এশিয়া কাপ

এশিয়া কাপে আম্পায়ারিং আমাদের অনেক কিছু বদলে দেবে: মুকুল

সৈয়দ সামি

সৈয়দ সামি
প্রকাশের তারিখ: 18:36 শনিবার, 10 সেপ্টেম্বর, 2022

|| সৈয়দ সামি, দুবাই থেকে ||

এশিয়া কাপের এবারের আসরের প্রথম পর্ব থেকেই ছিটকে গেছে বাংলাদেশ। শুক্রবার দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। ফাইনালে বাংলাদেশ না থাকলেও আছেন বাংলাদেশের একজন, মাসুদুর রহমান মুকুল। এশিয়া কাপ ফাইনালে তিনি ফিল্ড আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করবেন।

গেল কয়েক বছরে বেশিরভাগ সময় নেতিবাচক কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন বাংলাদেশের আম্পায়াররা। এই জায়গায় ব্যতিক্রম ছিলেন মুকুল। নিজ যোগ্যতা প্রমাণ করে এশিয়া কাপে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার দুটি হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে নির্ভুল সব সিদ্ধান্ত দিয়ে নজর কেড়েছেন তিনি। ফাইনালের আগে দুবাইয়ে ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে নিজের জীবনের উত্থান-পতনের গল্প শুনিয়েছেন তিনি।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: এশিয়া কাপের মতো বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে আম্পায়ারিং করতে যাচ্ছেন অনুভূতিটা কেমন?

মাসুদুর রহমান মুকুল: অবশ্যই, এটা অন্যরকম একটা অনুভূতি। ভালো লাগারও। সবচেয়ে বড় কথা এত বড় মঞ্চে বাংলাদেশি হিসেবে ফাইনালে আম্পায়ারিং করছি এটা আনন্দ বলেন, অনুভূতি বলেন, একটা রোমাঞ্চ সবকিছুই আছে আমার মাঝে। সবকিছুর মাঝে আমার মনোযোগটা হচ্ছে আমার চ্যালেঞ্জ। এটা আমি ভুলছি না।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: বাংলাদেশ এবারের আসরে ভালো খেলেনি। বাংলাদেশ থাকলে এই ব্যাপারটা আরও পূর্ণতা পেতো কিনা?

মুকুল: সত্যি কথা বলতে আপনাদের মতো বা সমর্থকদের মতো আমরাও কিন্তু চেয়েছি বাংলাদেশ ফাইনাল খেলুক। এশিয়া কাপে আসার আগে ভাবনাটা ছিল বাংলাদেশ যদি ফাইনাল খেলে আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হবো। যদি ফাইনাল না খেলে তাহলে আমাদের মাঝে কেউ যেন বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। আমাদের প্রথম যে চাওয়াটা ছিল সেটা আমরা পাইনি। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ফাইনালের যে একটা অংশ হতে পারছি এটাও আনন্দের।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: এশিয়া কাপের মতো টুর্নামেন্টে আপনারা সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশে আরও যারা আম্পায়ার আছে তাদের জন্য ভালো বার্তা কিনা

মুকুল: অবশ্যই। দেখুন, আপনারা যারা মিডিয়ার আছেন তারা তো খেলাধুলার সব খবরই রাখেন আমাদের ঘরোয়ার। আমরা বাংলাদেশি আম্পায়ারা কখনও ইতিবাচক আলোচনায় আসি না, সবসময় নেতিবাচক আলোচনায় আসি। যদিও আসে কম কিন্তু যতটা আসে ততটা নেতিবাচক। আমাদের ইতিবাচক আলোচনা খুঁজে পাবেন কিনা সন্দেহ। আপনি যদি বিশ্বের দিকে তাকান তাহলে দেখবেন সেরা সেরা ক্রিকেটাররা আম্পায়ারিংয়ে আসে। বাংলাদেশে সেই পরিবেশটা নেই।

আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি টুর্নামেন্টটা সফলভাবে শেষ করতে পারি অবশ্যই বাংলাদেশের আম্পায়ারদের জন্য বড় একটা প্ল্যাটফর্ম হবে। এই সাফল্যের পর অনেকেই বাংলাদেশের আম্পায়ারিং করার আগ্রহ প্রকাশ করবে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের নিজেদের চেষ্টা থাকতে হবে এবং দুটি জায়গায় ফোকাস করতে হবে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা। এই দুইটা জায়গা আমাদের যত শক্তিশালী হবে আমার বিশ্বাস বাংলাদেশে অনেক অনেক ভালো আম্পায়ার আসবে এবং সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াবে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জি: ভারত-পাকিস্তানের দুটি ম্যাচেই আপনি আম্পায়ারিং করেছেন। এমন উত্তেজনায় ঠাসা ম্যাচে আম্পায়ারিং করার কোন চাপ অনুভব করেছিলেন কিনা?

