ক্রিকফ্রেঞ্জি স্পেশাল

এইচপি দল নিয়ে ইংল্যান্ড সফরের পরিকল্পনা রেডফোর্ডের

সৈয়দ সামি

সৈয়দ সামি
প্রকাশের তারিখ: 10:11 রবিবার, 06 সেপ্টেম্বর, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

ইয়ন মরগান-ডেভিড মালানদের শৈশবের কোচ ছিলেন টবি রেডফোর্ড। একসময় তিনি সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন জেসন হোল্ডার- শ্যানন গ্যাব্রিয়েলদেরও। এবার এই ইংলিশ কোচ দায়িত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) হাই পারফরম্যান্স ইউনিটের (এইচপি)। আগামী বছরের আগস্ট পর্যন্ত বিসিবি এইচপি দলের প্রধান কোচের দায়িত্বে থাকবেন রেডফোর্ড। 

শ্রীলঙ্কায় এইচপি দলের ক্যাম্প দিয়ে মিশন শুরু হবে ইংলিশ এই কোচের। আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার আগেই ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে শুনিয়েছেন আশার বাণীও। বিস্তারিত পড়ুন...

ক্রিকফ্রেঞ্জি: হাই পারফরম্যান্স কোচ হিসেবে এখনও বাংলাদেশে আসেননি। সব ঠিক থাকলে শ্রীলঙ্কাতেই যোগ দেবেন। কোচ হিসেবে আপনার প্রথম লক্ষ্য কি থাকবে?

টবি রেডফোর্ড: আমার প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে খেলোয়াড়দের সম্পর্কে ধারণা নেয়া। তারা মানুষ হিসেবে কেমন এবং খেলোয়াড় হিসেবে কেমন। তাদের কাছ থেকে দেখতে চাই, বুঝতে চাই এমনকি যোগাযোগ বাড়াতে নিয়মিত কথা বলতে চাই। আমার দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে যেসব তরুণ ক্রিকেটাররা আছে, তাদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জন্য প্রস্তুত করা। যেন তারা সব ফরম্যাটেই নিজেদের সহজেই মানিয়ে নিতে পারে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জি: জাতীয় দলের অন্যতম বড় পাইপলাইন হিসেবে ধরা হয় এইচপি ইউনিটকে। এখান থেকে অনেকেই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান। যারা এখানে খেলবেন তাদেরকে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে কি পরামর্শ দেবেন? যেহেতু ক্রিকেটে মানসিকতা বড় ভূমিকা পালন করে।

রেডফোর্ড: একজন ক্রিকেটার তখনই মানসিকভাবে শক্ত হতে শুরু করবে, যখন সে নিজের খেলায় উন্নতি করবে বা করতে থাকবে। প্রযুক্তিগত এবং কৌশলগত দুই দিক দিয়েই। এটা আপনাকে আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হতে সাহায্য করবে। আমি সবসময়ই মনে করি মানসিকভাবে আপনি যে অবস্থায় থাকবেন বা যেটা ভাববেন আপনার খেলাও সেরকম হবে। আপনি যদি নেটে বেশি আউট হতে থাকেন বা বল মিস করতে থাকেন তাহলে আপনার আত্মবিশ্বাস এমনিতেই কমে যাবে। হতে পারে দুই একটি জিনিসে পরিবর্তন আনলে অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসতে পারে, এমনকি আপনার খেলার ধরণও উন্নতি হতে পারে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জি: এইচপি ইউনিটে অনেকেই আছেন লম্বা সময় ধরে খেলছেন কিন্তু জাতীয় দলে জায়গা হচ্ছে না, আবার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিশ্বকাপ জয়ী অনেক তরুণ ক্রিকেটাররাও এবার আছেন। ভিন্ন ভিন্ন মানসিকতার খেলোয়াড় থাকবে, এই চ্যালেঞ্জটাকে কিভাবে দেখছেন?

