আইপিএল

আর্থিক সঙ্কট, ভাইয়ের আত্মহত্যা ও সাকারিয়ার আইপিএল আরাধ্য সাধন

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 16:30 রবিবার, 21 ফেব্রুয়ারি, 2021

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

সাফল্য যেন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা রাতের শেষ রেলগাড়িটা। যার জন্য সবাই ছুটে বেড়ায়। কেউ ধরতে পারে আবারও কেউ হয়তো প্লাটফর্মের কোনো এক বেঞ্চে বসে আফসোসে পুড়ে। হেলায়-খেলায় বসে থেকে কখনও সাফল্য নামক সোনার হরিণের দেখা মেলে না। সাফল্য পেতে ধৈর্য, দুঃখ-কষ্টের দুঃসহ স্মৃতি, ত্যাগ-তিতিক্ষা এসবের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। যেটা করেছেন ভারতের চেতন সাকারিয়া।

আর্থিক সঙ্কটের মাঝেও জীবনের সঙ্গে লড়াই করেছেন তিনি। নিজের সবটা নিংড়ে দিয়ে অবশেষে সাফল্যের পরশ পাথর ছুঁয়েছেন বাঁহাতি এই পেসার। পারিবারিক বাধা, আর্থিক অনটন কোনও কিছুই যে স্বপ্ন পূরণে বাধা হতে পারে না সেটা প্রমাণ করেছেন সাকারিয়া। ১৮ ফেব্রুয়ারি চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) নিলাম থেকে তাঁকে দলে নিয়েছে রাজস্থান রয়্যালস।

টুর্নামেন্টটির গেল আসরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সের হয়ে নেট বোলিং হিসেবে সুযোগ পাওয়া সাকারিয়া এবার মাঠ মাতাবেন রাজস্থানের হয়ে। বেঙ্গালুরুর সঙ্গে দর কষাকষি করে নিলাম থেকে ১ কোটি ২০ লাখ রুপিতে তাঁকে দলে নিয়েছে আইপিএলের প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়নরা। তবে ক্রিকেটের এই পথচলাটা একেবারে সহজ ছিল না। গুজরাটের ভাবনগর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের একটি ছোট্ট শহর ভারতেজে জন্ম সাকারিয়া। আর্থিক সঙ্কটের মাঝে সেখানেই বেড়ে ওঠা।

পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিল যে ৫ বছর আগে তাঁদের বাড়িতে টেলিভিশনও ছিল না। ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য হয় বন্ধুর বাড়িতে যেতে হতো নয়তো ইলেকট্রনিকের শো রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। বাবা কাঞ্জিভাই সেই শহরে টেম্পু চালাতেন। বাবার সেই উপার্জনের টাকা দিয়েই তাঁদের সংসার চলতো।

আর্থিক ভাবে সচ্ছল না হওয়ার বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল ছেলে অনেক পড়াশোনা করবে। তারপর বড় কোনো চাকরি নিয়ে পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে অভাব ঘোচাবেন। তাঁর বাবার ধারণা ছিল, ক্রিকেটের মতো ‘বড়লোকের খেলায়’ ভাল সুযোগের জন্য বড় যোগাযোগ থাকার প্রয়োজন। যা তাঁদের ছিল না। কিন্তু সাকারিয়া সেইসব কিছু না ভেবে আর বাবা-মায়ের পছন্দের পথে না হেঁটে প্রেমে পড়েন ক্রিকেটের। তবে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা সাকারিয়ার জন্য মোটেও সহজ ছিল না।

কারণ পরিবার সচল না হওয়ায় সেই স্বপ্নে ধুলো জমতে শুরু করে। তবে তখন হঠাৎই ত্রাতা হয়ে এসে সাকারিয়াকে ক্রিকেটার বানানোর দায়িত্ব নেন তাঁর এক কাকা। তবে সেখানে অন্যরকম এক শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর স্টেশনারির দোকানে তাঁকে সাহায্য করলেই কেবল পড়াশোনা ও ক্রিকেটের খরচ বহন করার কথা দিয়েছিলেন তাঁর সেই কাকা।

ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বুদ থাকা ২৩ বছর বয়সি এই পেসার সেই শর্তে রাজি হয়ে যান। তাতে প্রায় ২ বছর তাঁকে সেই দোকানে কাজ করতে হয়েছিল। তখনও কোনও ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হননি সাকারিয়া। পাড়াতে আর স্কুল ক্রিকেট খেলতেন তিনি। জেলাস্তরের স্কুল ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় এক ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচের নজরে পড়ে যান তিনি।

