টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ

ওমানের পাহাড়সম স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 12:33 রবিবার, 17 অক্টোবর, 2021

|| আবিদ মোহাম্মদ, মাসকাট থেকে ||

বিমানবন্দর থেকে যখন মাসকাটে পা রাখি তখন ঘড়ির কাঁটায় বাজে প্রায় আড়াইটা। বাংলাদেশে এ সময় রাস্তাঘাট নিস্তব্ধ বা জনশূন্য হলেও ওমানের চিত্রটা একেবারে ভিন্ন। বিমানবন্দরের সব কাজ শেষে গাড়িতে উঠে শুরু হলো হোটেলে যাওয়ার যাত্রা। রাতের অন্ধকারে আশে-পাশে রাস্তায় জ্বলছে নিয়ন আলো। বিশাল রাস্তা, ৪ লেনের। দুই পার্শ্বেই সমান। এক পাশে গাড়ি যাচ্ছে, আরেক পাশে আসছে।

মিনিট বিশেক পর হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ৪টা। পরের দিন বেলা ১২টায় হোটেল থেকে বের হতেই স্বাদ পাওয়া গেল মধ্যপ্রাচ্যের প্রচণ্ড গরমের। তাপমাত্রা প্রায় ৩৫ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। গাড়িতে করে ওমানে উপস্থিত সকল সাংবাদিক রওনা হলো আল আমিরাত স্টেডিয়ামের উদ্দেশ্যে। এখানেই বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো খেলবে বাংলাদেশ। তবে সেখানে গিয়ে আরেক বিপদ! ভাষাগত সমস্যার কারণে নিরাপত্তাকর্মী কোনভাবেই মাঠে প্রবেশের অনুমতি দিচ্ছিলেন না।

তারপরও অনেক চেষ্টার পর প্রায় ৪০মিনিটের মতো রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে থেকে মিলল মাঠে প্রবেশের অনুমতি। সেখান থেকেই মিলল মাঠে প্রবেশের কার্ড। তবে মাঠে যাওয়ার পথে যে সব দৃশ্য চোখে পড়ল তা লেখার ভাষায় হয়তো বুঝিয়ে শেষ করার যাবে না। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ পরিবেশের এই দেশে যে কেউ পা রেখেই মুগ্ধ হবে। এ কারণেই ওমানকে বলা হয় রহস্যময় আরবের লুকোনো মুক্তা।

আশে-পাশে উঁচু উঁচু বিশাল পাহাড়ের কারণেই হয়তো এই দেশকে বলা হয় রক মাউন্টেনের দেশ। অবশ্য ওমানের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দেশটির জনপ্রিয় খেলাগুলোর তালিকায়ও নেই ক্রিকেট। কিন্তু এখানেই ১৭ অক্টোবর থেকে রাজধানী মাসকাটে বসতে চলেছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পর্ব। যদিও এর কোনো উত্তাপই নেই। আল আমিরাত স্টেডিয়াম প্রাঙ্গন ছাড়া আর কোথাও ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই সংস্করণের বিশ্ব আসরের প্রচারণা দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের ম্যাচের আগের দিন অবশ্য স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতে একটু ভিন্নতা মিলল। সবার মধ্যে উৎসাহ বা আনন্দফুর্তি তেমন দেখা গেলেও ছিল তাড়াহুড়া। কারণ মাত্র কয়েকঘন্টার মাঝেই শেষ করতে হবে সব কাজ। শুধু তাই নয়, অবাক করার বিষয় বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের আয়োজক ওমানের আল আমিরাত ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অবস্থিত ওমান ক্রিকেট একাডেমির অফিস ব্যতীত সব স্থাপনা তৈরি অস্থায়ীভাবে।

স্টেডিয়ামের চারপাশ জুড়ে অস্থায়ীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এসব স্থাপনা। দেখা গেছে বেশ কয়েকটি তাঁবু। মিডিয়া সেন্টার, ব্রডকাস্টিং কক্ষ, প্রেস বক্স, ধারাভাষ্যকারদের কক্ষ ও মিডিয়া ডাইনিং অবস্থিত স্টিল-লোহা দিয়ে অস্থায়ীভাবে তৈরি চার তলা স্থাপনায়। এরকম চার-পাঁচটি ছোট ছোট স্থাপনায় তৈরি করা হয়েছে আইসিসির অফিস। ৩ হাজার দর্শক ক্ষমতা সম্পন্ন গ্যালারিও তৈরি অস্থায়ীভাবে।

ওমানের স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় ৬ টায় (বাংলাদেশ সময় রাত আটটায়) নিজেদের শেষবারের মতো ঝালিয়ে নিতে অনুশীলনে নেমে পড়ে বাংলাদেশ। অনুশীলনে এসেই শুরুতে নিজেদেরকে খানিকটা আলোচনা করে নিতে দেখা যায়। এরপর ক্রিকেটাররা একে একে ছড়িয়ে যেতে থাকে ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের প্রস্তুত করতে। সেন্টার উইকেটে মুশফিক যখন ব্যাটিং করায় ব্যস্ত তখন অন্য প্রান্তে বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে আফিফ হোসেন ও শামিম পাটোয়ারি ক্যাচের অনুশীলনে ব্যস্ত। দুই তরুণের সঙ্গী ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক।

এতকিছুর মাঝেও ক্যামেরার লেন্স খুঁজে ফিরছিল সাকিব আল হাসানকে। কারণ ১৫ অক্টোবর রাতে কলকাতা নাইট রাইডার্সের হয়ে ফাইনাল খেলেই সকালে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ দলের সঙ্গে যোগ দেন। ক্লান্ত সাকিব সকালে যোগ দিলেও বিকেলে অনুশীলনে দেখা মিলল অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডারের। যদিও সেটা অনুশীলন শুরুর প্রায় দেড় ঘণ্টা পর। আইপিএলে বোলিংটা ভালো হলেও ব্যাটিংটা যুঁতসুই হয়নি। অনুশীলনে নেমে সেই ব্যাটিংয়েই শান দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন সাকিব। তবে এখানেও শুরুতে ব্যাটে-বলে করতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে তাঁকে।