রেডফোর্ড: এটাকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছি না। কারণ আমি যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সঙ্গে কাজ করেছি তখন সেখনকার এইচপি দলে ছিলেন জেসন হোল্ডার-শ্যানন-গ্যাব্রিয়েলরা। আমি ওদেরকে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছি। একই পরিস্থিতি ছিল। তাই চ্যালেঞ্জ দেখছি না। কারণ সেখানে যেমন তরুণরা ছিল, তেমনই টেস্ট খেলেছে এমন ক্রিকেটারও ছিল। 

এটা আসলে নির্ভর করবে একেকজন আলাদা ব্যক্তিত্বের ওপর, কে কিভাবে খেলাটাকে দেখছে, দৃষ্টিভঙ্গি বা নিজের খেলাটাকে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। এরপর কাজ করা যাবে। সবাইকে এক ভাবে কাজ করানো যাবে না, তাদের সঙ্গে কথা বলে, জেনে এরপর আলাদা আলাদা করেও কাজ করা যাবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মাঝে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা আছে, এটা কি কোনো বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে?

রেডফোর্ড: আশা করছি হবে না। কারণ আরও অনেক কোচিং স্টাফরা থাকবেন যারা ভালো ইংরেজি বুঝবেন হয়তো। তারাই হয়তো সাহায্য করবেন। এছাড়া আরও অনেক উপায় আছে ভিডিও, ডায়াগ্রাম বা ছবির মাধ্যমে। আস্তে ধীরে সব মানিয়ে নেয়া যাবে। আমিও হয়তো ওদের ভাষা বুঝবো না। আশে পাশের মানুষ সাহায্য নিতে হবে বা অন্য উপায় বের করতে হবে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে কাজ করছেন, যেখানে তরুণ বা উঠতি বয়স থেকেই ক্রিকেটাররা হার্ড হিটার হয়ে থাকে বা দ্রুত রান তোলার মানসিকতা নিয়ে বড় হয়ে থাকেন। এছাড়া পুরো মাঠ জুড়েও রান করতে সক্ষম হয়ে থাকেন তারা। কিন্তু বাংলাদেশে সচারচর এমনটা হয় না। বাংলাদেশের একজন তরুণ কিভাবে নিজেকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে পারে?

রেডফোর্ড: আমি এটা বিশ্বাস করি যে একজন ভালো খেলোয়াড়ের বেসিক টেকনিক অনেক ভালো হয় কারণ আপনি যদি বিরাট কোহলি বা কেন উইলিয়ামসনের দিকে তাকান ওদের বেসিক এবং টেকনিক ছোট থেকেই দারুণ ছিল। দুজনই একসঙ্গে নিজ দেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছে, অধিনায়কও ছিল। আর এখন ক্রিকেট বিশ্বে রাজত্ব করছে। যে কোনো ফরম্যাটেই তারা সেরা। তাই বেসিক ঠিক থাকাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। 

একজন ক্রিকেটারের ছোট থেকেই যদি টেকনিকটা ভালো থাকে তখন সে অনেক কিছুই যোগ করতে পারে। এমনকি সেটা তাড়াতাড়িই করতে পারে। এটা তখনই কঠিন হয় আপনি যখন সোজা ব্যাটে না খেলেন বা ব্যালেন্স ঠিক না থাকে কিংবা পায়ের ব্যবহার বেশি না করেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তরুণদের মাঝে এসব থাকলে তারা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্কুপ, রিভার্স সুইপ, ইনসাইড আউট বা ডিপ মিড উইকেটের ওপর দিয়ে অনায়াসে শট খেলতে পারে। এটাকে ছোট থেকেই আয়ত্তে আনতে হয়। 

ক্রিকফ্রেঞ্জি: অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অনেক ক্রিকেটারই এখন এইচপি দলের অংশ। তাদেরকে কি আলাদা ভাবে তত্ত্বাবধায়ন করবেন বা একটু বাড়তি মনোযোগ দেবেন?

রেডফোর্ড: আমি ওদের সঙ্গে কাজ করতে মুখিয়ে আছি। ওরা এখন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। এটা বাংলাদেশের জন্যও ভালো যে এমন ক্রিকেটার আছে যারা জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়বে বা নাড়ছে। আমি চেষ্টা করবো ওরা যেন আমার থেকে সেরাটা নিয়ে জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে পারে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ৭-৮ বছর কাজ করেছি, জানি কি প্রয়োজন এখানে ভালো করতে হলে। আমি জানি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কি কি প্রয়োজন হয়। কি পরিমাণ চাপ থাকে। এসব ছেলেদের একটু দেখভাল করলে এরা অনেক দূর যেতে পারবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব ১৫ থেকে ১৯ পর্যন্ত কাজ করেছেন, বাংলাদেশে প্রথমবার এসেছেন। ভিন্ন কন্ডিশন, খেলোয়াড়দের মানসিকতাও এক নয় এখানে। বাংলাদেশের ছেলেদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কঠিন হবে কিনা?

