যুব বিশ্বকাপ

বাংলাদেশ হ্যাভ ডান ইট...

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 18:23 মঙ্গলবার, 09 ফেব্রুয়ারি, 2021

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

ইতিহাস গড়তে ২৩ বলে বাংলাদেশের যুবাদের প্রয়োজন মাত্র ১ রান। ততক্ষণে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে বাংলার হাটে-বাজারে, মাঠে প্রান্তরে কিংবা বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। সাত-সমুদ্র, তেরো নদী পেরিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে আয়োজিত সেই বিশ্বকাপের সুবাস ছড়িয়ে গেছে ১৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশে।

লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে বাউন্ডারি লাইনের পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে শরিফুল ইসলাম-তানজিদ হাসান তামিমরা। জয়ের জন্য প্রয়োজন কেবলই ১ রান। তবে অপেক্ষার যেন তর সইছিলো না টাইগার যুবাদের। সাইড লাইনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তৌহিদ হৃদয়দের মাঠের ভেতরে ছুটে যাওয়ার প্রস্তুতি অন্তত সেটিরই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো।

পরাজয়ের একেবারে সান্নিধ্যে, এটি জেনেও বল করার জন্য কিছুটা সময় নিচ্ছিলেন আথারভা অ্যানকোলেকার। কখনও অধিনায়কের সঙ্গে শলা-পরামর্শ, আবারও কখনও বোলারদের সঙ্গে ভাবনা মিলিয়ে নেয়া। অবশেষে ব্যাটিং প্রান্তে থাকা রকিবুল হাসানের দিকে ফ্লাইটেড এক ডেলিভারি ছুঁড়ে দিলেন অ্যানকোলেকার।

সঙ্গে সঙ্গে মিড অনের দিকে ঠেলে দিয়ে দুই হাত উঁচু করে ভৌঁ-দৌড় দিলেন রকিবুল। তাতেই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নামের পাশে লেখা হয়ে গেল 'বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন' শব্দটি। তখন আর বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের আটকায় কে? তানজিদ হাসান, শরিফুল তখন ছুটে চলছিলেন মাঠের চারিপাশে। দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুম থেকে বাংলাদেশের হাওয়া-বাতাসে সবখানে কেবলই আকবর-ইমনদের জয়গান।

টাইগার যুবাদের এই জয়ে হাহাকারে মোড়ানো প্রতিটি তরুলতাও যেন এক স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো। ওইদিকে ম্যাচ জেতানো রান নেয়া রকিবুল দুই হাত উঁচিয়ে হয়তো মনে মনে এমনটাই বলছিলেন- 'আয় তোরা কে আসবি, জয়ের প্রদীপ তরোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি ময়দানে।' অন্য প্রান্তে থাকা আকবর আলী একটু লাফিয়ে ওঠে হয়তো নিজেকে বলছিলেন- 'হ্যাঁ! আমি পেরেছি, আমরা পেরেছি।'

বাংলাদেশের বিশ্ব জয়ের মুহূর্তে ইয়ান বিশপের সেই ধারাভাষ্য বাংলাদেশের ক্রিকেটীয় রূপকথার অংশ হয়ে গেছে। রকিবুলের রানে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশপ বলে উঠলেন, ‘বাংলাদেশ হ্যাভ ডান ইট, আন্ডার নাইন্টিন ওয়ার্ল্ড কাপ টাইটেল। দে উইল বি ড্যানসিং ইন দ্য স্ট্রিট অব ঢাকা, সিলেট, চিটাগং। ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক আকবর আলী, হ্যাভ সিন ইট টু দ্য এন্ড। টাইগার্স হ্যাভ কনকোওয়ার্ড দ্য আফ্রিকান প্লানস। দে আর দ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন অব আন্ডার-১৯’

আকবরের সতীর্থরা যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় ভারতকে হারিয়েছে, তা যেন যেকোনো শিল্পির মনোযোগী তুলির ছোঁয়াকেও হার মানাবে। ১৯ পেরোনো ছেলেরা যেটা করে দেখিয়েছে সেটা বদ্বীপের মানুষগুলোর জন্য কেবলই একটি ইতিহাস নয়, রীতিমত আরব্য উপন্যাস কিংবা রূপকথা।

যদিও রূপকথা শুরুর পাতাটি লিখেছিলেন শরিফুল, অভিষেক দাস, সাকিব মাহমুদরা। আগুনে বোলিং, বারুদে মোড়ানো ফিল্ডিং, কি ছিল না সেই ম্যাচে। বাংলাদেশের বোলার কিংবা ফিল্ডারদের শরীরী ভাষা দেখে অন্তত এটি বোঝার উপায় ছিল না ছেলেগুলো মাত্রই ঊনিশে পা দিয়েছে নয়তো প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলতে নেমেছে।

