টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২

পোলকের গান, ভয়েস অব ক্রিকেট এবং রিচি বেনো মিডিয়া সেন্টার

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 20:43 বৃহস্পতিবার, 27 অক্টোবর, 2022

|| সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে আবিদ মোহাম্মদ ||

অভিজাত তো বটেই পুরোনো মাঠের মাঝে অন্যতম একটি সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড। ২০০৭ সালে শেন ওয়ার্ন ও গ্লেন ম্যাকগ্রার সাদা পোশাকের ক্রিকেট বিদায় বলা মাঠের বিশেষত্বের শেষ নেই। কী-বোর্ডে দশ আঙুল চেপে নিশ্চিতভাবেই শেষ হবার নয় এসসিজির অভিজাত্য। আনাচে কানাচে কিংবা প্রতিটি অংশে কত কি লুকিয়ে আছে ১৭৪ বছরের পুরোনো মাঠটিতে। ১৮৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এই স্টেডিয়ামটিতে চেনা জায়গা খুঁজে পেতে পথ হারিয়ে বিভ্রান্তিতেও পড়তে হয়েছে একাধিকবার।

নতুন যে কাউকে প্রেস কনফারেন্স রুম থেকে ওপরে ওঠার রাস্তা পেতে সাহায্য নিতে হবে স্টেডিয়ামে কর্মরত মানুষের। কাগজে কলমে জানা কিংবা মানুষের দিক নির্দেশনা দিয়ে নেয়ার পরও অনেকসময় খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তবে মিডিয়া বক্সে পৌঁছে সত্যি অবাক হবেন! চোখের খানিকটা বিভ্রমও হতে পারে, লাগতে পারে খটকাও। কারণ গণমাধ্যমকর্মী ও ধারাভাষ্যকারদের এক কাতারে রাখার চেষ্টা করেছে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ড।

রিচি বেনোকে বলা হতো ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর। ক্রিকেট ছাড়ার পর ধারাভাষ্যে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত হয়েছেন সাবেক এই লেগ স্পিনার। কাজ করেছেন ব্রডকাস্টার এবং সাংবাদিক হিসেবেও। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে টেস্টে দুইশ উইকেট নেওয়া ও দুই হাজার রান করা রিচি বেনোর নামেই তৈরি হয়েছে মিডিয়া সেন্টারটি। প্রেস বক্স থেকে কয়েক হাত দূরে তাকালেই দেখা মিলবে ধারাভাষ্যকার কক্ষের। মোট ৪টি প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা রুম।

প্রেসবক্সের দরজা দিয়ে বের হলে আপনাকে খানিকটা নস্টালজিয়া করতে পারে। যাদের খেলা দেখে বড় হয়েছেন কিংবা যাদের ধারাভাষ্য শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়েছেন তারাই কিনা ঠিক আপনার সামনে দিয়ে হেঁটে চলছে নিয়মিত। দরজা পেরিয়ে চোখ রাখতেই দেখা মিলল শন পোলক, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রবি শাস্ত্রী, হার্শা ভোগলে, ইরফান পাঠান, স্টুয়ার্ট ক্লার্ক বা সুনিল গাভাস্কারদের মতো সাবেক ক্রিকেটারদের। যারা কিনা কাজের ফাঁকে বের হয়ে মেতেছেন আড্ডায়, প্রেস বক্সে ঢুকে করেছেন খাওয়া-দাওয়াও।

এতো সব কিংবদন্তী ক্রিকেটারদের একসঙ্গে দেখতে পাওয়া বিরল না হলেও সৌভাগ্যের তো বটেই। বেশিরভাগ ক্রিকেটরই নিজেদের সময় দলের হয়ে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। নিজের দেশকে আনন্দ উল্লাসে মাতিয়েছেন। পেশাটা সাংবাদিক হওয়ায় এবং সেই কৈশোরের নায়কদের সামনে পাওয়ায় সাক্ষাৎকার নেবার লোভ সামলানোর উপায় নেই। তবে সেটার সুযোগ যে একবারেই নেই তা বুঝতে বাকি রইল না কাছে চাপতেই।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তারা সবাই নিজ নিজ চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন। যেটা বলছিরাম ফলে সাক্ষাৎকার নেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু গল্প করার বা ২-৩মিনিট কথা বলার সুযোগ অবশ্যই আছে। তবে সেটার জন্য তাদের অবসর সময়েরও অপেক্ষায় থাকতে হয়, সুযোগ খুঁজে নিতে হয়।

এমনইভাবে প্রথম সুযোগটা চলে আসে শন পোলকের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক এই অধিনায়ক লিফটের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা সাউথ আফ্রিকার ব্যাটিং দেখে হয়তো এতোটাই খুশি ছিলেন যে গান গাচ্ছিলেন দাঁড়িয়ে। সুযোগে তার সঙ্গে লিফটে ঢুকে কুশল বিনিময় শেষে ম্যাচ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘সাউথ আফ্রিকা খুব ভালো ব্যাটিং করেছে, এতোটা ভালো করবে আশা করিনি।'