রেডফোর্ড: আমার মনে হয় না। ইংল্যান্ডে যেমন ভিন্ন কন্ডিশন ওয়েস্ট ইন্ডিজেও ভিন্ন। দুই জায়গাতেই কাজ করেছি। এখন উপমহাদেশে এসেছি। এখানে ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন মানসিকতা, উইকেটের ধরণও আলাদা হয়। খেলোয়াড়রা এক কন্ডিশন থেকে আরেক কন্ডিশনে গিয়ে খেলতে পারলে তাদের উন্নতিতে সাহায্য হয়। সামনে শ্রীলঙ্কা সফর আছে, ভালো প্রতিপক্ষ, নিজেদের মাঠে ভালো খেলবে এটাই স্বাভাবিক। আমি চাই দলকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে, সেখানকার কন্ডিশনে খেলাতে। যেন ওরা বুঝতে পারে অনেক কিছু। 

অনেকেই দেখি ইংল্যান্ডে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারে না, কিন্তু ছোট থেকেই যদি এই অভ্যাসটা গড়ে তোলা হয় তাহলে অনেক উন্নতি হবে। এরপর যখন আপনি সিনিয়র দলের হয়ে খেলতে যাবেন আপনার জন্য একটু হলেও সহজ হবে। ভিন্ন কন্ডিশনে ওদের অভিজ্ঞ করতে পারলে এটা তাদের জন্যই ভালো, বোলারদের ক্ষেত্রেও এমনটা। কোন উইকেটে কেমন বোলিং করতে হবে, সুইং-সিম এছাড়া বলের লাইন কিভাবে বদলাতে পারবে সেটাও। স্পিনারদের ক্ষেত্রেও, ইংল্যান্ডের উইকেটে স্পিন কম হলে কিভাবে কি করতে হবে সেটাও জানতে পারবে। এটা বড় একটা শিক্ষণীয় বিষয় হবে সব তরুণদের জন্য।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি মিডেলসেক্স-সাসেক্সে কাজ করছেন। ইয়ন মরগান-ডেভিড মালানদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন ছোট থেকে। মরগান এখন বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক, ঠান্ডা মাথার অধিনায়ক। মরগানের মতো হয়ে উঠতে এখন তরুণ ক্রিকেটারকে কি কি পথ পাড়ি দিতে হবে? মালানের ব্যাটিংয়ের বিশেষত্ব কি?

রেডফোর্ড: আমি মরগান এবং মালানরা যখন ছোট তখন থেকেই ওদের সঙ্গে কাজ করেছি। সব কিছু কাছ থেকে দেখেছি। মরগান স্পিনের বিপক্ষে খুব ভালো খেলতে পারত তখন থেকেই। আমার মনে আছে একবার কাউন্টি ম্যাচে স্পিন বান্ধব উইকেটে কোনো ব্যাটসম্যানই দাঁড়াতে পারছিল না। তখন মরগানের বয়স ১৭ বছর হবে। সে নেমে পা ব্যবহার করে স্পিনের বিপক্ষে দারুণভাবে খেলতে লাগে। তাদের আরেকটা অস্ত্র ছিল স্কুপ-রিভার্স সুইপ। মরগান অনুশীলনে এগুলোর প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিত। যেন সে মাঠে এগুলো খেলতে আত্মবিশ্বাস পায়। 

ডেভিড মালানকে দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা বোলিং ম্যাশিনে ব্যাট করতে। সে পুল, ড্রাইভ, কাট শট নিয়মিত অনুশীলন করতো। এরা দুজনই অনুশীলনকে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বলে এই পর্যায়ে এসেছে। এখনকার তরুণদের থেকেও এই জিনিসটাই চাই। তারা যেন উন্নতি করতে পারে, নতুন কিছু বের করে আনতে পারে। তারা যদি পরিশ্রম করে আর খেলাটাকে বুঝতে পারে তাহলে অবশ্যই বহুদুর যেতে পারবে। বিশ্বের যেখানেই তাকান সব দলই চায় ধারাবাহিক পারফর্ম করতে, সেটার জন্য চাই ক্রিকেটারদের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স। আমরা এই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাব যেন এমন খেলোয়াড় তৈরি করতে পারি যে জাতীয় পর্যায়ে দলকে বড় কিছু দিতে পারে।