এরপর ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হয়ে অনুশীলন শুরু করেন তিনি। সেখানে ভালো করার সুবাদে খুব তাড়াতাড়ি সৌরাষ্ট্রের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৬ দলে সুযোও পেয়ে যান। পরে সৌরাষ্ট্রের অনূর্ধ্ব ১৯ দলেও সুযোগ পান। কিন্তু যুব দলের হয়ে খেলার জন্য স্পাইকওয়ালা জুতা ছিল না তাঁর কাছে।  সাকারিয়ার এমন সময়ে তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শেল্ডন জ্যাকসন।

খেলার জন্য তরুণ এই ক্রিকেটারকে এক জোড়া জুতা দিয়েছলেন জ্যাকসন। তবে শর্তে জিতে সেই জুতা নিতে হয়েছিল সাকারিয়াকে। শর্ত ছিল অনুশীলনের সময় নেটে তাঁকে আউট করতে পারলে তিনি জুতা দেবেন। পরবর্তীতে নেটে ঘরোয়া ক্রিকেটের এই তারকাকে বোল্ড আউট করেছিলেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে সাকারিয়া বলেন, ‘এটি (বোলার হওয়ায়) আমাকে সাহায্য করেছিল যে আমি একজন বোলার ছিলাম, ব্যয়ও কম ছিল। আমি বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেলার আগ পর্যন্ত আমার কাছে স্পাইকওয়ালা জুতা কেনার পয়সা ছিল না। তাই আমার সিনিয়ররা আমাকে এটিতে সহায়তা করতেন যেহেতু আমি কম করে ব্যাট করতাম, তাই আমি একজনের কাছে ব্যাট ধার করতাম। এটি ছিল শেল্ডন জ্যাকসনের।’

রাজ‍্য দলের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার প্রথম সুযোগ মেলে ২০১৮-১৯ মৌসুমে। একটি ম‍্যাচ বাঁহাতি পেসার জয়দেব উনাদকাদ খেলতে পারেননি চোটের জন‍্য। যে ম্যাচে সাকারিয়ার সুযোগ হয় এবং বোলিংয়ে নজর কাড়েন। সেই ম‍্যাচেই ৫ উইকেট নেয়ার সঙ্গে পুরো মৌসুমে সেবার ৩০ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। গেল সৈয়দ মুস্তাক আলী ট্রফিতেও ভালো করেছেন তিনি।

যার সুবাদে এবারের আইপিএলে দল পান তিনি। এবারের আসরে ৪.৯ ইকোনোমিতে বোলিং করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিদের মধ্যে ষষ্ঠ হয়েছিলেন তিনি। তবে টুর্নামেন্ট চলাকালীন গেল মাসে নিজের ভাইকে হারাতে হয়েছে। এবারের মৌসুম চলাকালীন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মাঝে মাঝে ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বাড়ির লোকজন একেক কথা বলে পাশ কাটিয়ে যেতেন। টুর্নামেন্ট শেষে যখন বাসায় ফেরেন তখন ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনেন।

এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি বলেন, ‘আমার ছোটভাই জানুয়ারি মাসে সুইসাইড করেছে, আমি বাড়িতে ছিলাম না, আমি সেই সময় সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফি খেলছিলাম। বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমি জানতামই না যে ও আর নেই। তখনও আমার পরিবার আমাকে এক খবর দেয়নি। আমি ওদের কাছে রাহুলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করতাম, আর ওরা আমাকে বলত যে ‘ও বাইরে গিয়েছে’, ওর অনুপস্থিতি আমার জন্য ভীষণ একাকীত্বের। যদি ও আজ এখানে থাকতো তো আমার চেয়ে বেশি খুশি হতো।’

আইপিএলের নিলামে যখন নাম উঠেছিল তখন বিজয় হাজারি ট্রফি খেলার জন্য অন্যান্য সতীর্থের মতো তিনিও ব্যাগ গোছাচ্ছিলেন। যখন নিলামে তাঁর নাম আসে তখন তিনি মোবাইল হাতে নিয়ে লাইভ দেখছিলেন। দল পাওয়ার পর সবাই তাঁকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। তবে এতো দামে বিক্রি হবেন সেটা কখনও ভাবেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি আশায় ছিলাম যে আমাকে দলে নেবে তবে এতে বেশি টাকায় নেবে এটা ভাবিনি।’