বাংলাদেশ ক্রিকেট

আজকের ইরফানকে গড়েছেন যারা

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 14:44 শনিবার, 31 অক্টোবর, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

২০২০ সাল অনেকের কাছে বিষের মতো হলেও ইরফান শুক্কুরের কাছে তা নয়। ২৭ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার বছরটিকে হয়তো আজীবন মনে রাখবেন। কারণ এই বছরই যে তাঁকে নতুন করে সবার কাছে আরো একবার পরিচিত হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ফাইনাল থেকে বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপের ফাইনাল। এক বছরে দুটি ফাইনাল, একটিতে চ্যাম্পিয়ন অপরটিতে রানার্স আপ। দুই ফাইনালেই হাফ সেঞ্চুরি এবং দলের সর্বোচ্চ স্কোরার। 

বছরের শুরুতে রাজশাহী রয়্যালসের হয়ে ফাইনালের আগের ম্যাচে ৪৫ রান করেন ইরফান। শিরোপার লড়াইয়ে তিন নম্বরে নেমে খেলেছিলেন ৫২ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। এরপর ঘরোয়া লিগে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলেও, বাকিটুকু চলে যায় করোনার পেটে। মহামারীর মাঝেই ক্রিকেট মাঠে ফিরলে, ইরফান শেষটা যেখানে করেছিলেন সেখান থেকেই আবার শুরু করেছেন।

প্রেসিডেন্টস কাপে দুটি হাফ সেঞ্চুরিসহ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ইরফান। নিয়মিত ৭ নম্বরে নেমে দলের হাল ধরা এই ব্যাটসম্যান হয়েছেন টুর্নামেন্টের সেরা ব্যাটসম্যানও। তবে ইরফান এই বছরে পাদপ্রদীপের আলোয় আসলেও চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর অভিষেক হয় ২০১০ সালে। তার আগে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যুব টেস্ট ও ওয়ানডে খেলেছেন। তবে জায়গা হয়নি বিশ্বকাপের মূল স্কোয়াডে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলে গেলেও, পারফরম্যান্স দিয়ে নজরে আসতে পারছিলেন না ইরফান শুক্কুর। তবে এরপরও হাল ছাড়েননি তিনি। হাই পারফরম্যান্স দলের সঙ্গে তিন বছর কাজ করেছেন এই লড়াকু ক্রিকেটার। নিজের ব্যাটিংয়ের খুঁটিনাটি সমস্যা সব কিছু নিয়েই কাজ করেছেন, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।

তবে এই ইরফানের বদলে যাওয়ার যাত্রাটা শুরু হয় সতীর্থ লিটন দাসের হাত ধরে। ২০১৯ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে মোহামেডান দলে ছিলেন দুজনই। এক সঙ্গে ওপেনও করতেন তাঁরা। প্রিমিয়ার লিগে একটি ম্যাচ চলাকালীন ইরফানের সমস্যা ধরিয়ে দেন জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান লিটন।

নিজের বদলে যাওয়ার গল্প শোনাতে গিয়ে সতীর্থ লিটনের প্রসঙ্গে ইরফান বলেন, 'লিটন আমার সঙ্গে খেলেছিল মোহামেডানে। তখন লিটন আমাকে বলেছিল আপনি ঠিকই ৬০ বলে ৪০ রান করছেন কিংবা ৬০ বলে ৪৫ রানের ইনিংস খেলেছেন। এসব ঠিক আছে, কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে যে উইকেটে খেলা হয় সেখানে আপনাকে ৬০ বলে ৬০ করতে হবে। তখন আমাকে ও বলেছে এই বলটা কি এভাবে খেলতে পারতেন না? ও আমাকে অনেক গাইড করেছে যেহেতু সে আমার সঙ্গে ওপেন করতো। ও কিন্তু আমার সঙ্গে ৬-৭ ম্যাচে ওপেন করেছে। বলতো এই বলটা কি এভাবে খেলা যেত না। আমি বলতাম, দোস্ত আমি পারছিনা রে।' 

প্রিমিয়ার লিগের সেই মৌসুমে ইরফান ১৬ ম্যাচে ৪৬৩ রান করেন। ৪টি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকানো এই ব্যাটসম্যান নিজের ব্যাটিং নিয়ে আরও যোগ করেন, 'তখন আমি চিন্তা করলাম লিটন করতে পারছে আমি কেন পারবো না। আমি তখন এটা বুঝতে পেরেছি। প্রিমিয়ার লিগের শেষে কিন্তু আমাদের অফ সিজন চলে। তখন আমি এগুলো নিয়ে কাজ করেছি। আমি এগুলো কাজে লাগানো শুরু করেছি অনেক পরে। প্রায় ৭-৮ মাস পরে। সাথে সাথে আমি সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করিনি। কারণ নিজেকে বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার অভিধানে নতুন কিছু শট যোগ করতে চেয়েছি। তাই আমি চেয়েছি একটু দেরি করে হলেও পারফেকশন যেন আসে। এখনও পুরোপুরি আসেনি, তবে মোটামুটি এসেছে। উন্নতি করার অনেক জায়গা আছে।'

