বিপিএল ২০২৩

মুশফিকের ব্যাট, ফরম্যাটভিত্তিক স্টান্স ও হৃদয়ের ১২ মাস

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 20:08 শনিবার, 21 জানুয়ারি, 2023

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

কথায় আছে 'শেষ ভালো যার, সব ভালো তার'... কিন্তু বছরখানেক আগে প্রবাদটিকে ক্রিকেটের সঙ্গে এক সুতোয় বাঁধতে পারেননি তৌহিদ হৃদয়। হয়েছেন ব্যর্থ, দেখেছেন কঠিন বাস্তবতা; ভেঙে পড়েছিলেন মানসিকভাবেও। কিন্তু সময়কে সময় দিলে যেকোন দৃশ্যপটই যে বদলে যেতে পারে এর উদাহরণ এখন বগুড়ার এই ক্রিকেটার। এক বিপিএল থেকে আরেক বিপিএল, হৃদয়ের পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। তরুণ বয়সে নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়তে শিখেছেন, বদলেছেন দর্শনও।

ছোট ক্যারিয়ারে হৃদয় 'খলনায়ক' হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছিলেন গেল বিপিএলের ফাইনালে। ফরচুন বরিশালের পক্ষে শেষ পর্যন্ত ব্যাট করেও দলকে শিরোপা জেতাতে পারেননি। তীরে এসে বরিশালের তরী ডুবিয়ে হৃদয় অপরাজিত ছিলেন ৯ রানে। নিতে পারেননি শেষ বলে মূল্যবান ৩টি রান। শিরোপা হাতছাড়া করে হৃদয়ের মাঠ ছাড়তে না চাওয়ার দৃশ্য বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন খালেদ মাহমুদ সুজন।

ফাইনাল পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে হতাশাজনক কন্ঠে গেল মৌসুমের বরিশালের কোচ বলেছিলেন,'আগ্রাসী মনোভাব যদি না থাকে তাহলে তো জেতা কঠিন। ১৮ বলে ১৮ রানই নিতে হবে কেন? এই ১৮ রান তো ১২ বলেও নেওয়া যায়। আমাদের তো শক্তি আছে, জিম করি, ট্রেনিং করি প্রতিদিন। আমি ছয় মেরেছি, লাগলে আবার ছয় মারবো।’

ফাইনালে সেই হারের পর লম্বা সময় লাইমলাইটের বাইরে ছিলেন হৃদয়। যুব বিশ্বকাপ জয়ী এই ক্রিকেটার চলতি বিপিএলে ম্যাচ সেরা হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে জানিয়েছিলেন, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার কথা। আক্ষেপ করেছেন, একটা বাউন্ডারি না মারতে পারার জন্য।

হৃদয়ের ভাষ্যমতে,'বিপিএলে ওই ম্যাচটা হারার পর আমি মানসিকভাবে অনেক হতাশ ছিলাম। যদি একটা বাউন্ডারি মারতে পারতাম, খেলাটা একটু পরিবর্তন হতো। যদিও আমি ওই জায়গার ব্যাটসম্যান না, একদমই নিচে। তারপরও ব্যাটসম্যান হিসেবে যেখানে নামাবে, সেখানেই চেষ্টা করতে হবে কীভাবে দলকে এগিয়ে নেওয়া যায়। শেষ বল পর্যন্ত আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে, আমি ম্যাচটা জেতাব, কিন্তু পারিনি।'

ছোট ক্যারিয়ারে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দেখা হয়ে গিয়েছে হৃদয়ের। যুব বিশ্বকাপ জয় থেকে বিপিএল ফাইনালের হার, সাফল্যের চুড়া থেকে খলনায়ক। ২২ গজের কঠিন বাস্তবতাকে অল্প বয়সেই খুব কাছ থেকেই দেখেছেন তিনি। তবে ব্যর্থ হয়ে দ্রুত উপলদ্ধি করেছেন, সাফল্যের পথ খুঁজেছেন।

নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়েছেন। একান্ত চেষ্টায় ভুল খুঁজে নিজেকে শুধরেছেন, ব্যাটিংয়ে এনেছেন বড় রকমের পরিবর্তন। যার বড় উদাহরণ, হৃদয়ের ব্যাটিং স্টান্স। ২০২২ বিপিএলে এই তরুণের ব্যাকলিফট থাকত স্টাম্পের বেল বরাবর, ব্যাট থাকতো প্রথম স্লিপের দিকে। এক বছর পরের বিপিএলে ব্যাকলিফট গিয়েছে অনেক উপরে, মাথার পজিশন হয়েছে নিচু এবং ব্যাট থাকছে স্টাম্পের সোজা বা উপরের দিকে।

হৃদয় জানিয়েছেন, ব্যাটিংয়ে এমন আমূল পরিবর্তন আনার পেছনে স্টান্স বদলানোর সিদ্ধান্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। নিজেই নিজেকে নিয়ে কাজ করেছেন, এমনকি ফরম্যাটভিত্তিতে ঠিক করেছেন আলাদা-আলাদা স্টান্স। ব্যর্থতা থেকে সাফল্যের পথ খুঁজতে যাওয়া এই তরুণ নিজের সিদ্ধান্তে দৃঢ় বিশ্বাস রেখেছিলেন।

ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে স্টান্স পরিবর্তন নিয়ে হৃদয় বলেন, ''স্টান্স বদলে ফেলার সিদ্ধান্তটা একান্তই আমার। আমি নিজে নিজেকে নিয়ে কাজ করেছি। ফরম্যাট ভিত্তিতে স্টান্স বদলেছি, তিন ফরম্যাটের জন্য তিনরকম। বেস চেষ্টা করেছি, কোনটায় কেমন হয়। এই মুহূর্তে টি-টোয়েন্টিতে যেভাবে খেলছি এটাতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি।'

‘আপনি যখন ব্যর্থ হবেন, সে ব্যর্থতা থেকেই তো সাফল্যের পথ খুঁজবেন। আমি ব্যর্থ হয়েছি, তারপর চেষ্টা করেছি, কীভাবে একটু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। কী কী জিনিসগুলো আমাকে উন্নতি করতে হবে এবং ওইভাবেই চেষ্টা করছি।’

শুধু স্টান্স নয়, ব্যাটিংয়ে আরও কিছু পরিবর্তন করেছেন হৃদয়। যার প্রমাণ মিলেছে চলতি বিপিএলে। গেল বছর একশোর নিচে স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা এই তরুণের চলতি বিপিএলে স্ট্রাইক রেট ১৬০ এর উপরে। মূলত শটের রেঞ্জ বাড়ানোর ফলেই মাঠের চার পাশে রান বের করতে শিখেছেন তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে এসে হৃদয় বলেছিলেন, 'আমি চেষ্টা করেছি রেঞ্জ হিটিংয়ে কীভাবে উন্নতি করা যায়। একটু কাজ করছি, এইচপিতে ছিলাম। আমি ভালো খেলিনি তারপরও জাতীয় দলের সঙ্গে রেখেছিল ক্রিকেট বোর্ড। এই সুযোগগুলো যখন পেয়েছি, তখন চেষ্টা করেছি কীভাবে আরেকটু সামনের পর্যায়ে যাওয়া যায়। ক্রিকেট বোর্ডের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ যে, আমি খুব একটা ভালো না খেললেও আমাকে সাথে রেখেছে।'

চলতি বিপিএলে আগের বিপিএলের খলনায়ক তকমা ঘুচিয়ে নায়ক হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিলেন হৃদয়। কিন্তু ইনজুরিতে পড়ে এই তরুণ এখন মাঠের বাইরে। সিলেট স্ট্রাইকার্সের হয়ে ৪ ম্যাচ খেলে ব্যাট করেছেন ৩টিতে। আর ৩টি ইনিংসেই তিনি খেলেছেন নজরকাড়া ইনিংস, হাঁকিয়েছেন হ্যাটট্রিক হাফসেঞ্চুরিও। কিন্তু সিলেটের চতুর্থ ম্যাচে ফিল্ডিংয়ে হাতে চোট পেয়ে লেগেছে ৮ সেলাই। হৃদয় আপাতত তাই আছেন মাঠের বাইরে। মিস করেছেন চট্টগ্রাম পর্বে সিলেটের হয়ে ২টি ম্যাচ।

ঢাকা পর্বে আবারও মাঠে ফিরতে পারেন তিনি, না হলে সিলেট পর্বে হৃদয় ২২ গজে ফিরবেন তা নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত ৪ ম্যাচে ডানহাতি এই ব্যাটার রান করেছেন ১৯৫, ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ব্যাটারদের মধ্যে শীর্ষে। তবে যে ব্যাট দিয়ে খেলে হৃদয় নিয়মিত রান করছেন তা যে আরেকজনের। 

মুশফিকুর রহিমের থেকে নেয়া ব্যাট দিয়ে খেলছেন চলতি বিপিএলে। তবে শুধু এবারই নয়, হৃদয় অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায় থেকে মুশফিক থেকে ব্যাট নিয়ে খেলেন। মুশফিকের ব্যাট দিয়ে খেলা প্রসঙ্গে হৃদয় ক্রিকফ্রেঞ্জিকে বলেন, 'মুশফিক ভাই থেকে আমি অনেক আগে থেকে ব্যাট নেই। সেই ২০১৭ সাল থেকে, অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছি। এবার বিপিএলেও তার ব্যাট দিয়েই খেলছি।'

হৃদয় এবারের বিপিএলে অধিনায়ক হিসেবে পেয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। এই অধিনায়কের কাছ থেকে স্বাধীনভাবে খেলার লাইসেন্স পেয়েই আরও জ্বলে উঠেছেন তিনি। কিছুটা রয়েসয়ে খেলে থিতু হওয়া ঘরানার ব্যাটার বলে পরিচিতি ছিল এই তরুণ। ক্রিজে গিয়েই উত্তাল হয়ে উঠেছে তার ব্যাট। ভয়ডরহীন অ্যাপ্রোচে টানা তিন ফিফটিতে হয়েছেন ম্যাচ সেরা। অধিনায়ক মাশরাফি জানিয়েছিলেন, অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে তার দলের তরুণদের, যার ফলও মিলছে।

অধিনায়ক বলেছিলেন, 'হৃদয়কে আমরা ওর মতো ছেড়ে দিয়েছি। আগের ম্যাচটা (কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস) দেখুন, উইকেটে গিয়ে প্রথম বলে ছক্কা মেরেছে। আমি ওকে পুরো ব্যাক করেছি। ওই শটে যদি আউট হতো, আমরা ওকে কিছুই বলতাম না। এভাবে পাশে থাকা প্রয়োজন। আমাদের দল থেকে, বিশেষ করে আমি যতক্ষণ আছি, ওই সুযোগটা দিয়েছি যে ও যেন যেভাবে চায়, সেভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে।’