কাগজে-কলমে চলতি বিশ্বকাপের অন্যতম শক্তিশালী দল এবার সাউথ আফ্রিকা। বৃষ্টিতে প্রথম ম্যাচে দলটি পয়েন্ট ভাগাভাগি করলেও ফাইনালে আফ্রিকার খেলার সম্ভাবনা আছে। প্রতিপক্ষ হিসেবে ইংল্যান্ডকে ফাইনালে পেতে পারে তারা। এমন মন্তব্যের পর পোলক উত্তরে জানালেন, ‘এটা খুব বড় একটা মন্তব্য, ইংল্যান্ড তো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে হারলে বাদও পড়তে পারে! তবে ওদের ফেলে দেয়া যাবে না আসলেই।’

পোলকের সঙ্গে লিফট দিয়ে নামতে নামতে কথা হলো এতোটুকুই। এরপর উপরে উঠে খানিক পর দেখা মিলল হার্শা ভোগলের। বর্তমানে যে কজন ক্রিকেকটাকে দারুণভাবে বুঝেন আর বিশ্লেষণ করেন তাদেরই একজন তিনি। তাকে এত কাছে পেয়ে শুরুর দিকে কথা বলতে খানিকটা দ্বিধা কাজ করলেও কথা হলো অল্পখানেক। পরিচয় দেয়ার পর হার্শা নিজেই বললেন, ‘আমি জানি আপনি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। বলেন তো কিভাবে বুঝেছি?’

খানিকক্ষণ নিরব থাকার পর তিনি নিজেই বললেন, ‘আমি বাংলাদেশিদের দেখলেই চিনে ফেলি।’ হাঁটতে হাঁটতে আলাপ চলাকালীন ভয়েস অব ক্রিকেট জিজ্ঞেস করলেন, ‘ম্যাচ দেখছেন না? বাংলাদেশ চেষ্টা করছে, কিন্তু রাইলি রুশো-ডি ককের সামনে পরিকল্পনা কাজে আসছে না। দেখি কি হয় বাকি সময়টায়।’

বাংলাদেশ-সাউথ আফ্রিকা ইনিংসের মাঝপথে প্রেসবক্সে দুপুরের খাবার খেতে এসেছিলেন ইরফান পাঠান। তার সঙ্গে খেতে খেতেই আলাপ হলো অল্প খানিকক্ষণ। নিজ থেকেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলাদেশে সবাই কেমন আছে, কেমন চলছে দেশটা?’ সাবেক এই অলরাউন্ডারকে উত্তর দেয়ার পর মিনিট দুয়েক কথা হলো ম্যাচ নিয়েই। বললেন, ‘এমন হয়, সব দলই এমন একটা সময়ের মধ্যে দিয়ে যায়। ওরা তাড়াতাড়িই ঘুরে দাঁড়াবে।’

এবিসি রেডিওতে ধারাভাষ্য দিতে আসা স্টুয়ার্ট ক্লার্ক অবশ্য বেশি কথা বলতে চাননি। তবে লিফটে অস্ট্রেলিয়ার পেস বোলিং ইউনিট নিয়ে প্রশ্ন করার পর উত্তর দিলেন খুশি মনেই। ক্লার্কের ভাষ্যমতে, ‘এই মুহূর্তে ছেলেরা খুব ভালো ছন্দে আছে। ওরা এবার ভালো করবে। ঘরের মাঠ তার ওপর। আশা করছি টানা দুটি শিরোপা জিতব। কিন্তু প্রথম ম্যাচটা আমাদের খুব খারাপ গিয়েছে।’

বাংলাদেশের খেলা ততক্ষণে শেষ, চলছে ভারত-নেদারল্যান্ডস ম্যাচ। শেষ বেলায় এসে পাওয়া গেল অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে। ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে বের হতেই তার দিকে যেতেই তিনি বলে বসলেন, ‘কোন দেশ থেকে এসেছেন?’ বাংলাদেশ থেকে এসেছি জানানোর পর গিলি বললেন, ‘ম্যাচটাতে সাকিবরা নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারেনি, শুরুটা ভালো করেছিল।’

এদের ছাড়াও ডেল স্টেইন, সুনিল গাভাস্কার, রবি শাস্ত্রী, ডার্ক ন্যানেসরা নিয়মিত প্রেসবক্সে এসে ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে শাস্ত্রী তো ধারাভাষ্য শেষ করেই ছুটে চলে আসছিলেন এখানে। তবে ভারতের খেলা চলাকালীন বিরাট কোহলির খেলা তিনি খুব ভালো করেই উপভোগ করে পাশের একজনকে বলছিলেন, ‘খুব ভালো খেলছে ও, ছন্দটা ফিরে পেয়েছে।’

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অ্যালান বোর্ডার ফিল্ড ছাড়া বেলেরিভ ওভাল ও সিডনিতেই ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছে বাংলাদেশের। তবে আগের দুটি মাঠে এমন কোন ব্যবস্থা ছিল না, ধারাভাষ্যকক্ষ ছিল মাঠের আরেকপ্রান্তে। কিন্তু সিডনিতে রিচি বেনো মিডিয়া সেন্টার ভুলিয়ে দিয়েছিল সব দূরত্ব।

স্টেডিয়ামের ‘এ’ গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে একটু ডানে তাকালেই চোখে পড়বে তাকে। মেম্বার প্যাভিলিয়নের সিঁড়ির গোড়ায় অস্ট্রেলিয়ার সাবেক এই অধিনায়ক, জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ও কিংবদন্তি এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য। যেখানে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন এক হাতে বল নিয়ে, আরেক হাত বাড়িয়ে। ২০১৫ সালে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও এখনও সবাইকে একছাদের রাখার কাজটা করে যাচ্ছেন বেনো।