বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ

রিয়াদের দেয়া ফ্রি লাইসেন্স, খুলনার শিরোপা ও জহুরুলের অসন্তুষ্টি

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 17:36 মঙ্গলবার, 22 ডিসেম্বর, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

লম্বা ক্যারিয়ারে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দুটোই দেখেছেন জহুরুল ইসলাম অমি। বয়স ৩৫ ছুঁলেও এখনো হেসে যাচ্ছে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের ব্যাট। জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে লড়েছেন ইনজুরির সঙ্গে, ছিল পারিবারিক সমস্যাও। তবে সময়ের সঙ্গে এসব পেছনে ফেলেই সামনে এগিয়েছেন রাজশাহীর এই ক্রিকেটার।

জীবনে উত্থান-পতন তো মেনে নিতেই হবে। জহুরুলও তাই করেছেন। বাজে সময়ে স্রোতের জোয়ারে গা ভাসিয়ে এসেছেন এতোদূর। এখন শুধু অপেক্ষা শেষটা সুন্দর করার। ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মতি খেললেও দেশের এই ব্যাটসম্যান সর্বশেষ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন ২০১৩ সালে। গেল বছর আফগানিস্তান সিরিজের আগে জাতীয় দলের প্রাথমিক স্কোয়াডে ডাক পেলেও সুযোগ হয়নি খেলার। তাতেও আক্ষেপ নেই তাঁর।

করোনার প্রকোপে লম্বা সময় দেশের ক্রিকেট যখন থমকে জহুরুলও তখন ক্যারিয়ারের শেষটা কিভাবে করবেন তা নিয়ে শঙ্কায়। কারণ মহামারীর মাঝে ক্রিকেট ফের কবে ফিরতে যাচ্ছে তা জানা ছিল না কারও। তবে এই করোনার মাঝেই বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপের পর বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ আয়োজন করে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।

তিন দলের ৫০ ওভারের টুর্নামেন্টে সুযোগ না পেলেও পাঁচ দলের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে সুযোগ পান মাঠে ফেরার অপেক্ষায় থাকা জহুরুল। প্লেয়ার্স ড্রাফট থেকে এই ব্যাটসম্যানকে দলে নেয় জেমকন খুলনা। বিপিএলেও এর আগে এই ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে খেলার অভিজ্ঞতা ছিল তার।

খুলনার হয়ে মাঠে নেমে শিরোপা জয়ের সঙ্গে হয়েছেন দলটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী ব্যাটসম্যান। ২৫৪ রানের সঙ্গে ছিল দুটি হাফ সেঞ্চুরি। প্রথম কোয়ালিফাইয়ারে খেলেছেন ৮০ রানের ইনিংস। তারপরও মন ভরেনি ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। 

টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে রান খরায় ভুগেছেন জহুরুল। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ৩১ করলেও পরের ৪ ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছে মাত্র ২১ রান। এখানেই আফসোস রাজশাহীর এই ক্রিকেটারের। এরপর ছন্দে ফিরে দলকে ফাইনালে নিলেও ব্যক্তিগত রান ৩০০'র ওপর করতে পারলে আরও খুশি হতেন জহুরুল।

সেই সঙ্গে ফাইনালে প্রথম বলেই বাজে শট খেলে আউট হওয়ার আক্ষেপ তো আছেই। ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে জহুরুল বলেন, 'না পারফরম্যান্সটা আর একটু ধরাবাহিক হলে ভালো হতো, আরও একটু আশা ছিল। যেহেতু এটা বিপিএল না, এখানে আসলে সবই ডমেস্টিক প্লেয়ার এখানে পারফর্ম করাটা বিপিএলের থেকে সহজ। যেটা আশা করেছিলাম সেটা হয়নি সুযোগ ছিল কিন্তু অনেকদিন ম্যাচের বাইরে। অনুশীলনের ভেতরে ছিলাম কিন্তু ম্যাচ প্র্যাক্টিসটা আসলে কম ছিল। আমরা রাজশাহী থেকে যারা ছিলাম এক সঙ্গে রাজশাহী ডিভিশন টিমের সবাই মিলে খুব ভালো ছন্দে ছিলামে।' 

