এশিয়া কাপ

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের শক্তিই এখন দুর্বলতা

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 18:26 শনিবার, 03 সেপ্টেম্বর, 2022

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

একটা সময় ছিল উপমহাদেশে খেলা মানেই স্পিনারদের ওপর বাড়তি নির্ভরতা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রিকেট যেমন বদলেছে, তেমনই বদলেছে চিন্তা-ভাবনাও। যদিও বাংলাদেশ এখনও মনে করে ঘরের মাঠে স্পিন নির্ভর উইকেটই বড় হাতিয়ার। বাংলাদেশ এই পথে থাকলেও সেখান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে উপমহাদেশের দলগুলো। এই চিন্তা থেকে সবার আগে সরে এসেছে ভারত। একই পথে হাঁটছে পাকিস্তানও। তারপরও বয়সভিত্তিক দল থেকে উপমহাদেশের ব্যাটাররা স্পিনারদের বিপক্ষে খেলে যে দক্ষতা অর্জন করেন, তা কার্যকারী ভুমিকা পালন করে জাতীয় দলেও। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে কি আসলেই তা কাজে লাগছে বাবর আজম, বিরাট কোহলি কিংবা সাকিব আল হাসানদের? 

ক্রিকেটভিত্তিক ওয়েবসাইট ক্রিকইনফোর এক প্রতিবেদন বলছে, পাকিস্তান, ভারত বা বাংলাদেশের শক্তিই এখন দুর্বলতা! আসলেই কি টি-টোয়েন্টিতে হার্দিক পান্ডিয়া-মোহাম্মাদ রিজওয়ানরা স্পিনারদের বিপক্ষে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে সেরা? ধারণা ও বাস্তবতার মাঝে যে বিস্তার পার্থক্য, তা বলে দিচ্ছে পরিসংখ্যানই। 

২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ব্যাটারদের স্ট্রাইক রেট স্পিনের তুলনায় পেস বলের বিপক্ষে বেশি। অন্যদিকে ইংল্যান্ড (স্পিনের বিপক্ষে ১৩৪.১৫, পেসারদের বিপক্ষে ১৩৫.২৬), অস্ট্রেলিয়া (স্পিনের বিপক্ষে ১৩১.০৪, পেসারদের বিপক্ষে ১২৮.৪৮), সাউথ আফ্রিকার (স্পিনের বিপক্ষে ১৪২.১৬, পেসারদের বিপক্ষে ১৪৩.১৭) স্ট্রাইক রেট দুই বিভাগেই কাছাকাছি। 

মিকি আর্থার যিনি উপমহাদেশের দুই দল পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধান কোচ ছিলেন, কোচিং করিয়েছেন বিপিএল ও পিএসএলেও। এই সাউথ আফ্রিকানের দাবি, উপমহাদেশে দারুণ স্পিনার তৈরি হয় কিন্তু ব্যাটাররা স্পিনের বিপক্ষে সাবলীল না। উল্টো রিজওয়ান-বাবরদের স্পিনের বিপক্ষে পারদর্শী হতে ঘাম ঝরাতে হয়েছে তার।

আর্থার বলেন, ‘এই একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে। ভেবেছিলাম উপমহাদেশ দারুণ এক জায়গা কোচিং করানোর জন্য। যেখানে ব্যাটাররা স্পিনের বিপক্ষে খুবই ভালো হবে কারণ তারা এটা খেলেই বেড়ে ওঠে। আমি দারুণ  দারুণ স্পিন বোলার দেখেছি। কিন্তু ব্যাটারদের স্পিনের বিপক্ষে সাবলীল করে তুকতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সাদা বলের ক্রিকেট স্পিনের বিপক্ষে তারা ভালো ডিফেন্ড করতে পারে কিন্তু যখনই লেগ স্পিন বা ফিঙার স্পিনার আসে ওরা ব্যাটে-বলে টাইমিং করতে হিমশিম খায়।'

'আমরা বাবর, রিজওয়ান ফখর জামানের ক্ষেত্রে অনেক পরিশ্রম করেছি। ওরা সুইপ শট খুব খেলে থাকে। এসব জায়গায় আমাদের মনোযোগ ছিল, এটাতেই আমরা বাড়তি পরিশ্রম করেছি, যেন মাঝের ওভারে তারা স্পিনের বিপক্ষে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট করতে পারে' যোগ করেন এই প্রোটিয়া।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর ফখর জামান পেসের বিপক্ষে ১৩০'র ওপর স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছে। কিন্তু স্পিনের বিপক্ষে তার স্ট্রাইক রেট মাত্র ১০৫.৯৫। ভারতের রোহিত শর্মা-লোকেশ রাহুলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। পেসের বিপক্ষে রাহুলের স্ট্রাইক রেট ১২৬ কিন্তু স্পিনের বিপক্ষে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৮৬.১১। রোহিত পেসের বিপক্ষে ১৫৬.২৭ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করলেও স্পিনে তা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১১৫.৮৭।

