বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০২৩

‘কিক’ ২.০?

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 20:54 বুধবার, 25 জানুয়ারি, 2023

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

সাকিব আল হাসান কি হারিয়ে যাওয়া আলাদিনের চেরাগটা আবারও খুঁজে পেয়েছেন? নতুন বছরের উপহার স্বরূপ কি প্রায় চার বছর পূর্বের সেই 'রহস্যময় কিকটা' আবারও ফিরে পেয়েছেন? আদৌ কি এমন কিছু হয়েছে? নাকি সব পেছনে ফেলে সাকিব নিজেকে নতুন করে আবার চিনতে-বুঝতে শিখেছেন? চলতি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) এই অলরাউন্ডারের ব্যাটিং তো এমনই কিছুর আভাস দিচ্ছে। ২০২৩ সালে কি নতুন কোন ‘কিক’ পাওয়ায় তার ভেতরের পুরোনো তাড়না ফিরে এসেছে!

‘কিক’ শুনতে শুনতে হয়তো খানিকটা দোটানায় পড়ে গেছেন। এবার সেখানেই ফেরা যাক। ফরচুন রবিশালের বরিবারের অনুশীলনে চোখ রাখলে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে। সাকিব এমনিতেও প্রয়োজনের বাইরে খুব বেশি অনুশীলন করে না। বিপিএলেও এবারের আসরেও দেখা গেছে একই চিত্র। এখন পর্যন্ত বরিশালের হয়ে ৪ দিন অনুশীলন করছেন। সেটাও নিজের ঠিক যতটা প্রয়োজন ঠিক ততটা। ঢাকার দ্বিতীয় পর্ব শুরুর আগে মাত্র দুদিন নেটে এসেছিলেন সাকিব। তবুও সাকিবের ব্যাটে রানের ফোয়ারা ছুঁটেছে।

ঢাকার প্রথম পর্ব এবং চট্টগ্রাম মিলে সাকিবের ব্যাটে হাফ সেঞ্চুরি এসেছে তিনটা। চোখে লেগে থাকার মতো ব্যাটিং করা সাকিবের স্ট্রাইক রেট তো সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। চট্টগ্রামে তাণ্ডব চালানো অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার ঢাকায় ফিরে সিলেট সিক্সার্স ম্যাচের আগে অনুশীলনে এসেছিলেন। যেখানে বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়েছেন বোলিংয়ে। যদিও নেটে সাকিবকে খুব বেশি বোলিং করতে দেখা যায় না।

বোলিং এসে ডাগ আউটে ফিরেছিলেন সাকিব। সে সময় একাডেমি মাঠের সেন্টার উইকেটে ব্যাটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ ও মোসাদ্দেক হোসেন। তাদের অনুশীলন শেষ  হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে দুটি ব্যাট কাঁধে নিয়ে নেটে হাজির সাকিব। ব্যাটিং অনুশীলনের প্রথম বলেই খালেদ আহমেদের মিডল অ্যান্ড অফ স্টাম্পে ফেলা ডেলিভারি অনায়াসে ঠেকিয়ে দেন তিনি।

খালেদের সঙ্গে বোলিং প্রান্তে ছিলেন এবাদত হোসেন-নাঈম হাসানরা। বরিশালের দুই পেসারকে সে সময় পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন দলটির অ্যানালিস্ট লক্ষ্মী নারায়ণ। কখন কোন বল করলে সাকিব বিপদে পড়তে পারেন সেটাই খালেদদের দেখানোর চেষ্টা করছিলেন এই ভারতীয়। নারায়ণের পরামর্শে শুরুদিকে সফলও হয়েছেন বাংলাদেশের টেস্ট দলের নিয়মিত এই দুই পেসার।

ব্যাটিংয়ের সময় কিছু বল যেমন সাকিবের ব্যাটের কানায় লেগেছে আবার কয়েকটি মিসও করেছেন। তবে এবাদত-খালেদ মিলে সাকিবকে বেশিক্ষণ দমিয়ে রাখতে পারেননি। পরিকল্পনা বুঝতে পেরে ব্যাটিং গার্ড বদলে সাকিব একটু সামনে এগিয়ে আসেন, মিডল-লেগ স্টাম্প থেকে পুরোপুরি মাঝের স্ট্যাম্পে এসে দাঁড়িয়ে খালেদের করা একটি ডেলিভারিতে ছক্কা মেরে বিসিবির একাডেমি ভবনের ছাদে পাঠান। সাকিব যে মানসিকভাবে খুব ভালো অবস্থা রয়েছেন, নিজের ভুলগুলো ধরে ততক্ষণাৎ শুধরাতেও পারছেন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এদিকে ফর্মের তুঙ্গে থাকা সাকিবকে প্রতিপক্ষ ভেবে বোলিং করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খালেদ নিজেই। ডানহাতি এই পেসার জানিয়েছেন, নারায়ণের পরিকল্পনাতেই তারা বোলিং করছিলেন। খালেদ বলেন, 'ও (লক্ষ্ণী নারায়ণ) আমাকে পরিকল্পনা বলে দিচ্ছিলো যে তুমি সাকিব ভাইকে না তুমি অন্য দলের ব্যাটারকে বোলিং করতেছো এটা চিন্তা করে বোলিং করো।'