একই বছরের শেষের দিকে এসে বিপিএলে আন্দ্রে রাসেল-শোয়েব মালিকদের পেয়েছিলেন ইরফান। শুরুর দিকে ম্যাচ খেলার সুযোগ না হলেও দলের সঙ্গেই থাকতেন তিনি। পাশাপাশি রাসেল-মালিকদের দেখে আরও অনুপ্রেরণা অর্জন করতেন যা পরবর্তীতে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছে ইরফানকে। নিজের ভেতর হার না মানা মনোভাব আনার চেষ্টা শুরু সেখান থেকেই।

ইরফান বলেন, 'ওরা তো কিংবদন্তি টাইপ খেলোয়াড়। ওদের কথা হলো কখনও হাল ছাড়ব না। যেই মুহূর্তেই খেলাটা হোক না কেন রাসেল এবং শোয়েব মালিক হাল ছাড়তে চায় না। ওদের এই জিনিসটাই ভালো লেগেছে। আমি এটা আমার চরিত্রের মাঝে যোগ করতে চাইছি আরকি। ওদের কিছু জিনিস আমার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।'

বিপিএল চলাকালীন ম্যাচে সুযোগ না পেলেও হতাশ হতেন না ইরফান। দেশিও কোচদের সাহায্য নিয়ে একাই অনুশীলন করতে চলে আসতেন মাঠে। দল টিম হোটেলে থাকলেও মাঠে এসে নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা থাকতো ইরফানের মাঝে। এই প্রসঙ্গে বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান বলেন, 'বিপিএল খুব দ্রুত গতির টুর্নামেন্ট। এখানে অনুশীলনের সুযোগ খুব কম থাকে। কোচের কাছ থেকে আদায় কম করা যায়। যতটুকু করা যায় তাও অনেক কম। কথাবার্তা বলে যতটুকু নেয়া যায়।'

'বিপিএলে রাজিন ভাই আর হান্নান ভাই আমাকে অনেক বুস্ট আপ করেছে। শুরুর দিকে একদমই ম্যাচ খেলতে পারিনি। আমাদের টিমের প্র্যাক্টিস থাকতো না তাও আমি যদি বলতাম অনুশীলন করবো রাজিন ভাই, হান্নান ভাই তাঁরা আমাকে সুযোগ করে দিতেন। আমি গিয়ে গিয়ে একা অনুশীলন করেছি। ম্যাচের পরের দিন কিন্তু সচরাচর ডে অফ থাকে। আমি একা অনুশীলন করবো, তাও পুরো কোচিং স্টাফ গিয়েছে, এমনও হয়েছে। ওরা অনেক সাপোর্ট দিয়েছে।'

সেই মৌসুমে ব্যাটিংয়ে যেসব ভুল হচ্ছিলো তা শুধরাতে ইংল্যান্ডের ওয়াইশ শাহ'র শরণাপন্ন হন ইরফান। চট্টগ্রামে অনুশীলনের সময় দেখা গেছে রাজশাহী রয়্যালসের এই কোচ ইরফানের পেছনের পা ধরে মাটিতে নামিয়ে রাখছেন আর তিনি শট খেলছেন। মূলত পা উঠে যাওয়ার কারণে এই ব্যাটসম্যানের শট ৫-১০ মিটার কম দূরে যেত। এই সমস্যার সমাধান করে দিয়ে গেছেন শাহ, যার চিত্র দেখা গেছে প্রেসিডেন্টস কাপেও। এছাড়া আন্দ্রে রাসেলের থেকে ব্যাট সুইং সম্পর্কেও ধারণা নিয়েছিলেন তিনি।

ইরফান বলেন, 'এটি একটি টেকনিক্যাল দিক। আমার যখন পিছনের পাটা উঠে যাবে আমার শটে তখন জোর থাকবে না। আমি শট খেলছি কিন্তু ওয়ান ড্রপে ফোর হচ্ছে। দুই রান তিন রান এমন হচ্ছে। ছয় মারার যে সুযোগটা, ব্যাক ফুটটা যদি নামানো থাকে তাহলে আমার শটটা ৫-১০ মিটার বড় হবে। আমার শটটা আরও বড় হবে। এখন যে শটটা ৬০ বা.৬৫ মিটার হচ্ছে সেটা হয়তো ৭৫-৮০ মিটার হবে। যদি আমার ব্যাকফুটটা স্ট্যাবল থাকে। এজন্য তিন চারদিন আমাকে নিয়ে সে কাজ করেছে। আর আন্দ্রে রাসেল বলেছিল ব্যাট আরও তাড়াতাড়ি চালাতে যেন সুইংটা দ্রুত হয়, এতে আমি পয়েন্ট এক সেকেন্ড আগে হয়তো শটটা খেলতে পারব।'