উপমহাদেশে কোচিংকালীন আর্থার উপলদ্ধি করেছিলেন, এখানকার ব্যাটাররা স্বভাবগতভাবে স্পিনের বিপক্ষে কবজির ব্যবহার বেশি করে থাকেন। রিভার্স সুইপ বা সুইপের মতো বাড়তি ঝুকি নিয়ে কোন শট খেলতে তারা চান না। ক্রিকইনফোর পরিসংখ্যান বলছে বাবর-বিরাটরা ২০২১ বিশ্বকাপের পর এখন পর্যন্ত রিভার্স সুইপ খেলেছেন মাত্র ২ থেকে তিনবার। অন্যদিকে সুর্যকুমার যাদব ও দীনেশ কার্তিক এখানে ভিন্ন। ২৪ বার রিভার্স সুইপ বা সুইপ খেলে সূর্যকুমার রান করেছেন ৫৬, ২০ বারে ৩৬ রান করেছেন কার্তিক।

আর্থার বলেন, 'উপমহাদেশের এখনকার ব্যাটাররা সুইপ বেশি খেলেন না। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটাররা কবজির জোরে এই শটগুলো নিয়মিত খেলছেন। এমনকি উপমহাদেশের ব্যাটাররা সুইপ বা রিভার্স সুইপ খেলার পর প্রতিপক্ষ দল ফিল্ডিংয়ে পরিবর্তন আনলে তারা সেটা আর খেলেন না। তখন তারা কবজির ব্যবহার বাড়িয়ে দেন, যেটাতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য ও আত্মবিশ্বাসী।' 

'রিভার্স সুইপের জন্য আপনাকে নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এটা কভার ড্রাইভের মতো না। এটাই উপমহাদেশের ব্যাটারদের 'কমফোর্ট জোন' ছেড়ে বের হতে সাহায্য করে। কারণ তারা অনেক বেশি অনেক বেশি কবজি নির্ভর হয়ে থাকেন। আপনি যদি ভারত, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার ব্যাটারদের দেখেন তাহলেই বুঝবেন। তারা মাঠের বিভিন্ন অঞ্চলে শট খেলার জন্য ব্যাটারের 'ফেস' (সোজা ব্যাট) খুলে দেয় আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যাট 'ফেস' বন্ধ করেও খেলে। এসব শট এক রান বা দুই রানের জন্য, কিন্তু বাউন্ডারি হয় না। তাদের বাউন্ডারির জন্য আলাদা রাস্তা বের করতে হয়। তাই বাউন্ডারি হাঁকাতে সহজ হচ্ছে স্কোয়ার অফ দ্য উইকেটে আক্রমণ করা। যেটা সুইপ বা রিভার্স সুইপ' তিনি আরও যোগ করেন। 

২০২১ বিশ্বকাপের পর উপমহাদেশে দলগতভাবে স্পিনের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি সফল ভারত। ১৩৫.৯৭ স্ট্রাইক রেটে তারা স্পিনের বিপক্ষে রান করেছে, যেটা পেসের বিপক্ষে ১৪৪.৯২। ১১২.৪১ স্ট্রাইক রেটে স্পিনের বিপক্ষে দ্বিতীয় সফল দল পাকিস্তান। যা পেস বোলিংয়ের ক্ষেত্রে ১৪১.৭১।

স্পিনে স্ট্রাইক রেট বিবেচনায় তৃতীয়তে বাংলাদেশ থাকলেও পেস-স্পিনের স্ট্রাইক রেটের পার্থক্য হিসেবে সবার পেছনে সাকিব-মুশফিকরা। স্পিনের বিপক্ষে ১০৭.১৪ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের পেসের বিপক্ষে স্ট্রাইক রেট মাত্র ১১৭.৫৮। এক্ষেত্রে পেসের দিক দিয়ে আফগানিস্তান আবার ছাড়িয়ে গিয়েছে লাল-সবুজদের।

পেসের বিপক্ষে আফগানরা ১৩১.৭১ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করলেও স্পিনের বিপক্ষে চতুর্থ দুর্বল দল এরা। মোহাম্মদ নবি-হজরতউল্লাহ জাজাইদের স্ট্রাইক রেট মাত্র ১০৪.৩২। এই তালিকায় সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে শ্রীলঙ্কা। লঙ্কানরা স্পিনের বিপক্ষে ১০৩.৫৮ স্ট্রাইক রেট ব্যাট করেছে, পেস বোলিংয়ের ক্ষেত্রে যেটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১২০.৬৬। 

উপমহাদেশের দলগুলো অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দলগুলোর সঙ্গে বেশি ম্যাচ খেলার কারণে স্পিনের বিপক্ষে খেলাকে কম প্রাধান্য দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন আর্থার। তিনি বলেন, 'আমরা শর্ট পিচ বোলিং ও পেসের বিপক্ষে বাড়তি প্রস্তুতি নিতাম। কারণ বিদেশে খেলতে যাওয়ার আগে ভাবা হতো এটাই হয়তো উপমহাদেশের ক্রিকেটারদের 'কমফোর্ট জোন' ছেড়ে বের হতে সহায়তা করবে।' 

'কিন্তু যদি ব্যাটারের টেকনিক ভালো থাকে আর এসব বল সে ভালো খেলে থাকে তাহলে কাজ থাকে স্পিনের বিপক্ষে সেই ব্যাটারকে আরও তৈরি করা। কিন্তু এটাই উপমহাদেশে কোচিং করাতে গিয়ে কোচরা ভুলে যান বা ভুল করে থাকেন। কারণ সবাই এটা নিশ্চিতভাবে ধরে নেয় উপমহাদেশের ব্যাটাররা স্পিন ভালো খেলে' যোগ করেন আর্থার।