বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ

জাতীয় দলে খেলেও কেন 'ডি' গ্রেডে, প্রশ্ন আরিফুলের

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 16:48 বৃহস্পতিবার, 24 ডিসেম্বর, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট |।|

পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি...উক্তিটি আরিফুল হকের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে একেবারেই মানানসই। করোনার মাঝে লকডাউন চলাকালীন কঠোর পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন ২২গজে। ৩ মাসে ওজন কমিয়েছেন ১২ কেজি। কাজ করেছেন শারীরিক শক্তি বাড়ানো এবং ফিটনেস নিয়ে। হার্দিক পান্ডিয়া-লোকেশ রাহুলদের ভিডিও দেখে ট্রেনিংয়ে ভিন্নতা এনেছেন। নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ার চেষ্টাই ২৮ বছর বয়সী এই ক্রিকেটারকে এনে দিয়েছে সফলতা।

সদ্য সমাপ্ত বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে জেমকন খুলনার হয়ে খেলেছিলেন আরিফুল। চ্যাম্পিয়নের তকমা গায়ে নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। এর একদিন পরই চলে গেছেন রংপুর। শুরু করে দিয়েছেন অনুশীলন। কারণ এই ব্যাটিং অলরাউন্ডারের লক্ষ্যটা যে আরও বড়। ফিরে পেতে চান জাতীয় দলের হারানো স্থান।

২০১৭-১৮ বিপিএল দিয়েই আলোচনায় আসেন আরিফুল। সেই মৌসুমেও খেলেছিলেন খুলনা ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে। ১২ ম্যাচে ১৩৩.১৪ স্ট্রাইক রেটে খেলে করেছিলেন ২৩৭ রান। ফিনিশার হিসেবে দলটিকে ম্যাচও জিতিয়েছিলেন। এরপরই ফিনিশারের ভূমিকায় ডাক পান জাতীয় দলেও।

২ টেস্ট, ১ ওয়ানডে এবং ৯টি-টোয়েন্টি খেলার পর ৬ মাসের মধ্যেই এই ক্রিকেটার চলে যান জাতীয় দলের বিবেচনার বাইরে। পরের বিপিএল মৌসুমেও খুলনার হয়ে খেললেও ১১ ম্যাচে করেন মাত্র ১৩৪ রান। আর এ বছর ঢাকা প্লাটুনের জার্সিতে ৬ ম্যাচে করেন ৬৩ রান। তবে বছরের শেষ ভাগে হাসতে শুরু করে আরিফুলের ব্যাট।

খুলনার জার্সিতে প্রথম ম্যাচে ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে খেলেন অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। ৩০ বলে ২৪ রানে অপরাজিত থাকা অবস্থায় মেহেদি হাসান মিরাজের শেষ ওভারের ৫ বলে ৪ ছক্কা হাঁকিয়ে খুলনার জয় নিশ্চিত করেন রংপুরের এই ক্রিকেটার। পরের ম্যাচেও দলকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার পাশাপাশি করেন অপরাজিত ৪১ রান। ১০ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে আসে ১৮৮ রান। খুলনার হয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রানও এই ব্যাটসম্যানের।

টুর্নামেন্টের প্রথম দুই ম্যাচে ৩৬ রানে ৪ উইকেট এবং ৭৩ রানে ৬ উইকেট হারিয়েছিল খুলনা। এই দুটি ম্যাচেই দলকে বিপদ থেকে উদ্ধারের সঙ্গে ২০ ওভার পর্যন্ত খেলেছিলেন আরিফুল। তবে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের জন্য এই ধরণের অভিজ্ঞতা নতুন নয়। জানিয়েছেন আগের বছর গুলোতেও এমন পরিস্থিতিতে খেলতে হয়েছিল বিধায় এ বছর কাজটা সহজ লেগেছে তার কাছে।

ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে আরিফুল বলেন, 'জাতীয় দলে খেলার আগেও আমি খুলনা টাইটান্সে খেলেছি। সে সময়ও খুলনায় তেমন কোন বড় তারকা ছিল না। সেবারও পাওয়ার প্লেতে দ্রুত উইকেট পরে গেলে আমাকেই হাল ধরতে হতো। এই পরিস্থিতিতিগুলো সামাল দিতে দিতে বুঝতে শিখেছি কিভাবে কি করতে হবে। যা এই টুর্নামেন্টে আমি সহজেই করেছি। এখন যে দলেই খেলি চিন্তা করি যে আমাকেই খেলতে হবে। এই রকম একটা মানসিকতা নিয়ে আমাকেই খেলতে হবে। আর আমি ব্যাটিংয়ের সময় চিন্তা থাকে শেষ করে আসার। ২০ ওভারের খেলা ১২০টা বল খেলতে হবে। আপনি যখন শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করবেন তখন শেষের দিকে সহজ হয়ে যাবে।'

বরিশালের বিপক্ষে শেষ ওভারে মিরাজকে প্রথম ছক্কা হাঁকানোর পরই আরিফুল বুঝতে পেরেছিলেন এখান থেকেও জয় সম্ভব। এই কারণেই ঘাবড়ে না গিয়ে আরও একটি ছক্কা হাঁকিয়ে উল্টো বোলারকেই চাপে ফেলে দেন তিনি। প্রথম দুই ছক্কায় পাওয়া আত্মবিশ্বাসই আরিফুলকে এমন অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলতে সাহায্য করে।

আরিফুলের ভাষ্যমতে, 'আমি এইভাবে চিন্তা করি নাই যে জিতিয়ে দিব। যখন আমি মিরাজকে বোলিংয়ে দেখছি বল দেখছি হাতে নিতে। তখন আমার মনে হয়েছে আমি যদি প্র্রথম বলে একটা ছক্কা মেরে দিতে পারি তাহলে চাপ মিরাজের ওপর। আমার লক্ষ্যই ছিল ছিল প্রথম বলে ছক্কা মারা। তো প্রথম বলেই যখন ছয় হয়ে গেছে তখন আমি চিন্তা করছি যে এই বলে যদি আরও একটা ছয় হয়ে যায় তাহলে মিরাজ আরও চাপে থাকবে। ঠিকভাবে বল করতে পারবে না। দ্বিতীয় বলে ছক্কা মেরে নিশ্চিত হয়ে গেছি এই ম্যাচ জিতে গেছি আর মিরাজ আর পারবে না। তিন নম্বর বলে মিরাজকে ফুলটাস বলে মারতে পারিনি। ওইটা কিন্ত এক হইতো কিন্তু আমি রান নেইনি। কারণ আমার ওই পাশে ছিল শহিদুল। শহিদুল পারবে কিনা আমি জানি না কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে যে আমি পারব।'

কোয়ারেন্টাইনের সময় প্রথম ২ মাস বসেই ছিলেন আরিফুল। কিন্তু এরপর মনস্থির করেন এই সুযোগটাকে কাজে লাগাবেন। এখান থেকেই শুরু হয় তার নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার যাত্রা। প্রতিদিন এক ঘন্টা রানিংয়ের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনেন রংপুরের এই ক্রিকেটার। সেই সঙ্গে নিয়ম মেনে জীবন-যাপন করে ওজন হ্রাস করেন ১২ কেজি।

আরিফুল বলেন, 'কোয়ারেন্টাইনে অনেক পরিশ্রম করেছি। ওজন কমিয়েছি ১২কেজি। শুরুর দুই মাস বাসার ভেতরেই ছিলাম। এরপর আর বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। তারপর রানিং শুরু করলাম। সঙ্গে ভারতীয় কিছু খেলোয়াড়ের ভিডিও দেখলাম। যেমন হার্দিক পান্ডিয়া-লোকেশ রাহুল ওরা কি কি ফলো করে। ওরা কি কি ট্রেনিং করে, কি করলে ফিটনেস ভালো হবে। ভাবলাম ক্রিকেট ছাড়ার পর চিন্তা না করতে হয় যে আরও একটু করলে মনে হয় ভালো খেলতে পারতাম। এই চিন্তা থেকেই আসলে ফিটনেসের কাজ শুরু করলাম। দেখলাম যে আমার ক্রিকেটেই খেলতে হবে ভালো খেলি আর খারাপ খেলে আমার তো আর পড়াশোনা নাই যে আমি চাকরি করে খাব'।