ছবি সংগৃহিত
ছবি: সংগৃহীত

স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচে মাত্র ১৭৮ রানের টার্গেটও এভারেস্ট জয়ের মতো কঠিনতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলার কেওক্রাডংকে সেদিন এভারেস্টে রূপ দিয়েছিলেন রবি বিষ্ণুই। পারভেজ হোসেন ইমন এবং তানজিদ হাসান দারুণ শুরু করলেও একটা সময় গিয়ে বিষ্ণইয়ের ঘূর্ণিতে পথ হারিয়ে বসে তারা। একের পর এক উইকেট হারানোর সঙ্গে যোগ হয়েছিলো ইমনের হ্যামস্ট্রিং ইনজুরি।

পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচটি একটা সময় বাংলাদেশের হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। পুরো সময়টা জুড়ে দাপট দেখানো বাংলাদেশ যখন হারের শঙ্কায় তখনই পূর্ব দিগন্ত থেকে ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন আকবর। ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে ৭৭ বলে ৪৩ রানের ধৈর্য্যশীল ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। অধিনায়ক তো বুঝি এমনই হয়, এমনই তো হওয়া উচিত।

দলের বিপর্যয়ের মুখে অধিনায়ককে সেদিন দারুণভাবে সঙ্গ দিয়েছিলেন ইনজুরির কারণে ঠিকমতো দৌঁড়াতে না পারা ইমন ও স্পিনার রকিবুল। তাতেই স্বপ্নের সোনালি ট্রফি ধরা দিলো বাংলার দামাল ছেলেদের কাছে। একেকজন নিয়ে আলাদা করে গল্প লিখলে সেটি মহাকাব্যে রূপ নেবে। এই দলের কেউই তারকা নয়, তারা সকলে একেকটা ব্র্যান্ড।

মাস কয়েক আগে বাংলার সবচেয়ে বড় সুপারস্টারের নিষেধাজ্ঞা, ক্রিকেটারদের আন্দোলন সবই দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিল শেরে বাংলাকে। কালো ছায়া নেমে এসেছিল হোম অব ক্রিকেটে। অন্ধকারে ডুবে থাকা মিরপুরে আলো জ্বালিয়েছেন আকবররা। মিরপুরের হোম অব ক্রিকেটের প্রতিটি প্রান্তরকে সেদিন সাজানো হয়েছিল বিয়ে বাড়ির সাজে।

ট্রফি হাতে দেশে ফিরছে যুবারা, পত্রিকা, টিভি, অনলাইন সব জায়গাতেই দিনের সবচেয়ে বড় খবর। দল দেশে ফেরার আগে থেকেই বিমান বন্দরে সাংবাদিক, মিডিয়া কর্মী সবার উপচে পড়া ভিড়। বাইরেও লোকসমাগম বেড়েছে, বেড়েছে চিৎকার। ঢাকা ততক্ষণে উৎসবের নগরী। বিমানবন্দর প্রতিদিন এমন দৃশ্য দেখে না। প্রতিদিন বাংলাদেশে একটা বিশ্বকাপ ট্রফি আসে না। এর আগে কখনোই আসেনি। আবার কবে আসবে সেটাও হয়তো কেউ জানে না।

চ্যাম্পিয়নদের নিয়ে আসা লাল-সবুজ রঙে রাঙানো বাস মিরপুরে প্রবেশ করার আগে থেকেই সমর্থকদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। তাঁদেরকে বরণ করে নিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেরও (বিসিবি) আয়োজনের কমতি ছিল না। স্টেডিয়ামে প্রবেশ করতেই লাল গালিচা সংবর্ধনা। বিমান বন্দরের পর এখানে আরও একবার ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় আকবরদের।

এরপর মূল স্টেডিয়ামে ঢুকতেই আরও একটা লাল গালিচা পার হতে হয়েছে ইতিহাস গড়া এই বীরদের। মাঠে ঢুকে শিরোপা উঁচিয়ে ধরেন অধিনায়ক আকবর ও বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান। এমন সময় আতশবাজিতে ছেয়ে গেছে গোটা মিরপুর। কেক কাটা, ট্রফি হাতে মাঠ প্রদক্ষিণ করা, কানায় কানায় দর্শকে পূর্ণ গ্র্যান্ড স্ট্যান্ড। কোনো কিছুরই কমতি ছিল না সেদিন।

ছবি: সংগৃহিত
ছবি: সংগৃহীত

অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ শেষ হলো আকবররাও ঊনিশ পেরিয়ে কুঁড়িতে পা দিলেন। রাত পেরিয়ে নতুন সুর্যোদয়, নতুন স্বপ্ন, আরও একবার লড়াইয়ের জন্য জেগে ওঠা। আবারও নতুন কোনো স্বপ্নের পেছনে ছুটে চলার যুদ্ধে নেমে পড়া। সেই স্বপ্নের বীজটা বুনেছিল যুব বিশ্বকাপে। আইসিসির এতো বড় টুর্নামেন্টে নিজেদেরকে মেলে ধরা তরুণরা জেগে ওঠে নতুনের প্রয়াসে, গায়ে জাতীয় দলের জার্সি জড়ানোর উদ্যমে।

