টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২২

নিউজিল্যান্ডে শিক্ষা নিয়ে কুইন্সল্যান্ডের 'গতি-বাউন্স' পরীক্ষায় বাংলাদেশ

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 12:59 শনিবার, 15 অক্টোবর, 2022

|| ব্রিসবেন থেকে, আবিদ মোহাম্মদ ||

অ্যালান বোর্ডার ফিল্ডের সেন্টার উইকেট তখনও কাভারে ঢাকা। ৪-৫জন কর্মী মিলে মাঠ প্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত। মাঠের পেছন দিকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কয়েকটি ব্যানার ও পতাকা। এই অল্প আয়োজনই এখন পর্যন্ত হয়েছে বিশ্বকাপের মূল পর্বের আগে বাংলাদেশের দুটি প্রস্তুতি ম্যাচের ভেন্যুতে। দেশটির সাধারণ মানুষের প্রায় অর্ধেকের মাঝেই এই টুর্নামেন্টকে ঘিরে নেই কোন উন্মাদনা। ব্রিসবেন শহরের অনেকে আবার জানেনও না বিশ্বকাপ শুরু কবে! তারপরও সব ছাপিয়ে দেশটিতে বসতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অষ্টম আসর।       

গ্যাবা-এমসিজির তুলনায় অ্যালান বোর্ডার মাঠ তেমন বড় নয়। মাঠে প্রবেশের পর উইকেট সোজা তাকালেই চোখ আটকে যাবে দুটি স্ট্যান্ডে। যা নামকরণ করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার দুই কিংবদন্তি ম্যাথু হেইডেন ও স্টুয়ার্ট ল'র নামে। ১৯৯৯ সালে এই মাঠের প্রথম 'প্রথম শ্রেণির' ম্যাচে এই দুই ব্যাটার সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই সেঞ্চুরির সুবাদে তাদের নামে তৈরি হয়েছে দুটি বড় স্ট্যান্ড। মূলত এটা পুরোটাই একটা স্পোর্টস কমপ্লেক্স।

অ্যান্ডি বিকেলের নামে জিম, ইয়ান হিলির নামে রয়েছে একটি মিটিং রুম, গ্রেগ চ্যাপেলের নামে রয়েছে রাস্তা (গ্রেগ চ্যাপেল ড্রাইভ)। মোট ৬টি জোনে ভাগ করা এই স্পোর্টস কমপ্লেক্সের রিসিপশনে রয়েছে বড় দুটি বোর্ড। যেখানে কুইন্সল্যান্ড ক্রিকেটের সব ক্রিকেটারের নাম, অভিষেক সাল ও বিদায় সাল দেয়া। আবার যারা কুইন্সল্যান্ডকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের নামের পাশে স্টার মার্ক দেয়া। 

মাঠের ঠিক পেছনে রয়েছে একটি রাগবির মাঠও। একটু সামনে আসলে ক্রিকেটারদের প্র্যাক্টিস করার জন্য রয়েছে ৬টি নেট। যার সবগুলোই খোলা আকাশের নিচে। অ্যালান বোর্ডার ফিল্ডের বাউন্ডারির সীমানা তৈরি হয়েছে কাঠ দিয়ে, দুবাইয়ের আইসিসির একাডেমি মাঠের মতো। ৬৫০০ লোকের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়ামের বাউন্ডারি তেমন বড় নয়। তবে সফরকারী দলগুলোর জন্য বড় সমস্যার নাম হতে পারে এখানকার উইকেট। যা নতুনভাবে তৈরি হয়েছে বাড়তি গতি ও বাউন্সের জন্য। তাই প্রস্তুতি ম্যাচ দুটিতে বাংলাদেশ দলের বড় পরীক্ষা নিতে পারে অ্যালেন বোর্ডার ফিল্ডের উইকেট। 