এবারের বিপিএলে সাকিব ব্যাটিংয়ে দারুণ ছন্দে আছেন। এখন পর্যন্ত টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ব্যাটার তিনি। ৭ ম্যাচের ৬ ইনিংসে ৭৬ গড় ও প্রায় ১৯৪ স্ট্রাইক রেটে করেছেন ৩০৪ রান। কিন্তু হুট করে বিপিএলে এমন ছন্দে কিভাবে ফিরলেন সাকিব? বিশ্বকাপ ও ভারত সিরিজে মাত্র এক হাফ সেঞ্চুরি পাওয়া এই ব্যাটার কোন মন্ত্রে এই বদলে গেলেন?

এর সহজ উত্তর দিয়েছেন বরিশালের অ্যানালিস্ট নারায়ণ। সম্প্রতি রাইজিংবিডিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এই ভারতীয় জানিয়েছেন, সাকিব নিজেই নিজের বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করেন। সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে সে চিন্তা না করাার কারণে মানসিকভাবে ফ্রি হয়েই খেলতে সক্ষম হচ্ছেন সাকিব।

নারায়ণের ভাষ্যমতে, ‘ব্যাটিং-বোলিংয়ের থেকেও সাকিব নিজের ক্রিকেটীয় মেধার পরিচর্যা করে। যেটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে চলার পথ মসৃণ করে দেয়। নিজের বৃত্ত ভাঙার চেষ্টা করে। সফল হবে কি হবে না সেসব ভেবে নিজের লক্ষ্য স্থির করে না। এখন বিপিএলে ভালো করছে। এর আগে জাতীয় দলের হয়ে তার পারফরম্যান্স ভালো ছিল। জাতীয় দলের দুই ফরমম্যাটের অধিনায়ক। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশও ভালো করছে।’

নতুন বছরে ব্যাটিংয়ে সাকিবের এমন ধারাবাহিকতা অবশ্যই ফিরিয়ে নিয়ে যায় ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে। সে সময় তিনি ওজন কমিয়েছিলেন ৬ কেজি। নিজেকে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন সেই ৮-১০ বছর আগের চেহারায়। এমনকি বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজের সময় সাকিব আর হাসান বলেছিলেন, একটা ‘কিক’ পেয়ে তার ভেতরে তাড়না এসেছে। কথা দিয়েছিলেন বিশ্বকাপ শেষে খোলাসা করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই কিকের খোলাসা তিনি করেননি।

এছাড়া সেই ‘কিক’ কবে, কিভাবে, কার কাছ থেকে এসেছে, সেসবও খোলাসা করেননি সাকিব। সে সময় সাকিব বলেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে ‘কিক’ মুভির মতো ‘কিক’ দরকার হয়! কোনো একটা ভাবে, সেই কিক আমি পেয়েছি। কিক এসেছে। কিভাবে তা আড়ালেই থাকুক। তবে কোনোভাবে এসেছে কিকটা, সেটিই আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে। এমন নয় যে খুব বড় কিছু, কিন্তু একটি কিক তো এসেছেই।’

সেই কিক নিয়ে খোলাসা করতে না চাওয়া সাকিব ৪ বছর আগে বলেছিলেন, ‘কিছু জিনিস রহস্য থাকা ভালো। এটিও রহস্য থাকুক। নইলে কিকটা হারিয়ে যেতে পারে। কোনোদিন বলেও দিতে পারি। কে জানে কী আছে সামনে।’


এবারের বিপিএলে সাকিবের সঙ্গে কাজ করছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। বরিশালের প্রধান কোচ এই অলরাউন্ডারকে প্রতিনিয়নত খুব কাছ থেকেই দেখছেন। শিষ্যের এমন ধারাবাহিকতা দেখে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ২০১৯ বিশ্বকাপের চেয়েও ভালো ব্যাটিং করছেন এই অলরাউন্ডার। প্রথম ম্যাচে সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ৩২ বলে ৬৭ রানের ইনিংস দিয়ে আসর শুরু করেছিলেন সাকিব।

চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের বিপক্ষে ভালো না করলেও পরের ম্যাচে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের বিপক্ষে তিনি খেলেন ৪৫ বলে ৮১ রানের অপরাজিত ইনিংস। সেটিকে ছাড়িয়ে রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে করেন ৪৩ বলে অপরাজিত ৮৯। ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে টি-টোয়েন্টিতে যা তার সর্বোচ্চ ইনিংস। তবে ঢাকায় ফিরে হাফ সেঞ্চুরি না পেলেও ঢাকা ডমিনেটর্সের বিপক্ষে শুক্রবার করেন ১৭ বলে ৩০। আর গেল ম্যাচে করেছেন ২৯ রান।

