|| ডেস্ক রিপোর্ট ||
বড় ভুলই করেছিলেন সাকিব আল হাসান। জুয়াড়ির কাছ থেকে একাধিকবার ম্যাচ পাতানোর প্রস্তাব পেয়েও তিনি ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল বা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) জানাননি। আইসিসির ভাষ্য মতে এটা মারাত্মক অপরাধ। যদিও এই অপরাধের জন্য ভুল স্বীকার করে জবানবন্দী দেন বাংলাদেশের সাবেক এই অধিনায়ক।
তবুও আইসিসি তাঁকে কঠোর শাস্তি দেয়। দুই বছর সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিবকে নিষিদ্ধ করে তারা। এর মধ্যে অবশ্য এক বছরের নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রাখে ক্রিকেটের এই সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা। নিয়ম অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞার প্রথম বছরে আইসিসির আর কোনো আইন না ভাঙায় পরের এক বছরের শাস্তি থেকে সাকিব রেহাই পাবেন।
প্রশ্ন থাকতেই পারে জুয়াড়ির কাছ থেকে কী এমন প্রস্তাব পেয়েছিলেন সাকিব? আইসিসির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উঠে এসেছে বিস্তারিত সব তথ্য। ক্রিকফ্রেঞ্জির পাঠকদের জন্য আবারও ফিরে দেখা যাক আইসিসির বিজ্ঞপ্তিতে কী ছিল। পাঠকদের সুবিধার্থে গুরুত্বপূর্ণ অংশ অনুবাদ করে দেওয়া হলো–
সূচনা
১. বাংলাদেশ দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য সাকিব আল হাসান। যিনি দেশটির হয়ে মোট ৫৬ টেস্ট, ২০৬ ওয়ানডেসহ মোট তিনশোটিরও বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নিয়েছেন। তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় ২০০৬ সালের আগস্টে।
২. একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব আল হাসান অবশ্যই আইসিসির নিয়মনীতির আওতাভুক্ত। যেমন, আইসিসির সকল নিয়ম তাকে মানতে হবে। নিয়মের মধ্যে থাকতে হবে। যে কোনো একটি নিয়মের বিরুদ্ধে যায় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং ক্রিকেটের স্বচ্ছতায় প্রভাব ফেলে এমন কোনো কাজ দেখলে আইসিসিকে জানাতে হবে।
৩. ক্যারিয়ারজুড়ে সাকিব আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিটের সঙ্গে মিলিতভাবে অনেক শিক্ষামূলক কাজে অংশ নিয়েছেন। আইসিসির এসব শিক্ষামূলক কাজের মূল কারণ ক্রিকেটারদের স্মরণ করিয়ে দেয়া যে ক্রিকেটারদের এসব নিয়ম মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে ফিক্সিং বা এ জাতীয় কিছু করার জন্য কোনো প্রস্তাব পেলে তা আইসিসিকে জানানোর বাধ্যবাধকতাও আছে।
৪. ২০০৮ ও ২০০৯ সালে সাকিব তার দায়িত্বে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন এবং একটি ফিক্সিং প্রস্তাব পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিটকে জানান।
সাকিবের শাস্তির পেছনের কারণ
১. ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ আগস্ট সাকিব আল হাসানকে একটি সন্দেহজনক ফিক্সিং কাণ্ডের তদন্তের জন্য জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিট। ক্রিকেটে আগেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে এমন একজন– দীপক আগারওয়ালের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়েছে কি না এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়।
২. সাক্ষাৎকারগুলোতে সাকিবকে সাবধান করা হয় যে, যে কোনো বক্তব্যই তিনি দেন না কেন সেটা পরবর্তী সময়ে তদন্তের প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে বা স্বপক্ষে ব্যবহার করা হবে। এই সাবধানবাণী শোনার পর সাকিব স্বীকার করেন আগারওয়াল বেশ কয়েকবার তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে।
৩. এই সাক্ষাৎকারে আইসিসির কোড অব কন্ডাক্ট ভাঙার শাস্তির ব্যাপারে অবগত আছেন বলে জানান।
সাক্ষাৎকারে সাকিব এই বিষয়গুলো স্বীকার করেন–
১. ২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) পঞ্চম আসরে ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে খেলেছিলেন সাকিব। সাকিব জানতেন, তাঁরই পরিচিত কোনো এক ব্যক্তি দীপক আগারওয়াল নামের এক ভারতীয় জুয়াড়িকে তাঁর ফোন নম্বর দিয়েছেন। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আগারওয়ালের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা আদান-প্রদান করেন সাকিব। তখনই সাকিবের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব দেন আগারওয়াল। তবে সাকিব সেই প্রস্তাব এড়িয়ে যান।
