সাকিবের প্রত্যাবর্তন

রাজা ফিরছেন সিংহাসন দখলের মিশনে

মাহমুদুল হাসান বাপ্পী

মাহমুদুল হাসান বাপ্পী
প্রকাশের তারিখ: 23:52 বুধবার, 28 অক্টোবর, 2020

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

'লাইফ ইজ লাইক অ্যা বক্স অফ চকলেট। ইউ নেভার নো হোয়াট ইউ আর গন্না গেট।' এই সংলাপের দৃশ্যটা কি মনে পড়ে? ফরেস্ট গাম্প বসে আছেন এক বাস স্টেশনে। পাশে এক কৃষ্ণাজ্ঞ তরুণী। ফরেস্ট বলেই যাচ্ছেন, তিনি পড়ে যাচ্ছেন ম্যাগাজিন। গুরুত্ব দিচ্ছেন না পাশের লোকের কথায়। গাম্প থামছেন না, বলেই যাচ্ছেন।

তার পুরো জীবনই এমন। ছোটবেলায় ঠিকঠাক হাঁটতে পারতেন না। এরপর একদিন মার খাওয়ার ভয়ে যে দৌড় শুরু করলেন, আর থামলেন না। এরপর জিতে গেলেন একটার পর একটা লড়াই। যেখানে গেলেন, সফল হলেন অবলীলায়।

সাকিব আল হাসান কি ফরেস্ট গাম্প? হতে পারেন, নাও পারেন। সাকিব বোকাসোকা নন, স্মার্ট। তবে গাম্পের সঙ্গে তার মিল সাফল্যে। লড়াইয়ের স্পৃহায়। যুদ্ধের ময়দানে শেষ ভরসা হিসেবে লড়ে যাওয়ায়। প্রাণপনে চেষ্টা করে নিজ দেশকে উদ্ধার করায়।

সাকিবের জীবন যদি সিনেমা হতো, বক্স অফিস কি হিট করতো? হয়তো করতো অথবা না। তবে রোমাঞ্চ ছড়াতো নিশ্চিত। হল ছেড়ে বেড়িয়ে আসার সময় হৃদয়ে তৃষ্ণা জমে থাকতো না কারো। আপনি নায়ক হিসেবে পর্দায় দেখতেন এমন একজনকে, যিনি কোনো কিছুতেই পাত্তা দেন না।

নিজের ইচ্ছেই তার কাছে সব। 'ডোন্ট কেয়ার' রূপ আবার বদলে ফেলেন মাঠে নামলে। ফরেস্ট গাম্পের মতো লড়াইয়ে গেলে। যেন দুনিয়ার সবকিছু তার কাছে তুচ্ছ তখন। বল করাটা গুরুত্বপূর্ণ, পরের বল কেমন হবে সে চিন্তা না। ব্যাটিংটাই জরুরি, আউট হলে কী হবে ভাবনায় নেই। সাহসী ভূমিকায় হাজির হন, দলকে উদ্ধার করেন খাদের কিনারা থেকে।

আমাদের চেনা-পরিচিত সাকিব এমনই। ভয়ডরহীন, কারো কারো কাছে খাম খেয়ালি, বিস্ময়েরও। তবুও তার কাছ থেকে এত বড় চমকের কল্পনা কি করেছিল কেউ? সাকিব অসংখ্যবার অভিভূত করেছেন, বিস্ময় জাগিয়েছেন নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে। তবে সাকিবের কোনো একটা কাজে এতটা আশ্চর্য বোধ হয় কেউ হননি।

২৯ অক্টোবর ২০১৯।

আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে। সূর্য তার নিয়ম করে পূর্বাকাশে উঠে গেছে। ধীরে ধীরে উজ্জল হচ্ছে তার আলো। শীত তখনো আসেনি। আসবে আসবে করছে। হীমভাব আছে সকালটাতে। সবই ঠিকঠাক রোজকার মতো। অথচ কেমন বিষণ্নতায় ভরপুর চারদিকে।