'বাংলাদেশে হয়তো ঢাকার পরে আমাদের আমাদের ট্রেনিংয়ের অবস্থান। কিন্তু সেই দিক থেকে আর কি ভালো হয়নি এই জন্য খুব খুশি না আমি। আর বলব যে আসলে টুর্নামেন্ট অনুসারে যেটা হয়েছে যে টুর্নামেন্টের মাঝখানে চারটা ম্যাচ একটু রান করেছি। কিন্তু এটা আসলে হওয়া উচিত ছিল আরও একটু বেশি চারটা ম্যাচের জায়গায় যদি আমি ছয়টা ম্যাচে রান করতাম তাহলে ভালো লাগতো। আর দুইটা ম্যাচ ভালো খেললে হয়তো আমার রানটা ৩০০'র বেশী হতো। এই টুকুই মিস করছি যে ফাইনালে একটা বাজে আউট হয়েছি, কিছু কিছু ইনিংস নিয়ে কিছুটা অনুসুচনা আছে। গাজীর সঙ্গে ১/২ রান করে একটা ইনিংস নষ্ট করেছি। এইরকম কিছু ইনিংস আমি যদি ৩০ রান বেশী করতাম তাহলে একটু সন্তুষ্ট হতাম, সিক্সটি রান যদি প্লাস করতে পারতাম। এই টুুকুই আর কি এছাড়া বেশি কিছু না' আরও যোগ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপের শুরুতে ওপেনিং এবং মিডল অর্ডার নিয়ে বেশ ভুগতে হয়েছিল জেমকন খুলনাকে। পাওয়ার প্লে'তে দ্রুত উইকেট হারানোর সঙ্গে প্রথম ১০ ওভারে প্রথম সারির ব্যাটসম্যানরা ফিরে যেতেন প্যাভিলিয়নে। সমাধান পেতে সাকিব আল হাসানকে দিয়েও ওপেন করিয়েছিল খুলনা। কিন্তু তাতেও ইতিবাচক ফলাফল না পেয়ে বেঞ্চ শক্তি কাজে লাগায় মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল।

দলটির ৫ম ম্যাচ থেকে ওপেনিংয়ের দায়িত্ব কাঁধে নেন জাকির হাসান এবং আগের কয়েক ম্যাচে মিডল অর্ডারে খেলা জহুরুল ইসলাম অমি। বরিশালের বিপক্ষে এই ম্যাচে জহুরুল মাত্র ২ করে ফিরলেও জাকির পান হাফ সেঞ্চুরি এবং এই প্রথম খুলনা প্রথম ওভারে হারায় মাত্র এক উইকেট। সেই সঙ্গে ৪৮ রানের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে মাহমুদউল্লাহবাহিনী।

নিজেদের ষষ্ঠ ম্যাচে হেসে ওঠে আরেক ওপেনার জহুরুল ইসলামের ব্যাটও। এই ম্যাচেও খুলনা জয়ী তবে এরপরের দুই ম্যাচে আবার ফলাফল দলটির বিপক্ষে। তবে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বেক্সিমকো ঢাকার বিপক্ষে হাফ সেঞ্চুরি পান জহুরুল। এরপরের ম্যাচে চট্টগ্রামের বিপক্ষে ৮০ রানের অনবদ্য ইনিংস খেললেও ফাইনালে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে হতাশ করেছেন তিনি।

শুরুর দিকে মিডল অর্ডারে খেলার পর করে ওপেনিংয়ে দায়িত্ব পেয়েই নিজেকে ফেরাতে পেরেছেন জহুরুল। কারণ ঘরোয়া ক্রিকেটেও শুরুর দিকে ইনিংস সামলানোর অভিজ্ঞতা ছিল তার। সেই সঙ্গে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহর দেয়া ফ্রি লাইসেন্স আরও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে ৩৪ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যানকে। 

ওপেনিংয়ে খেলার প্রসঙ্গে জহুরুল বলেন, 'আমি যেহেতু ওপেনার ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন জায়গাতে খেলেছি। বিপিএলও শুরুর দু-তিন বছর আমি ওপেনিং ব্যাটসম্যান ছিলাম। চারিদিনের ম্যাচে আমি বরাবরই ওপেন করি, নিচে খেলেছি রাজশাহী দলের প্রয়োজনে দুই একটা বছর। ঢাকা লিগেও ওপেন করি সবসময়। তো রিয়ােদের সঙ্গে আমার আলাপ হয়, রিয়াদই আমাকে বলল তুই ওপেন কর। বলল আমার কোনো সমস্যা নাই তুই চেষ্টা কর। ও আমাকে বলল যে তুই ব্যাক টু ব্যাক দুইটা ম্যাচে ওপেন করবি, দুই ম্যাচে আমি কোনো ডিস্ট্রার্ব করব না। টিমের শুরুটা অন্তত এক উইকেট কম পড়লে আমাদের জন্য ভালো হয় প্রথম ৬ ওভারে। তাছাড়া আসলে আমাদের ফিনিশার আছে আরিফুল, শামিম, শুভাগত এরা মোটামুটি শেষের ৫ ওভারে ৫০ রান করার অ্যাবিলিটি রাখে । কিন্তু আমাদের শুরুতেই যদি ওদেরকে নামিয়ে দেই ১০-১২ ওভারের সময়  তাহলে নিচের দিকে কারা খেলবে।' 

মাহমুদউল্লাহ'র কাছ থেকে ফ্রি লাইন্স পাওয়ার বিষয়ে রাজশাহীর এই ক্রিকেটার যোগ করেন, 'তো আমাদের একটা রোল দিল জাকির আর আমাকে। ৬টা ওভারে আমাদের রানটা মূখ্য না কিন্তু উইকেট যেন না পড়ে।  দ্বিতীয় ম্যাচে ৪৩ করলাম। তারপর রিয়াদ আর আমাকে চেঞ্জ করেনি। আমার উপর বিশ্বাস রেখেছিল যে ওকে দিয়ে হবে। আমাদের দলের একটা সুবিধা ছিল এরা সবাই অভিজ্ঞ। খুব বেশি সমস্যা হয়নি, মানে একটা জিনিস যখন চিন্তা করেছি সেটার উপর বিশ্বাস করেছে। অনেক দল হয় কি এক ওপেন না হলে পরে আরেকদিন আরেকজনকে নামালো এটাতে ও সেট হতে পারবে না যাকে নামাইছিল সেও ডিস্টার্ব হলো। তো এটাতে তিনটা ব্রেক হয়।' 