মুকুল: আসলে কোন চাপ ছিল না কিন্তু এটা রোমাঞ্চ কাজ করছিল। কারণ এত বড় ম্যাচে আম্পায়ারিং করবো। প্রথম ম্যাচের তুলনায় দ্বিতীয় ম্যাচে আত্মবিশ্বাসী এবং সাবলীল ছিলাম। দেখুন, ভারত-পাকিস্তান বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ম্যাচ, আমি মনে করি। এই ম্যাচে নিজে একটা অংশ হতে পারা একটা বিশাল ব্যাপার। সবচেয়ে ভালো হয় যখন সফলভাবে আপনি ম্যাচটা শেষ করতে পারেন। আমি খুব ভাগ্যবান যে সফলভাবে আমি দুটি ম্যাচই পরিচালনা করতে পেরেছি। অবশ্যই, এটা আমার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। খেলা শেষে যখন দেখি ভিউয়ার ১০০ কোটির ওপরে তখন বিষয়টা আমাকে আরও বেশি রোমাঞ্চিত করে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: অনেকদিন ধরেই তো আম্পায়ারিং করছেন। আম্পায়ারিংয়ে আপনার শুরুটা কিভাবে?

মুকুল: এটা খুবই মজার। কারও সঙ্গে খুব একটা শেয়ার করা হয় না। যারা আমার খুব কাছের তারাই শুধু জানে। আমার ক্রিকেট ক্যারিয়ার আসলে ১৯ বছরের। সব ক্রিকেটারেরই (বাংলাদেশি) আসলে স্বপ্ন থাকে বাংলাদেশের হয়ে খেলবে। আমাদের সময় তো আসলে বাংলাদেশ এতো ধারাবাহিকভাবে সফর করতো না। বছরে একটা কিংবা দুইটা করে সফর করতো। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়তো একটা খেলা থাকতো, ‘এ’ দলের হয়তো খেলা থাকতো। আমি আসলে কোনটাতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। ক্ষোভ ছিল না তবে নিজের প্রতি কষ্ট ছিল যে আমার হয়তো সেই সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের লোগো বহন করা। আমার কখনই ইচ্ছে ছিল না আম্পায়ারিংয়ে আসার। আমার ইচ্ছে ছিল হয় কোচিংয়ে যাবো নয়তো ম্যানেজার পোস্টে যাবো। 

হঠাৎ মরহুম মাসুম (আফজালুর রহমান মাসুম) ভাই। তিনি আম্পায়ার্স কমিটির ছিলেন, ক্রিকেটারও ছিলেন। তখন আমাদের ল্যান্ডফোন ছিল। একদিন ল্যান্ডফোনে ফোন দিয়ে বলেন মুকুল ভাই আপনাকে আম্পায়ারিং করতে হবে। বললাম আমি তো বলতে পারবো না। পরে বললো পরীক্ষা দিয়ে দেখেন। পরে আমি পরীক্ষা দিলাম ২০০১-০২ এর দিকে। ২০০৬ পর্যন্ত আমি খেলা চালিয়ে গেলাম। খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার একটা কোর্স হয়েছিল বাংলাদেশে, সেখানে আমাকে ডাকলো। প্রথম যেদিন আম্পায়ারিংয়ে কোর্সে যাই তখন আমাকে সাদা একটা টি-শার্ট দিয়েছিল। সেটা এখনও আমাকে ক্যারি করি।

সেই টি-শার্টের বাম পাশে বাংলাদেশের  লোগো ছিল। তখন একটা জিনিস অনুধাবন হলো যে ১৯ বছর ক্রিকেট খেলে নিজের যোগ্যতায় বাংলাদেশের একটা লোগো ক্যারি করতে পারিনি। কিন্তু আম্পায়ারিং করতে এসে লোগো পেয়ে গেলাম? তখন ভাবলাম আমি আম্পায়ারিংটা করবো। আমি একটা চাকরি করতাম, আম্পায়ারিংয়ের জন্য সেটাও ছেড়ে দিছি। তারপর আম্পায়ারিংয়েই শতভাগ মনোযোগ দিলাম। কারণ ১৯ বছর পর আমি একটা লোগো ক্যারি করতে পারছি। এটা থেকেই আসলে আমাকে আম্পায়ারিংয়ের অনুপ্রেরণা দিয়েছে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনারা যারা আম্পায়ারিং করছেন তারা বিসিবির কাছে থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতাটা পাচ্ছেন কিনা? মানে যতটা আপনারা চাচ্ছেন সেটা পাচ্ছেন কিনা?