যুব বিশ্বকাপে নিজের সেরাটা বিলিয়ে দিয়েছেন, নায়ক বনে গেছেন আবারও জাতীয় দলে জায়গা পাওয়ার আগে ঝড়েও গিয়েছেন। এমন ক্রিকেটারের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। আকবর-শরিফুলরা কোন পথে হাঁটবেন সেটা কেবলই নির্ধারণ করবে তাঁদের প্রচেষ্টা ও বিসিবির পরিকল্পনা। তাঁদের আসল পরীক্ষাটা ঠিক এখানেই।

এখানে পিছলে পড়লে অন্যজন এসে জায়গা দখল করবে। তারকা খ্যাতিরও সুযোগ আসবে তবে সেটি সামলে গিয়ে ক্রিকেটে নিজেকে কতটা মনোনিবেশ করতে পারবে সেটাও মূখ্য বিষয়। খারাপ সময় যাবে আবার কখনও ভালো সময় আসবে। এসব উৎরে যেতে পারলেই কেবল পরের গল্পটা নতুন কোনো চ্যাম্পিয়নশিপ নিয়ে লেখা হবে নয়তো ব্যর্থতার কলমে হতাশার গল্প লেখা হবে।

সেই পরীক্ষায় ক্রিকেটারদের উৎরে দিতেই বিসিবির অন্যরকম প্রচেষ্টা। যদিও বিসিবির তৈরিকৃত পরীক্ষার প্রথম ধাপে বাগড়া দেয় মহামারী করোনা। চ্যাম্পিয়ন দলের ক্রিকেটারদের নিয়ে দুই বছরের ক্যাম্প করার পাশাপাশি অনূর্ধ্ব-২১ দল গঠনের কথা বলা হলেও করোনোর কারণে সেটি পূর্ণতা পায়নি।

দেখতে দেখতে বিশ্বকাপ জয়ের এক বছর পূর্ণ হলো। তবে প্রাপ্তির খাতায় যেন শূন্যই রয়ে গেলো। যে স্বপ্ন নিয়ে যুব বিশ্বকাপ শেষ হয়েছিল সেটির কানা-কড়িও খুঁজে পাওয়া যায়নি গেল এক বছরে। যদিও বোর্ড বা ক্রিকেটারদের খুব বেশি দোষ দেয়ার সুযোগ নেই। বিসিবির সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে করোনা কারণে। যদিও তাতে খুব বেশি আক্ষেপ করার সুযোগ নেই বলে মনে করেন আকবর। যুব বিশ্বকাপ জয়ী এই অধিনায়ক জানান, বিশ্বকাপ জয় অবশ্যই দারুণ কিছু ছিল এবং প্রত্যাশানুযায়ী বছরটি পার করতে না পারলেও নতুন বছরে ভালো করার প্রত্যয় তাঁর।

এ প্রসঙ্গে আকবর বলেন, ‘যদি শুরু থেকে বলি অবশ্যই খুবই ভালো ছিল আমাদের বিশ্বকাপ জয়। এরপর প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলাম কিন্তু সেটা তো হলো না। জাতীয় লিগগুলোও গত বছর হয়নি, তবে আবার যেহেতু নতুন করে শুরু হয়েছে সবকিছু। তো আশা করব যে ঘরোয়া যে খেলাগুলো আমরা খেলতে পারিনি আবার যখনই সুযোগ পাব তখনই যেন ভালো করতে পারি। বলতে গেলে গত বছরটি উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে।’

প্রত্যাশানুযায়ী যুব বিশ্বকাপ জয়ীরা মাঠে নামতে না পারলেও করোনাকালীন বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপ ও বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে নিজেদেরকে আরও একবার নতুন করে মেলে ধরেছিলেন শরিফুল-ইমনরা। বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে ইমনের দ্রুততম সেঞ্চুরি, শামিম পাটোয়ারীর জন্টি রোডসের মতো ফিল্ডিং, শরিফুলের দুর্দান্ত পেস বোলিং, ইমন-শরিফুলের জাতীয় দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে জায়গা পাওয়া সবকিছুরই ছোঁয়া মিলেছে। তারা ক্রিকেটার হিসেবে কতটা পরিণত সেটি আবারও প্রমাণ করেছেন।

বিসিবির ২-৩ বছরের পরিশ্রমের ফলে আকবররা বিশ্বকাপ দিতে পেরেছিল। যা অন্তত এমন বার্তাই দেয় কোনো কিছুর পেছনে লেগে থাকলে সেটি থেকে আপনি অবশ্যই ফল পাবেন। ভবিষ্যৎ সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম কিংবা মাশরাফি বিন মুর্তজা বের করতে চাইলে শরিফুল-আকবরদেরকেও তৈরি করতে হবে ভবিষ্যতের জন্য। তবে সেটা কতটুকু হবে তাঁর প্রমাণ মিলবে সামনের দিনগুলোতে তাঁদের পরিশ্রম ও বোর্ডের চিন্তাধারার ওপর।