মিরপুর শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের আশপাশ সাংবাদিকদের দখলে। অসংখ্য ক্যামেরার ল্যান্স, বুম, মাইক্রোফোন, মোবাইল, ল্যাপটপের ছড়াছড়ি। এমনটা হতেই পারে। হরহামেশাই এখানে দেখা মিলে এমন দৃশ্যের। তবে বেশির ভাগ দিনেই বাংলাদেশের খেলা থাকলে।

আজ খেলা নেই, তবুও এই ভর্তি থাকার কারণ সাকিব আল হাসান। এক পত্রিকার সংবাদে সারাদেশে তোলপাড়। এরপর থেকেই স্টেডিয়ামের ভেতরে সাংবাদিকেরা দল বেঁধে ভীড় করেছে। বাইরে সাকিবের সমর্থকরা আসতে শুরু করেছেন তখন।

এর আগেও অসংখ্যবার ক্যামেরা তাক করেছে সাকিবের দিকে, তিনি তাকিয়ে থেকেছেন। কখনো হেসেছেন, ক্যামেরার ল্যান্সে তাকে খুঁজে পেয়ে খুশি হয়েছেন ফটোগ্রাফাররা। সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনটা পাওয়া গেল বলে।

এই এক সপ্তাহ আগেও। সাকিব নিজেকে নিয়ে গেছেন আরেক ধাপ উপরে। তারও আগে, বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অলরাউন্ডার ভূমিকাতে জানান দিয়েছেন নিজেকে। বিশ্বকাপে অষ্টম হওয়া একটা দলের জন্য একা হাতে লড়েছেন। ওই বিশ্বকাপে কী করেননি সাকিব!

ট্রেনলাইনে ছুঁটে গেছে একটা একটা করে বগি। সাকিব লড়াই চালিয়েছেন। ইঞ্জিন হয়ে সামনে গেছেন। কিন্তু বিশ্বকাপ শেষে দেখেছেন তিনি আসলে দাঁড়িয়ে আছেন শূন্যতার শোকসভায়। যেখানে কেউ কোথাও নেই। একটাও বগি নেই ইঞ্জিনের সঙ্গে ছুঁটে চলার লড়াইটা চালানোর। তাই বিশ্বকাপে তার অতিমানবীয় ৬০৬ রান আর ১০ উইকেট দিয়ে দেশের জন্য করতে পারেননি তেমন কিছুই।

এরপর দেশে এসে করলেন সতীর্থদের জন্য, অনুজ ক্রিকেটারদের জন্য, আদতে আমাদের ক্রিকেটের জন্য। ঐতিহাসিক এক ধর্মঘটের ডাক দিলেন। ক্রিকেটারদের স্বার্থ উদ্ধারে মাঠের সেরা নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন নেতা হিসেবে।

অথচ এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব কেমন গোলমেলে হয়ে গেল। বিসিবি ভবনে ঢোকার দুই নম্বর গেটটা ঠিকঠাক আছে। তবুও সাকিব সেখান দিয়ে ঢুকতে পারছেন না। তার সমর্থকরা 'সাকিব', 'সাকিব' চিৎকার করছেন ওই গেটে। সাংবাদিকদের ভীড়ও তাই সেখানে।

সাকিব বেছে নিলেন এক নম্বর গেটকে। যেন বড্ড তাড়াহুড়ো তার। শর্টকাটে কাজ সেরে নিজেকে আড়াল করার প্রাণপন চেষ্টা। তিনি মিরপুরে পা দেয়ার আগেই নিশ্চিত হয়েছে, সাকিব মাঠে ফিরতে পারবেন না আগামী এক বছরে।

ভারতীয় এক জুয়াড়ি ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সাকিব গ্রহন করেননি, নিয়ম অনুযায়ী জানানওনি আকসুকে। তিনবার একই কাজ করেছেন। আইসিসি তাই এক বছর স্থগিত করে দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছে।

