ধোনির অবসর

মহেন্দ্র সিং ধোনি: এক বিস্ময় বালকের উপাখ্যান

নাহিয়ান আরেফিন

নাহিয়ান আরেফিন
প্রকাশের তারিখ: 10:12 রবিবার, 16 আগস্ট, 2020

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

১৯৮১ সালে ঝাড়খন্ডের রাঁচিতে এক অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেয় এক বালক। তাঁর নাম রাখা হয় মহেন্দ্র সিং ধোনি। পরিবার, বন্ধু-বান্ধবদের কাছে মাহি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময় ফুটবল এবং ব্যাডমিন্টনে ঝোঁক ছিল মাহির। কিন্তু সেখান থেকে হঠাৎ করেই স্কুলের ক্রিকেট দলের কোচের নজর কাড়েন তিনি। ধোনির গোলকিপিং দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে স্কুলের ক্রিকেট দলে নেয়া হয় উইকেটরক্ষক হিসেবে।

সেখান থেকেই শুরু ধোনির ক্রিকেটীয় জীবন। কে কল্পনা করেছিল ছোট্ট সেই মাহি একদিন ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করবে? বিশ্বজয়ের পাশাপাশি ভারতকে নিয়ে যাবে অন্য এক উচ্চতায়? কেউ ভাবেই নি ফুটবলের গোলরক্ষক মাহি একদিন ভারতের জাতীয় ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দেবে।

প্রথম দিকে দলে লোয়ার অর্ডারে নামানো হতো মাহিকে। কিন্তু এক ম্যাচে ওপেনার হিসেবে নেমে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রাঁচির এই কিশোর। স্কুল ক্রিকেটের গন্ডি পেরিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন রঞ্জি ট্রফির মঞ্চে। কিন্তু প্রথমবার সেখানে তার খেলা হয়ে উঠেনি। কেননা তার এই সাফল্যকে গ্রাহ্যই করেনি সে সময়কার স্থানীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কর্তারা।

১৯৯৮ সালে ধোনি দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াকালীন প্রথম চুক্তিবদ্ধ হন সেনট্রাল কোল ফিল্ড লিমিটেডের (সিসিএল) সঙ্গে। স্কুল ক্রিকেট খেলা ধোনির সে সময় ছিল না কোনো পেশাদার ম্যাচ খেলা অভিজ্ঞতা। সিসিএলে খেলার সময় ঘোষণা দেয়া হয়েছিল প্রতিটি ছক্কা মারার জন্য একজন ব্যাটসম্যানকে ৫০ রুপি করে দেয়া হবে। ধোনি সেই সুযোগ কাজে লাগান এবং একের পর এক দুর্দান্ত সব ইনিংস খেলে সিসিএলকে 'এ' বিভাগে উত্তীর্ণ করেন।

১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে বিহারের অনূর্ধ্ব ১৯ দলের হয়ে ৫ ম্যাচে ১৭৬ রান করেছিলেন ধোনি। নিজের যোগ্যতা এবং তৎকালীন বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি দিভাল সাহার সহায়তায় ১৯৯৯-২০০০ সালের জন্য বিহারের রঞ্জি দলে জায়গা করে নেন তিনি। একই মৌসুমে কোচ বিহার ট্রফিতে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলে ফাইনাল ম্যাচে খেলেন ৮৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। পুরো টুর্নামেন্টে তিনি মোট রান করেছিলেন ৩৫৭।

২০০১ সালে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের শখ বিসর্জন দিয়ে যোগদান করেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেলওয়েতে। টিকেট চেকারের চাকরি পাবার সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ পান রেলওয়ের দলে খেলার। ৮ ঘণ্টা চাকরি আর ৮ ঘণ্টা অনুশীলন। কিন্তু তার মন তো কাজে আর বসে না। পুরোটায় পড়ে রয়েছে ক্রিকেটে। ফলে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চাকরি করে সেটি ছেড়ে দেন ধোনি। ফের নিজেকে সম্পুর্ণ ক্রিকেটে লাগিয়ে দেন তিনি।

২০০২-০৩ মৌসুমে রঞ্জি ট্রফিতে ঝড়খন্ড ক্রিকেট দলের হয়ে তিনটি অর্ধশতকের ইনিংস খেলেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। লোয়ার অর্ডারে এসে হার্ড হিটিংয়ের জন্য তার নাম ডাক দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেই নাম ডাকের প্রেক্ষিতে ডাক পান ভারত 'এ' দলে।

২০০৪ সালে নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারত ‘এ’ দলের হয়ে দুই সেঞ্চুরির পর নজর কাড়েন নির্বাচকদের। যার দরুণ ডাক পান জাতীয় দলে। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ বাংলাদেশের বিপক্ষে জাতীয় দলে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষিক্ত হন ধোনি। কিন্তু সেই ম্যাচে রানের খাতা খোলার আগেই খালেদ মাসুদ পাইলটের রান আউটের শিকার হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল এই হার্ড হিটার ব্যাটসম্যানকে।

ক্লাব পর্যায়ে রাঙ্গালেও জাতীয় দলের শুরুটা খুব একটা ভালো করতে পারেননি ধোনি। টানা ৩ ম্যাচে পাচ্ছিলেন না রান। একটা সময় দল থেকে বাদ পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যানের। কিন্তু ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কপাল খুলে যায় ধোনির। ১২৩ বলে ১৪৮ রানের ইনিংস খেলে সমালোচকদের জবাব দেবার পাশাপাশি দলে নিজের জায়গা শক্ত করতে সক্ষম হন তিনি।

এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মাহির। সেই থেকে কেবল এগিয়েই গেছেন তিনি। বর্ণাঢ্য ক্রিকেট ক্যারিয়ারে তার অপ্রাপ্তি বলতে কিছু ছিল না। ছিলেন ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে পরিসংখ্যান আর সাফল্যের হিসেবে দেশের সর্বকালের সেরা।
 
ক্রিকেট ইতিহাসের অধিনায়ক হিসেবে তিনটি আইসিসি ট্রফি জেতার অনন্য কীর্তি আছে একমাত্র ধোনিরই। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ দিয়ে শুরু। এরপর একে একে ২০১১ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সঙ্গে ধোনির প্রাপ্তির শোকেসে রয়েছে দুটি এশিয়া কাপও (২০১০ আর ২০১৬)।

গেল বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেমি ফাইনালে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ভারতের বিদায়ের পর আর ২২ গজে পড়েনি ধোনির পদচারণা। কিউইদের বিপক্ষে সেই ম্যাচে দুর্দান্ত এক অর্ধশতক হাঁকানোর পর গাপটিলের রান আউটের শিকার হয়ে সাজঘরে ফিরে যেতে হয়েছিল ধোনিকে। তার উইকেটের পতনের মাধ্যমেই মূলত নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল ভারতের পরাজয়।

চমকে ভরা এই তারকার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের এটিও একট বড় চমক। শুরুটা হয়েছিল রান আউট দিয়ে। শেষটাও ঠিক তেমনি।

মূলত গেল বিশ্বকাপের পর থেকেই গুঞ্জন চলতে থাকে তার অবসর নিয়ে। অবশেষে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শনিবার (১৫ আগস্ট) আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন কুল হিসেবে পরিচিত মহেন্দ্র সিং ধোনি। আর এর মাধ্যমে অবসান ঘটলো তার ১৫ বছরের বর্ণিল ক্রিকেট ক্যারিয়ারের। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আর দেখা যাবে না স্ট্যাম্পের পেছনে তার কারুকাজ, আর দেখা যাবে না তার সেই বিখ্যাত হেলিকপ্টার শট।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর আগে ভারতের হয়ে ৫৩৮ ম্যাচ খেলেন ধোনি। নিজের নামের পাশে যুক্ত করেছেন ১৭ হাজার ২৬৬ রান। অপরদিকে গ্লাভস হাতে ৬৩৪ ক্যাচের সাথে করেছেন ১৯৫ টি স্ট্যাম্পিং। যা তাকে নিয়েছে অনন্য এক উচ্চতায়।

তিন ফরমেটেই দুর্দান্ত খেললেও ধোনি সবচেয়ে সফল ছিলেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। ক্রিকেটের এই ফরম্যাটে রয়েছে পঞ্চাশের ওপর গড় (৫০.৫৭)। রান করেছেন ১০ হাজার ৭৭৭)। ৩৫০ ওয়ানডে খেলে ঝিলিতে পুরেছেন ১০টি সেঞ্চুরি। একই সঙ্গে ৭৩টি হাফ সেঞ্চুরিরও মালিক তিনি। ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফিনিশার হিসেবে পরিচিতিটা হয়ে গেছে তাতেই। উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান হিসেবে অন্যতম সফলদের একজন।

ধোনির সবচেয়ে বড় আফসোস হিসেবে থাকবে ভারতের হয়ে ১০০ টেস্ট খেলতে না পারাটা। দেশের হয়ে খেলা তার ৯০ টেস্টে ৩৮.০৯ গড়ে করেছেন ৪ হাজার ৮৭৬ রান। সেই সঙ্গে ক্রিকেটের লঙ্গার ভার্শনে তার রয়েছে ৬ সেঞ্চুরি ও ৩৩ হাফসেঞ্চুরি। ইনিংস সেরা রান ২২৪।

সাদা পোশাকে ভারতকে সবচেয়ে বেশি ম্যাচে (৬০) নেতৃত্ব দেয়ার কৃতিত্ব রয়েছে কেবলমাত্র ধোনিরই। এই ক্যাপ্টেন কুলের অধীনে ভারত জয় পেয়েছে ২৭টি টেস্ট, হেরেছে ১৮টি আর ড্র হয়েছে ১৫টি ম্যাচ।

এদিকে সেঞ্চুরি ছুঁই ছুঁই করেও শেষ পর্যন্ত ৯৮ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচেই থামলো সাবেক এই অধিনায়কের ক্যারিয়ার। শর্টার ভার্শনের এই ক্রিকেটেও ওয়ানডের মতো ঈর্ষণীয় সাফল্য তার। ৩৭.৬০ গড়ে ১ হাজার ৬১৭ রান তুলেছেন সদ্য সাবেক এই ব্যাটসম্যান।

ফিরবেন ফিরবেন করেও আর ফেরা হলো না তারকা এই ক্রিকেটারের। এক প্রকারে নীরবে নিভৃতেই ২২ গজকে বিদায় জানিয়ে এপিটাফ টেনে দিলেন ক্যারিয়ারের। তবে তিনি আজীবন থেকে যাবেন ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে, থেকে যাবেন ক্রিকেটভক্তদের মনে।