কুইন্সল্যান্ড বুলস ও ব্রিসবেন হিটের হোম ভেন্যু হওয়ার এই মাঠে অনুশীলন করেন একাধিক অজি ক্রিকেটার। কুইন্সল্যান্ড বুলস মূলত অস্ট্রেলিয়ার শেফিল্ড শিল্ড ও ঘরোয়া ওয়ানডে কাপের দল। সেই সুবাদে এই মাঠে শুক্রবার অনুশীলন করতে এসেছিলেন মার্নাস ল্যাবুশেন-উসমান খাওয়াজার মতো ক্রিকেটাররা। কোচিং প্যানেলে ছিলেন রায়ান হ্যারিস-অ্যান্ডি বিকেলদের মতো সাবেক পেস বোলাররা। অনুশীলন শেষে কোচিং স্টাফ বসেছিল প্রায় ২ ঘন্টার মিটিংয়ে। এই মিটিংয়ের পরই ক্রিকফ্রেঞ্জির মুখোমুখি হয়ে অ্যান্ডি বিকেল কথা বলছেন, উইকেট ও কন্ডিশন নিয়ে।

বিকেলের কাছ থেকেই জানা গেল, নতুনভাবে উইকেট তৈরির পেছনের গল্প। যার ফলে উপমহাদেশের দলগুলোকে যে এখানে কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে তাও বলতে দ্বিধাবোধ করেননি সাবেক এই অজি ক্রিকেটার। বিকেল বলেন, 'এখানের উইকেট বেশ ভালো, বেশিদিন হয়নি এই মাঠকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। সম্প্রতি আমরা (কুইন্সল্যান্ড) কয়েকটি ম্যাচ খেলেছি। যা বুঝেছি উইকেটে গতি ও বাউন্সের প্রভাবটা একটু বেশি। এটা দেখে খুব ভালো লেগেছে। কারণ অতীতে উইকেট একটু ধীরগতির ও লো বাউন্স (নিচু) ছিল। তবে এই মুহূর্তে যে ব্রিসবেনের আবহাওয়া তাতে পেসাররা বেশি সুবিধা পাবে। গতি ও বাউন্স থাকবে। এটা বিশ্বকাপে অবশ্য একটা ভুমিকা পালন করবে।'

ব্রিসবেনের আবহাওয়া পরিবর্তন হতে সময় লাগে না। এই গরম, এই বৃষ্টি ও এই ঠান্ডা। মূলত রাতের সময় ঠাণ্ডা বেশি থাকে। কিন্তু বাতাস সবসময়ই থাকে। বিকেল মনে করছেন, এর ফলেই পেসাররা শুরুর দিকে বাড়তি সুইং পাবে। যা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। বিকেলের ভাষ্যমতে, 'দেখুন এখন তো অক্টোবর। আবহাওয়ার কারণে পেসাররা সুইং পাবে শুরুর দিকে। তবে এখানে যখন আবার গরম থাকে তখন ব্যাটারদের জন্য খেলতে সুবিধা হয়। কিন্তু এখন ব্রিসবেনের আবহাওয়া একটু ভিন্ন, কখনও গরম পড়ছে তো কখনও ঠান্ডা আবার বৃষ্টিও হচ্ছে। তাই আমি বলব এমন আবহাওয়াতে পেসাররা একটু বাড়তি সুবিধাই পাবে। সিডনিতেও এমন রকমের আবহাওয়া থাকছে কয়েকদিন ধরে। তাই সুইং বোলারদের ক্ষেত্রে এখানে সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনাটা একটু বেশি।'

নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ব্যর্থ মিশন শেষে বিশ্বকাপের জন্য শনিবার সকালে অস্ট্রেলিয়ায় পা রেখেছে বাংলাদেশ দল। ৪ ম্যাচের ৪টি হারলেও টেকনিক্যাল কনসালটেন্ট শ্রীধরন শ্রীরাম শোনালেন আত্মবিশ্বাসের সূর। অস্ট্রেলিয়া দলের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে এখানকার কন্ডিশন তার জানাশোনা। এছাড়া নিউজিল্যান্ডে থেকে খেলে আসায় সাকিব-সৌম্যরা কন্ডিশন নিয়েও ধারণা পেয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। বিমানবন্দরে শ্রীরাম বলেন, অনেক কিছুই শিখেছি। বিশেষ করে খেলোয়াড়দের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ায় পা দেয়ার ঠিক একদিন আগে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে দুটি পরিবর্তন এনেছে বাংলাদেশ। সাব্বির রহমান ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের জায়গায় দলে এসেছেন সৌম্য সরকার ও শরিফুল ইসলাম। শ্রীরামের দাবি, খেলোয়াড়দের ক্ষমতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা আছে তার। প্রতিপক্ষ দেখে সাজানো হবে একাদশ। এখানে আসার আগে সব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নিয়েই এসেছে বাংলাদেশ দল। 