এমন ধারাবাহিকতা দেখে চট্টগ্রাম পর্ব শেষে নাজমুল আবেদিন বলেছিলেন, ‘সাকিব খুবই স্মার্ট। ও সবসময়ই খুঁজতে থাকে, কোথায় গেলে আরেকটু ভালো হওয়া যায়। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমি ওর ব্যাটিং যতদিন দেখছি, ও বোধহয় নিজের ব্যাটিংয়ের চূড়ায় আছে। (২০১৯) বিশ্বকাপের কথা স্মরণ রেখেই আমি বলছি। ও এত সহজে ব্যাটিং করছে, সেটা ভাবাই যায় না।'

‘গত বিপিএলে ও খুব ভালো খেলেছিল। বিপিএলের পর একটা যখন গ্যাপ হয়েছে, ওর নিজস্ব যে খেলার ধরন, যে স্টাইল বা টেকনিক অনুসরণ করে, একটা গ্যাপের পর আবার সেই জায়গাটিতে বোধহয় চলে গিয়েছিল। এবারও বিপিএলে আসার আগে নিজেকে যেভাবে অ্যাডজাস্ট করেছে, সেটা দারুণ।’

নিজের ব্যাটিংয়ের সীমা এবং শটের পরিধি বেড়েছে বলেই সাকিব নিজেকে নতুন উচ্চতায় নিতে পারছেন বলে মনে করেন অভিজ্ঞ এই কোচ। সাকিবের এই মেন্টর আরও বলেছিলেন, ‘আরেকটা ব্যাপার হয়েছে, ও এখন জানে যে, দু-তিনটি ডট বল হলেও, হঠাৎ করে চার বা ছয় দরকার হলে তা মেরে দিতে পারে। এটা যে কোনো ব্যাটসম্যানকে স্বস্তি দেয়। এটা থাকলে যে কোনো ব্যাটসম্যান বড় ইনিংস খেলার চিন্তা করতে পারে। আগে কয়েকটি ডট বল খেললে পরে বড় শট খেলতে গিয়ে আউট হয়ে যেত। এখন সেটা হচ্ছে না। কাজেই চাপটা অনুভব করে না। ওর শরীরী ভাষা দেখেই মনে হয়, খুব স্বস্তিতে খেলছে। নিজের ওপর বিশ্বাসটা অনেক বেশি।’

২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব ৮ ইনিংসে ২ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটিতে ৬০৬ রান করেছিলেন। তার গড় ছিল ৮৬.৫৭। বল হাতে নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। বাঁহাতি এই অলরাউন্ডারের এমন পারফরম্যান্সের পেছনে বড় অবদান ছিল  শৈশবের কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের। সেবার আইপিএলে খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি সাকিব। তাই সময়টা কাজে লাগিয়েছিলেন ফিটনেসের উন্নতি করে। দেশ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে।

এরপর অবশ্য সালাউদ্দিনের সঙ্গে প্রায় ২ বছর ধরে কাজ করা হয়নি সাকিবের। তবে বিপিএলে শিষ্যের পারফরম্যান্স নজরে এসেছে তারও। তবে কি মানসিকভাবে ২০১৯ সালে ফিরে গিয়েছেন সাকিব? পরিষ্কার চিন্তা-ভাবনা করছেন বলেই কি এমন খেলছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে সালাহউদ্দিন বলেন, 'সাকিবের সঙ্গে আমি দেড়-দুই বছর কাজ করিনি। ওর মেন্টাল স্ট্রেসটা কি সেটা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু উন্নতি যে অনেক হচ্ছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। কারণ সে যেভাবে ক্লিন হিটিং করতেছে এবং যে কারও বল সে চাইলেই মারতে পারছে।’

‘অনেক ইম্প্রুভমেন্ট আসছে। যাদের সঙ্গে আমি কাজ করেছি তাদের কৃতিত্ব বেশি। তারাই নিজেদের পরিবর্তন করেছে। সাকিবকে আপনি যদি টেকনিক্যাল পরিবর্তনের কথা বলেন তাহলে সে সেটা দ্রুত ধরতে পারে। অনেক ছেলেদের সেটা মিসিং। তার খেলার ইম্প্রুভমেন্ট আসছে সেটা আমরা নিজেরাও দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কাজ কি করছে সেটা সাকিব বলতে পারবে, সাকিবের সঙ্গে যারা কাজ করেছে তারা ভালো বলতে পারবে।’

উড়তে থাকা সাকিবের দেখা মেলেনি সংবাদ সম্মেলনে। জানা যায়নি সাকিবের সাফল্যের রহস্যও। বাংলাদেশের অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার নতুন ‘কিক’ পেয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য হয়তো আরও খানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে সাকিবের কাছে আলাদিনের চেরাগের মতো কিছু একটা যে আছে সেটা হয়তো বলাই যায়। সেটা মানসিকভাবে পরিবর্তন হোক কিংবা টেকনিক্যাল পরিবর্তন হোক।