একজন ক্রিকেটার তখনই নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারেন যখন তার মানসিকতায় পরিবর্তন আসে। ইরফানও একই কাজটাই করেছিলেন। মানসিকভাবে নিজেকে শক্ত করেছেন, নিজের ভেতর বিশ্বাস গড়েছেন যে তিনি পারবেন। সেই সঙ্গে ফিটনেসেও বড় রকমের পরিবর্তন এনেছেন যেন উপকার আসে, নিজের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন, কোনটা তার জন্য শরীরের জন্য ঠিক হবে।

ইরফানের ভাষ্যমতে, 'প্রথম পরিবর্তনটা হচ্ছে আমি মানসিকভাবে খুব শক্ত হয়েছি এখন। শক্তি আর স্কিল প্র্যাক্টিসের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস আসছে। নতুন কোনো শট যদি আমি প্র্যাক্টিস করি ওটা মাঠে এক্সিকিউট করতে পারবো। এই আত্মবিশ্বাসটি এসেছে। প্রথমে বলবো আমার মানসিক শক্তিতে অনেক উন্নতি হয়েছে। আমি ফিট ছিলাম। কিন্তু এতটা ফিট ছিলাম না। মানে ধারাবাহিক ছিলাম না। সম্প্রতি আমি আমার বডি ম্যানেজম্যান্ট আর ফিটনেস নিয়ে অনেক কাজ করছি। ভিন্ন কিছু করছি, বিশেষ করে আমার ডায়েট নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছি। এমন না যে পুরো ডায়েট করছি। কিন্তু আমি পরীক্ষা করে দেখছি কোন জিনিসটা আমার জন্য ভালো কোনটা খারাপ। ডায়েটিং নিয়ে কাজ করছি।'

প্রেসিডেন্টস কাপ শেষে টিম হোটেল থেকে সোমবার সকালেই নিজের শহর চট্টগ্রামে ফিরে গেছেন ইরফান। দুই সপ্তাহের বেশি জৈব সুরক্ষা বলয়ে ছিলেন তিনি। তবে বদ্ধ জীবনের এমন অভিজ্ঞতার মাঝেও ইতিবাচক কথাই বললেন ইরফান। তিনি বলেন, 'প্রথম দিকে অনেক বেশি কষ্ট হইছে। আমরা খেলোয়াড়রা। এখানে তো সবকিছুই এক জায়গায়। জিম সেশনটা ভালোভাবে করা হইছে, তারপর রিকভারি সেশন।রিফ্রেশমেন্টের জন্য আমাদের ওখানে কিছু কমন রুম ছিল। যেমন টেবিল টেনিস খেলা যাইতো। ওইটাই রিফ্রেশমেন্ট ছিল আর কী। মানে বেসেকালি নিজেকে সময় দেয়া হইছে ভালোই। কিন্তু এটা একটু খুব কষ্ট ছিল।'

এদিকে ব্যাটসম্যানের পাশাপাশি ইরফান একজন উইকেটরক্ষকও। প্রেসিডেন্টস কাপের দুই ম্যাচ ছাড়া সুযোগ হয়নি কিপিংয়ের। তবে নিজের এই ভূমিকায় আপাতত সন্তুষ্ট থাকলেও উন্নতির জায়গা আছে বলে মনে করছেন তিনি। জানিয়েছেন বেশি সুযোগ আসলে কিপিংয়ের উন্নতিটা আপনা আপনিই হয়ে যাবে।

ইরফান বলেন, 'কিপিং নিয়ে আমি কাজ করছি। আমি কিপিং নিয়ে সন্তুষ্ট। অবশ্যই এটাতে উন্নতির জায়গা আছে। বিসিবি প্রেসিডেন্টস কাপে আমি ওইভাবে সুযোগ পাইনি। হঠাৎ করে মুশফিক ভাই ইনজুরিতে পড়লো, আমি সুপার সাব ছিলাম তাই কিপিং করতে নেমে গেছি। কিপিংয়ে ভালো অবস্থায় আছি। জাতীয় লিগে তো আমি প্রথম উইকেটরক্ষক হিসেবেই খেলি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যদি আপনি প্রথম উইকেটকিপার হিসেবে খেলেন আপনার কিপিংটা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। আশা করছি সামনে সুযোগ আসবে।'