সময় যত গড়িয়েছে সাকিবের ব্যাটের সঙ্গে বোলারের সম্পর্কটাও তত দৃঢ় হয়েছে। শুরুতে পেসারদের নিয়ে নিজের ব্যাটিংটা ঝালিয়ে নিয়েছে সাকিব। একটু পর নাসুম আহমেদ-শেখ মেহেদিকে সঙ্গে নিয়ে পাশের নেটে চলে যান তিনি। সেখনে তাঁকে বেশ কিছু আন অর্থোডক্স শট খেলতেও দেখা গেছে তাঁকে। তবে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন চার-ছক্কার অনুশীলনে। সাকিব যখন পাশের নেটে ব্যাটিং নিয়ে ব্যস্ত তখন সেন্টার উইকেটের দখল নেন মাহমুদউল্লাহ।

ইনজুরি থেকে মাত্রই সেরে ওঠায় মিনিট দশেকের মতো ব্যাটিং করতে দেখা যায় তাঁকে। টি-টোয়েন্টি আমেজে মেতে উঠতে মাহমুদউল্লাহর ব্যস্ত ছিলেন লং শট খেলতে। এদিকে পাশের নেটে রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান ও তাসকিন আহমেদকে নিয়ে ব্যাটিংটা ঠিকঠাক করে নিচ্ছিলেন মুশফিকুর রহিম। সেই সময় মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনকেও অনুশীলনে দেখা যায়।

ওমানের পাহাড়ঘেরা স্টেডিয়ামের সঙ্গে গরমের উত্তাপ এবং অস্থায়ী বিশ্বকাপ মঞ্চ। এত কিছু ছাপিয়ে তবুও ওমানে সেজে ওঠেছে বিশ্বকাপের বর্ণিল রঙে। বিশ্ব আসর শুরুর প্রথম দিনেই মাঠে নামছে বাংলাদেশে। দিনের দ্বিতীয় ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াইয়ে নামার আগের দিন বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় সংবাদ সম্মেলনে করেছেন বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। এতদুরে গিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের পেয়ে খানিকটা হাস্যেজ্জ্বল মাহমুদউল্লাহর দেখা মিলল।

ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে গিয়েছিল সেখানে খানিকটা চিড় ধরায় শ্রীলঙ্কা ও আয়ারল্যান্ড। বিশ্বকাপ শুরুর আগে প্রস্তুতি ম্যাচে হারলেও সেটিকে খুব বেশি কানে নিচ্ছেন না মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক মনে করেন, প্রস্তুতি ম্যাচের হার একেবারেই প্রভাব ফেলবে না। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাস সেই আগের মতোই আছে বলে জানান তিনি। তাই প্রস্তুতি ম্যাচের ব্যর্থতা ছাপিয়ে বাংলাদেশের লক্ষ্য সেরা ক্রিকেট খেলা।

স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে সংবাদ সম্মেলনে মাহমুদউল্লাহ বলেন, ‘আপনি যে দুইটা জিনিস উল্লেখ করলেন, যে আমরা প্রস্তুতি ম্যাচ দুটি হেরেছি। আমার মনে হয় যে ওইটা কোন প্রভাব ফেলবে না। আমরা আগামীকালের (আজকের) ম্যাচের জন্য প্রস্তুত। দলের আত্মবিশ্বাস আগের মতোই আছে। আশা করি আমরা আমাদের সেরা ক্রিকেটটাই খেলতে পারব।’

২০১২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের কাছে হেরেছিল বাংলাদেশ। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের একই গ্রুপে এই দুই দল। র‌্যাঙ্কিংয়ের ছয়ে থাকা বাংলাদেশকে পেয়ে হুঙ্কার দিতে ভুল করেননি স্কটল্যান্ডের কোচ শেন বার্জার। বিশ্বকাপ মিশনে খেলতে নামার আগে এই স্কটিশ কোচ জানিয়েছেন, বাংলাদেশকে ওমান এবং পাপুয়া নিউ গিনি কাতারেই রাখছেন তারা। তবে স্কটিশ কোচের এমন মন্তব্যে মোটেও বিচলিত নন মাহমুদউল্লাহ।

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক জানিয়েছেন, প্রতিপক্ষ হিসেবে সবাকেই সম্মান করে বাংলাদেশ। সব দলের বিপক্ষে ভালো ক্রিকেট খেলতে চান মাহমুদউল্লাহ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আমদের খেলার সামর্থ্য সম্পর্কে জানি এবং আশা করি দল হিসেবে মাঠে আমাদের সেরাটাই দিব। প্রতিটা দলকেই আমরা সমানভাবে সম্মান করি। তবে সব দলের বিপক্ষেই ভালো ক্রিকেট খেলতে চাই।’

বিশ্বকাপ মানেই বাংলাদেশের সমর্থকদের বাড়তি প্রত্যাশা। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সমর্থকদের সেই প্রত্যাশা পূরণ বরাবরই ব্যর্থ বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের বিমান ধরায় এবারের প্রত্যাশাটা আরও বেশি। বলতে গেলে ওমানের সেই পাহাড়সম। সেই সঙ্গে টাইগারদের মুল পর্বের হারের বৃত্ত ভাঙার চ্যালেঞ্জ তো আছেই। এত সব চাপ সামলে বাংলাদেশ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে নাকি শুরুতেই হোঁচট খাবে!