মুকুল: দেখুন, একটা সময় বাংলাদেশ দলও কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেতো না। যখন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাশরাফিরা বাংলাদেশের ক্রিকেটের ফ্লেভারটা বিশ্ব মানে নিয়ে গেলো তখন কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ক্রিকেটারদের প্রতি আরও মনোযোগী হলো। ছোটবেলা থেকে একটা জিনিস মেনেছি যে কারও ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়াটা আমার মধ্যে নেই। আমি মনে করি আমরা যারা আম্পায়ারিং করছি তারা যদি সেটাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে পারি তাহলে বোর্ড এখনকার চেয়ে বেশি নজর দেবে। বোর্ড কি করছে না করছে এটা না দেখে আমাদেরকে আরও পারফর্ম করতে হবে। যাতে বোর্ড আমাদের প্রতি আরও বেশি সুনজর দেয়।

একটা জিনিস আমরা প্রমাণ করতে এবং মানুষকে বিশ্বাস করাতে পেরেছি যে আমরাও বাংলাদেশের পতাকা বহন করি। দ্বিতীয়ত আর্থ-সামাজিক অবস্থা যত শক্তিশালী হবে আমাদের আম্পায়ারিং মান তত ভালো হবে। সারাবছর আম্পায়ারিং করে যদি আমার পরিবার না চালাতে পারি, সমাজে যদি আমার পরিচয় না থাকে। ফলে আমি আম্পায়ারিং করতে পারবো না। আম্পায়ারিং এমন একটা জিনিস ৩৬৫ দিনই আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। অন্য কিছু করলে বাংলাদেশের পারিপার্শ্বিকতায় আপনাকে ওই পর্যায়ে পৌঁছানো কঠিন। আমাদের আম্পায়ারদের আপনি অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে যত শক্তিশালী করবেন তত আপনি মানসম্পন্ন আম্পায়ার পাবেন বাংলাদেশ থেকে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: এশিয়া কাপ ফাইনালে বাংলাদেশের একজন আম্পায়ারিং করছে এটা যেকোনো বাংলাদেশির জন্য গর্বের। দেশের আপামর ক্রিকেট দর্শকের গর্বের কারণ হওয়া আপনাকে কীভাবে উদ্বেলিত করে?

মুকুল: আমি নিজেও কিন্তু গর্বিতবোধ করছি। আমরা আসলে কখনই এতো আলোচনায় ছিলাম না। আপনারা আমাদের নিয়ে গর্ববোধ করছেন এটা ভেবেও কিন্তু আমরা গর্বিত। এখন আমরা খুব খুশি যে আপনারা বা সাধারণ সমর্থকরা আম্পায়ারদের নিয়ে চিন্তা করছে। আপনারা কিন্তু দুদিন আগেও আমাদের নিয়ে এভাবে চিন্তা করেননি। ব্যক্তিগত পরিচয়ে হয়তো ভালো-মন্দের খবর নিতেন। আলাদা প্রেক্ষাপটে কিন্তু আপনারা আমাদের ওপর সেভাবে মনোযোগ দেননি। আমরা জাতি বা দেশকে কিছু দিতে পেরেছি বলে আমাদের ওপর সবার মনোযোগ রয়েছে। আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের ক্ষেত্রেও একই রকম। এখন যা দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি দেবে। আপনি কিছু না দিলে কারও কাছে থেকে কিছু চাওয়াটা ঠিক না। 

ক্রিকফ্রেঞ্জি: এশিয়া কাপে আম্পায়ারিং করাটা আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট কিনা?

মুকুল: অবশ্যই। দেখুন, সত্যি বলতে একটা সময় আমি মনে করেছিলাম আম্পায়ারিংটা করবো না। কারণ বছরের শুরুতেই করোনার কারণে অনূ্র্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপটা মিস করলাম। এত বছরের ক্যারিয়ারে ঘরোয়া ক্রিকেটে কখনও আমার বিশ্বস্ততার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠে নাই। মূল ধারার মিডিয়াকে বলছি না, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে বলছি, ডিপিএলে (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ) আমার একটা ভুলের কারণে আমার সততার নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কানাডাতে আমি আইসিসির ইভেন্ট মিস করলাম। কিন্তু আমার ভিসা দেরি করে এসেছিল। এসবের কারণে আমার আসলে কিছুটা খারাপ সময় যাচ্ছিল।

শুধুমাত্র দুটি জিনিসের ওপর নির্ভর করে আমি আম্পায়ারিং চালিয়ে গেছি। আমি সবসময় বিশ্বাস করতাম আল্লাহ আমার জন্য ভালো কিছু রেখেছেন। আরেকটা জিনিস ভাবছি আমি যদি ছেড়ে দেই তাহলে যারা আমার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তারা জয়ী হবে। এই দুইটা জিনিসের ওপর নির্ভর করে আমি আম্পায়ারিং চালিয়ে গেছি। এশিয়া কাপে আমাদের আম্পায়ারিং অনেক কিছু পরিবর্তন করে দেবে। চ্যালেঞ্জ একটাই আমাদের এটা কন্টিনিউ করতে হবে। এটা কন্টিনিউ করতে না পারলে আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই থাকব।