুশীলন করেন। তার নেটে লম্বা সময় পার করেন হাথুরুসিংহে। শিষ্যের কোন ভুল হলে তিনি সে সময় দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। পাশের নেটে বোলিং মেশিনের সাহায্যে বাড়তি উচ্চতা থেকে গ্রানাইটের ওপর ব্যাটিং চালিয়ে যান তামিম। তবে বুক বরাবর আসা কয়েকটি বল খেলতে বেশ অস্বস্তিতে পড়েন ওয়ানডে অধিনায়ক। এই নেটে তার ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিচ্ছিলেন সিডন্স।

বেলা আড়াইটা বাজে শুরু হওয়া ম্যাচ আবহেতে তৃতীয় ভাগে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পান মাহমুদউল্লাহ, মুশফিক ও আফিফ হোসেন। যদিও প্রথমবারে ২ রানেই রান আউট হন মাহমুদউল্লাহ। মোট ৪ ওভারে ৫০ রান স্কোরবোর্ডে তোলা ম্যাচে ৭ বলে করেন ১৫ মিরাজ, মুশফিক ১০ বলে করেন ২১ ও আফিফ হোসেনের ছিল ৫ বলে ৪ রান। ২ ওভারে ২২ রান দিয়ে এক উইকেট নেন মুস্তাফিজ।

পরের ভাগে অবশ্য ব্যাটে রান পেয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। ৪ ওভারে ৩ ব্যাটার মিলে তোলেন ৪৬ রান, মাহমুদউল্লাহ করেন ১০ বলে ১৩ রান। আফিফ করেন ৯ বলে ১৯ ও মুশফিক লিটনের তালুবন্দি হওয়ার আগে করেন ৫ বলে ১০ রান। একমাত্র উইকেটটি নেন এবাদত। পঞ্চম ভাগে জ্বালিয়ে দেয়া হয় মিরপুরের ফ্লাড-লাইট। আলোর নিচে ৬ ওভারে ২ উইকেট হারিয়ে মিডল অর্ডার ব্যাটাররা করেন ৬১ রান।

এবারে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন শান্তও। ৪০ থেকে ৫০ ওভার বিবেচনায় রেখে ব্যাটিংয়ে বাড়তি আক্রমণাত্মক ছিলেন আফিফ। স্কুপ, সুইপ, স্লগ সুইপ, পুলসহ প্রায় অনেক ধরনের শটই খেলেন তিনি। তাইজুলের বলে বোল্ড হওয়ার আগে করেন ২০ বলে ৩৭ রান। মিরাজের বলে আউট হওয়ার আগে মাহমুদউল্লাহর ব্যাট থেকে আসে ১২ বলে ১৭ রান। ২ রান নিয়ে অপরাজিত থাকেন শান্ত ও মুশফিক। ৩ ওভার করে বোলিং করে একটি করে উইকেট নেন মিরাজ ও তাইজুল।

শেষের ভাগে আলোর নিচে আবারও ব্যাটিংয়ে নামেন শান্ত, হৃদয় ও মুশফিক। কিন্তু তাসকিনের কাছে প্রথম বলেই আউট হয়ে বসেন শান্ত। হাসান মাহমুদের তালুবন্দি হয়ে ফিরলে আবারও তাকে ব্যাটিংয়ে পাঠানো হয়। দ্বিতীয়বারে ৮ বলে করেন ১০ রান। তবে ঝড় তোলেন হৃদয়। তাসকিন আহমেদকে সামনে এগিয়ে ছক্কা হাঁকানোর সঙ্গে পুরো মাঠ জুড়েই রান তোলেন এই তরুণ। ১৭ বলে খেলেন ৪২ রানের ইনিংস। ৪ ছক্কা ও ৩ চারে দলকে ৬ ওভারে এনে দেন ৬৮ রানের পুঁজি।

এছাড়া ১০ বলে ১১ রান আসে মুশফিকের ব্যাট থেকে। এই ভাগে ২ ওভারে ৩৩ রান দিয়ে এক উইকেট নেন মুস্তাফিজ। বেলা আড়াইটায় শুরু হওয়া এই অনুশীলন চলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। ইংল্যান্ড সিরিজের আগে নিজের প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে সফল হতে অনুশীলনে যে দলকে নিয়ে বাড়তি সিরিয়াস হাথুরুসিংহে তা স্পষ্টই। তবে আরও স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে যখন ৬ ক্রিকেটারের সঙ্গে গোল মিটিংয়ে বসেন এই লঙ্কান।

তামিম, লিটন, মাহমুদউল্লাহ, মিরাজ, শান্ত ও মুশফিকদের নিয়ে ১৫ মিনিটের গোল মিটিং দিয়ে শেষ হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের লম্বা এই দিন। হাথুরুসিংহে দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশে এসে অবশ্য ইতিবাচক পরিবেশ তৈরির চেষ্টায় আছেন। অনুশীলনে ধারণা মিলছে ক্রিকেটাররাও তার এই চেষ্টাকে খুব ভালোভাবে নিচ্ছেন। তাই তো সব টেকনিকাল ভুল ধরিয়ে দেয়ার পর তা নিয়ে আলাদা করেও কাজ করছেন খেলোয়াড়রা।

এই প্রসঙ্গে নির্বাচক হাবিবুল বাশার বলেন, 'সব খেলোয়াড়েরই টেকনিক্যাল সমস্যা থাকে, শচিন টেন্ডুলকারেরও ছিল। কোচরা যখন আসেন তখন টেকনিক্যাল নিয়ে কাজ করে, মানিয়ে নেয় খেলোয়াড়েরা। চান্দিকা অনেক আগে থেকেই হোমওয়ার্ক করে আসছে আর.... (মানিয়ে নিতে) সমস্যা হবে না। আমরা সবাই পেশাদার। ক্রিকেটার পেশাদার, কোচ পেশাদার। আমার মনে হয় না সেটা নিয়ে সমস্যা আছে।'

প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর আবারও বাংলাদেশে এসেছেন হাথুরুসিংহে। দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব নিয়ে ঢাকায় নেমে জানিয়েছিলেন, ফিরতে পেরে দারুণ খুশি তিনি। ইংল্যান্ড সিরিজ দিয়ে নিজের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করা এই কোচের সামনে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপ।

তাই এখন থেকেই মন মত দল গড়তে শুরু করেছেন এই লঙ্কান। প্রথম সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানিয়েছিলেন, বিশ্বকাপের কাছাকাছি গিয়েই কেবল স্পষ্ট করে বোঝা যাবে দলের অবস্থা। হাথুরুর ভাষ্যমতে, 'আমাদের সবারই প্রত্যাশা আছে। জাতি হিসেবেও আমাদের প্রত্যাশা আছে, বিশেষ করে এবার যেহেতু ভারতে হচ্ছে (বিশ্বকাপ)। এই সংস্করণে আমরা ভালো খেলি, এই কারণেও প্রত্যাশা আছে। সব মিলিয়ে তাই প্রত্যাশা আছেই।

'তবে আমরা যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তা হলো প্রস্তুতি। আমাদের সামর্থ্যের সেরাটা দিয়ে যেন আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি এবং নিশ্চিত করতে পারি যেন সব বড় ক্রিকেটার, মূল ক্রিকেটাররা যেন ফিট ও সুস্থ থাকতে পারে। সেটা যদি আমরা করতে পারি, তাহলে আমার মনে হয়, বিশ্বকাপে আমাদের ভালো সুযোগ আছে' আরও যোগ করেন তিনি।