শ্রীরামের ভাষ্যমতে, 'আমাদের ধারণা পরিষ্কার। আমরা জানি আমাদের সেরা দলটা কেমন। সেরা দল মানে একটা দল নয়, প্রতিপক্ষ দেখে সেরা দলেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু মানসিকভাবে খুব পরিষ্কার ধারণা নিয়ে এখানে এসেছি।  আমরা আমাদের খেলোয়াড়দের সম্পর্কে খুব ভালোভাবে জেনেছি। কাকে কোন ভূমিকা দিতে হবে তা জানা আছে।  ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপক্ষের বিপক্ষে আমাদের কম্বিনেশন কেমন হবে তা জানি। আমার মনে হয় আমরা অনেক কিছুই শিখেছি।' 

অস্ট্রেলিয়ার মাঠগুলো বড় হওয়ায় বোলারদের জন্য সুবিধা থাকবে জানিয়ে শ্রীরাম বলেন, 'মাঠগুলো বড়, বোলারদের ভুল করার সুযোগ কম থাকবে। ব্রিসবেন মাঠের বাউন্ডারি চারকোনা, সিডনি অনেক বড় মাঠ, অ্যাডিলেডের সোজা বাউন্ডারি বড়। তাই আমাদের মাঠের সীমানার সঙ্গে ও কন্ডিশনের দ্রুত মানিয়ে নিতে হবে। তবে মাঠের সাইজ বোলারদের একটু হলেও স্বস্তি দেবে।'

২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপে সফল হয়েছিল বাংলাদেশ। মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে সেবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল লাল-সবুজের দলটি। এবার ভিন্ন ফরম্যাট হলেও সর্বোচ্চটা দিয়েই লড়তে চায় বাংলাদেশ। শ্রীরামের দাবি, নিজেদের দিনে যে কোন প্রতিপক্ষকে হারানোর ক্ষমতা রাখে তার শিষ্যরা। শ্রীরাম আরও বলেন, 'আমরা আমাদের সেরাটা দিতে চাই। সর্বোচ্চটা দিয়ে লড়াই করতে চাই। আমরা চাইছি ছেলেদের মধ্যে এই আত্মবিশ্বাসটা আসুক যে নিজেদের দিনে আমরা যেকোন দলকেই হারিয়ে দিতে পারি। প্রস্তুতিটাই আসল এখানে। আর নিউজিল্যান্ড সিরিজ থেকে আমরা আত্মবিশ্বাস পেয়েছি।'

এদিকে দল যখন নিউজিল্যান্ড থেকে ব্রিসবেনে এসেছে সে সময় সাকিব আল হাসান ছিলেন মেলবোর্নে। আইসিসির আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিশ্বকাপে অংশ নেয়া সব অধিনায়ক এদিন 'ক্যাপটেইন্স ডে লাইট' অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সাকিব জানিয়েছেন বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবনা। প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক বলেন, 'আমি মনে করি আমরা একটি খুব এক্সাইটিং দল পেয়েছি, আমাদের বেশিরভাগই নতুন, তাই তাদের জন্য এটি একটি দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা হবে। আমি সহ আমরা সবাই প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়ায় টি-টোয়েন্টি খেলছি, তাই এটি নতুন অভিজ্ঞতা।'

শ্রীরামের সঙ্গে সূর মিলিয়ে নিউজিল্যান্ড সিরিজ প্রসঙ্গে সাকিব বলেন, ' আমি মনে করি আমরা খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়েছি। আমরা ক্রাইস্টচার্চে দুটি খুব ভালো দলের বিপক্ষে চারটি ম্যাচ খেলেছি, তাই আমরা জানি যে অস্ট্রেলিয়াতে ভালো পারফর্ম করার জন্য আমাদের কী করতে হবে, এবং আমরা ভালো করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছি।'