'এজন্য চিন্তা করলাম যে আমার এটাই করে খেতে হবে। পারফর্ম ভালো করতে যা যা করা দরকার ইনশাআল্লাহ সব করব। তারপরে রোজার মাস আসলো তারপরও রানিং করি। রাত ১২ টার দিকে রানিং শুরু করতাম সেহরি খেয়ে তারপরেই ঘুমাতাম। এক ঘণ্টার মতো রানিং করতাম। আমরা চেয়েও ভারতীয় বা বিদেশি কোন ক্রিকেটারের মতো হতে পারব না। কারণ আমরা যে ইনকাম করি তা ভারতীয় খেলোয়াড়ে বা কোন বিদেশি ক্রিকেটারের ধারের কাছে নয়। ওরা কোটি কোটি টাকা নিজের শরীরের পেছনে খরচ করে। সত্যিকার অর্থে আপনি পারবেন না ওদের খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে। তারপরও চেষ্টা করছি যে ভাতটা একটু কম খাওয়ার, যদিও চা খাই তবু চিনি খাইনি। তারপর রুটি-সালাদ খেয়ে থেকেছি। ভাত একেবারে কম খাওয়ার চেষ্টা করেছি আর ডিম খেয়েছি। ১২ কেজি কমাতে আমার প্রায় ৩ মাসের মতো লাগছিলো।'

নিজেকে পরিবর্তনের মিশনে নামা আরিফুলকে অবশ্য উৎসাহ পেয়েছেন মাহমুদউল্লাহর কথায়। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কের পরামর্শে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি সঙ্গে পেট এবং উরুর শক্তি বৃদ্ধি নিয়েও কাজ করেছেন লকডাউনে। তিনি আরও বলেন, 'না আমি আসলে ওইভাবে পেশী শক্তি নিয়ে সেভাবে কাজ করিনি। আমি চেয়েছি শরীরে শক্তি বাড়াতে। পেট এবং উরুতে শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। রিয়াদ ভাইয়ের কাছে একটা কথা শুনছিলাম যদি বড় পাওয়ার হিটার হতে চাই তাহলে পেট শক্ত করতে হবে এবং নীচের অংশ ঠিক করতে হবে। উরু শক্ত বাড়াতে হবে, ওইসব চিন্তা থেকেই আসলে চিন্তা করে দেখলাম যে আমার যেহেতু মাসল পাওয়ার ঠিকই আছে আরও আনতে গেলে পেট শক্ত করতে হবে লোয়ার পার্ট শক্ত করতে হবে। সেই অনুযায়ী আমি কাজ করতাম।'

মাঠের লড়াইয়ে ভালো করার পরও মনে আক্ষেপ রয়ে গেছে আরিফুলের। এক বছর পূর্বেও জাতীয় দলে খেলার পরও কেন 'ডি' গ্রেডে রাখা হল এর উত্তর জানা নেই এই ক্রিকেটারের। তার সঙ্গে টেস্ট অভিষেক হওয়া নাজমুল ইসলাম অপুও ছিলেন এই গ্রেডে। এছাড়া শাহরিয়ার নাফিস, সোহরাওয়ার্দী শুভ, জুনায়েদ সিদ্দিকি, শুভাগত হোম এবং মোহাম্মদ আশরাফুলদের মতো ক্রিকেটাররাও ছিলেন এই গ্রেডে।

এই প্রসঙ্গে আরিফুল বলেন, 'এই সময়টায় আসলেই খারাপ লেগেছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ লেগেছে একবছর আগেও জাতীয় দলে ছিলাম, কিন্তু এরপরও আমাকে ডি গ্রেডে রাখা হল। এই ব্যাপারগুলো কষ্ট দেয় কারণ আপনি জাতীয় দলে খেলছেন, তারপরও ডি গ্রেডের মধ্যে আপনাকে রাখলো। টি-টোয়েন্টি বা যেটাতেই আপনি খেলেন না কেন, এখানে তো আমার ভালো অঙ্কের অর্থ পাওয়া প্রাপ্য। সেই জায়গাতে আপনাকে রাখছে ডি’তে। এই জন্যই আসলে খারাপ লাগছে যে ডি গ্রেডে রাখলো?'