২. ২০১৮’র জানয়ারিতে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে বাংলাদেশ। ওই সিরিজ চলাকালীন আগারওয়াল আবারও সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ বিনিময় হয়। ১৯ জানুয়ারি সিরিজের একটি ম্যাচে সাকিব ম্যাচসেরা হওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানান আগারওয়াল। এরপরই হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজটি ছিল- ‘আমরা কি এখানে কাজ করব নাকি আইপিএল পর্যন্ত অপেক্ষা করব।’ এখানে ‘কাজ’ বলতে দলের কোনো অর্থ আদান-প্রদানকে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারটি সাকিব আইসিসিকে জানাননি। পরে ২৩ জানুয়ারিতে আবারও আগারওয়ালের মেসেজ পান সাকিব। আগারওয়াল আবারও দলের খবর জানতে চেয়ে মেসেজ করেন- ‘ব্রো এই সিরিজে আর কিছু?’ এর মানে হলো আগারওয়াল দলের আরও খবর জানতে চাইছে। সাকিব এ ব্যাপারেও আইসিসিকে কিছু জানাননি।
৩. ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা-জিম্বাবুয়েকে নিয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজের সময় দুজনের মধ্যে আবারও বার্তা আদান-প্রদান হয়। ১৯ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচসেরা হওয়ার পর সেদিনই সাকিবকে অভিনন্দন জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠান আগারওয়াল। এর পরপরই তিনি সাকিবের উদ্দেশে আরেকটি বার্তা পাঠান। সেটি হলো ‘কাজটা কি এখনই হবে, নাকি আমি আইপিএল পর্যন্ত অপেক্ষা করব?’ এখানে ‘কাজ’ বলতে মূলত দলের ভেতরের খবর পাচার করাকে বুঝিয়েছেন আগারওয়াল। কিন্তু আগারওয়ালের কাছ থেকে পাওয়া এই প্রস্তাবের কথা আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট (এসিইউ) বা অন্য কোনো দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাকে জানাননি সাকিব। যদিও এ ব্যাপারে আগারওয়ালের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদান ছাড়া আর কিছুই করেননি বাংলাদেশ তারকা।
৪. চার দিন পর ২৩ জানুয়ারি আগারওয়ালের কাছ থেকে আরও একটি বার্তা পান সাকিব। সেখানে আবারও দলের ভেতরের খবর ফাঁস করার জন্য সাকিবকে প্রস্তাব দেন তিনি। ওই খুদে বার্তায় আগারওয়াল লেখেন, ‘এই সিরিজের ব্যাপারে কোনো তথ্য পেতে পারি?’ দ্বিতীয়বার একই ব্যক্তির কাছ থেকে এই প্রস্তাব পেলেও এবারও এসিইউ বা অন্য কোনো দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাকে কিছুই জানাননি সাকিব।
৫. ত্রিদেশীয় সিরিজে পাওয়া চোট কাটিয়ে ওঠার পর আইপিএলে খেলতে যান সাকিব। ২৬ এপ্রিল সানরাইজার্সের হায়দরাবাদের হয়ে কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে মাঠে নামেন সাকিব। সেদিন হোয়াটসঅ্যাপে আবারও সাকিবকে বার্তা পাঠান আগারওয়াল। সানরাইজার্সের একজন নির্দিষ্ট খেলোয়াড় ওই ম্যাচে খেলবেন কি না, এ ব্যাপারে সাকিবের কাছে জানতে চান তিনি। এ ছাড়া দলের ভেতরের আরও কিছু খবরও জানতে চান আগারওয়াল। সেদিন আগারওয়ালের সঙ্গে বেশ অনেকক্ষণ ধরে কথা হয় সাকিবের। আগারওয়াল সাকিবের কাছে তাঁর ডলার অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য জানতে চান। জবাবে সাকিব বলেন, তিনি আগে আগারওয়ালের সঙ্গে দেখা করতে চান।
যে কোড ভঙ্গ হয়েছে
১. কোড ২.৪.৪ – ফিক্সিংয়ে জড়ানোর জন্য কোনো পক্ষ থেকে কোনো রকম প্রস্তাব পাওয়ার পর দ্রুত তা অ্যান্টি করাপশন ইউনিটের কাছে জানানো। সাকিব তিনবার ফিক্সারদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েও তা জানাননি আইসিসিকে এ জন্য এই কোডটি ভঙ্গ হয়েছে।
ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন
১. সাকিব স্বীকার করেছেন তিনি ২.৪.৪ কোড অব কন্ডাক্টটি ভঙ্গ করেছেন। এ জন্য তাকে আইসিসির নির্ধারিত শাস্তির ৫.১.১২ কোডে নিষিদ্ধ করা হয়।
স্বীকারোক্তি
১. কোড ২.৪.৪ ভঙ্গ করলে কোনো ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে শাস্তির মেয়াদ আইসিসির ৬.২ ধারায় লেখা আছে কমপক্ষে ৬ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছর।
২. আইসিসির ৬.১ ধারায় লেখা আছে এই ড়্গেত্রে আইসিসির অ্যান্টি করাপশন ইউনিট বিভিন্ন বিষয় আমলে নিয়ে শাস্তির মেয়াদকাল নির্দিষ্ট করবেন।
৩. ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের অর্জন, সম্মান, নিবেদন এবং অ্যান্টি করাপশন ইউনিটের সঙ্গে ক্রিকেট দূষিত না করার লক্ষ্যে পূর্বের কাজগুলোকে আমলে নিয়ে সাকিবকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। এর মধ্যে এক বছর স্থগিত নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
৪. সাকিব নিজেও নিজের ভুল স্বীকার করেছেন এবং শাস্তি মেনে নিয়েছেন।
৫. আইসিসির ৭.২ ধারা মোতাবেক সাকিব আল হাসান বা আইসিসি এই শাস্তির বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে না।