এসব সবাই জেনে গেছে ততক্ষণে। সাকিব জেনেছেন, পুরো দেশের মানুষও। এক অদৃশ্য মেঘে ছেয়ে গেছে মিরপুরের আকাশ। তার ছাপ আছে সাকিবের মুখেও। ওই বিধ্বস্ত চেহারাতেই আসলেন সাদা এক গাড়িতে করে। তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। শেরে বাংলার প্রতিটা কোণ তার পরিচিত। তবুও সেদিন কেমন যেন অচেনা, অজানা সব। ওই বিধ্বস্ত সাকিবের মতোই।

সাকিব গাড়ি থেকে নেমে বিসিবি কার্যালয়ের তিন তালায় রওনা করলেন। তার পেছনে শত শত ক্যামেরা। সাকিব লিফটে উঠতেই যাদের ব্যস্ততা বেড়ে গেল। সংবাদ সম্মেলন রুমে যাওয়ার। দেশ সেরা এই ক্রিকেটারের মুখটা যে আজ বড্ড জরুরি।

সেটা আর খুঁজে পাওয়া গেল না তখন। সাকিব ঢুকে গেলেন লক করা এক রুমে। সেখানে বিসিবি সভাপতির সঙ্গে বসেছেন। বেড়িয়ে এলেন মিনিট পনেরো পরে। আইসিসি সাকিবের নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে যেই বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল সাকিবের বক্তব্য ছিল সেখানে।

ইংরেজিতে ছিল ওখানে, নাজমুল হাসান পাপনকে সঙ্গে নিয়ে আসা সংবাদ সম্মেলনে পড়লেন বাংলাতে। পার্থক্য কেবল এটুকুই। প্রশ্নের জবাব দিলেন না। যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন। যেন মন আর সইতে পারছিলো না। অচেনা মিরপুরটা ভালো লাগছিল না একটুও।

সংবাদ সম্মেলন শেষ হলো। বিসিবি সভাপতি কথা বললেন একটু-আধটু। এমনিতে মুখটা কালোই ছিল সাকিবের, এক সাংবাদিকের রসিকতায় হেসে ফেললেন। যেন জানাতে চাইলেন, শত প্রতিকুলতাতেও তিনি লড়তে পারেন। জয় করতে পারেন সব।

সাকিব এক বছর সেটা পারবেন না। সেটা তিনি জানেন। ওই বেদনা তিনি টের পান। মিরপুর ছেড়ে যান হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সঙ্গী করে। হয়তো মনে মনে সংকল্প করে যান আবার ফিরে আসার। আরেকটু ভালোভাবে। উপলবদ্ধিটা টের পান, 'মেঘে ঢেকে যাওয়া আকাশ যতটা সুন্দর, বিষণ্নতায় ডুবে থাকা মন ততটাই কুৎসিত।'

আবারও একদিন এই মিরপুর স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে যখন 'সাকিব', 'সাকিব' রব উঠবে। তখন হয়তো তার অবচেতন মনে বেজে উঠবে ফরেস্ট গাম্প সিনেমার সেই ডায়লগটা। নাম বদলে যেটা হবে 'রান সাকিব। রান।' তিনি দৌড় শুরু করবেন ব্যাট হাতে, বল হাতে কিংবা ফিল্ডিংয়ে।

অহম মাটিতে নামিয়ে আনবেন ইংল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ার। টেস্টে তাদের হারিয়ে দেবেন আরেকবার। অলরাউন্ডার র্যাংকিংয়ে আবার শীর্ষে চলে আসবেন সবাইকে হটিয়ে। এই সিংহাসনটা যে তার, সেটা জানান দেবেন বারবার।

বিশ্বকাপে হয়তো আরেকবার অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স করবেন। কে জানে, হয়তো ছুঁয়ে দেখবেন স্বপ্নের সেই ট্রফিটা। এরপর মিরপুরের গ্যালারিতে, ঢাকার অলি-গলি কিংবা একেবারে অজো পাঁড়া গায়ে চোখ মুছতে মুছতে কেউ একজন বলে উঠবে, 'লাইফ ইজ লাইক অ্যা বক্স অফ চকলেট, ইউ নেভার নো। হোয়াট ইউ গন্না গেট।'