'আমরা দেখলাম যে শুরুতে আমরা চারটা পাঁচটা ম্যাচ গুছিয়ে উঠতে পারিনি কিন্তু পরে দেখলাম যে না টুর্নামেন্ট যত শেষের দিকে আসলো দলের সিদ্ধান্তগুলো খুব ভালো হলো। যেটা অন্য টিমের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়েছে। যেটা ট্রাই করেছে সেটা বুঝে শুনেই করেছে। ইমরুলও ওপেন করে, আমিও ওপেন করে, বিজয়ও ওপেন করে জাকিরও ওপেন করে। আপনি আসলে চয়েস করতে পারেন যে কি করতে চান, লেফটি রােইটি না দুইটা লেফটি । যেহেতু বেশিরভাগ দল অফস্পিন দিয়ে শুরু করে পাওয়ার প্লেতে অথবা দুইটা ওভার অফস্পিনার চলে তো আমাকে ওরা চয়েস করছে। বিজয়ও শুরুতে ওইভাবে রানে ছিল না, আমাকে দুইটা ম্যাচ মানিয়ে নেয়ার পর আমাকে আবার ফ্রি লাইসেন্স দিয়েছে না তুই তোর মতো খেলবি' আরও যোগ করেন তিনি।

প্রথম কোয়ালিফাইয়ারে গাজী গ্রুপের বিপক্ষে ৮০ করেও ম্যাচ সেরা হতে পারেননি জহুরুল। কারণ ৫ উইকেট নিয়ে সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলেন মাশরাফি। হয়েছিলেন ম্যাচ সেরাও। অবশ্য এতে কোনো আক্ষেপ নেই জহুরুলের। দল জিতেছে এটাই তার কাছে মুখ্য। 

জহুরুল বলেন, 'না, ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়াটা একটা ভালো লাগা এটা অবস্বীকার করব না। এর আগেও মাশরাফি আমি গতবার ১৩৬ করলাম নটআউট গাজী গ্রুপের সঙ্গে। সেদিনও মাশরাফি ম্যান অব দ্য ম্যাচ নিয়ে নেয় আবাহনীর হয়ে। ওইদিন আমি যে উইকেটে ১৩৬ করেছিলাম তখন ভেবেছিলাম আমিই হবো নিশ্চিত। কিন্তু জিনিসটা এমন হয়েছে যে মাশরাফি এমন সময় উইকেট নিছিলো গাজীর সঙ্গে এখানে আমিও চাচ্ছিলাম ওকে দিলে জিনিসটা আরও বেটার হয়। কারণ আমরা হেরেই যাচ্ছিলাম ২৩৮ রান করেছিলাম আমরা কিন্তু উইকেট ফেলতে পারছিলাম না। পরে উইকেট ভালো হয়ে গিয়েছিল, তো সেদিনও তাই হয়েছিল। আসলে লিটন আর সৌম্যের উইকেট যদি আপনি শুরুতেদ না নিতেন ২১০ রান উইকেটটা এতো ভালোি ছিল সেদিন ২১০ রান হয়ে যেতে পারতো।' 

'তারা দুইজনই ভালো ফর্মে আছে সৌম্য ব্যাক টু ব্যাক ৬২  করেছে দুইবার আবার লিটন টুর্নোমেন্টের হাইস্ট স্কোরার। তো মাশরাফি যে উইকেট ‍দুইটা নিয়েছে শুরুতে তারপর আবার তিনটা উইকেট নেয় এর মধ্যে মনে হয় মিঠুনও ছিল, মিঠুন মোসাদ্দেক।জিনিসটা হলো যে ও যে ভাইটাল ৫ উইকেট পাওয়া চার ওভার বল করে এটা কিন্তু একটা বিরাট ব্যাপার। আমি বলব ৮০ রানের থেকেও কঠিন। তো ওকে দিয়েছে এটা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নাই, ভালো লাগা যে ম্যাচটা জিতেছি। তার আগের দিনও ৫৩ করে ম্যাচ হেরেছি এটা খারাপ লাগা আর কি। তো ৮০ রান করে যদি ম্যাচ হারতাম খুব বাজে লাগতো। ম্যাচ জিতেছি এটাই অনেক  আসলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ না পাওয়াটা খুব একটা বড় বিষয় না। এটা নিয়ে কোনো কষ্ট হয়নি। কারণ ম্যাচ জিতলে আমাদের কেউ ই না কেউ পেয়েছে ম্যান অব দ্য ম্যাচ' আরও যোগ করেন জহুরুল।