টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তি

দুই দশকে অপ্রাপ্তির হাহাকার আশরাফুল-পাইলটদের

সৈয়দ সামি

সৈয়দ সামি
প্রকাশের তারিখ: 10:13 শুক্রবার, 26 জুন, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত ক্লাবে দশম সদস্য হিসেবে নাম লেখায় বাংলাদেশ। সেই হিসেবে আজ বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির দুই দশক পূর্ণ হয়েছে। এই ২০ বছরে বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটের অনেক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় যোগ করেছে, আছে অনেক অপ্রাপ্তিও। সেই খেরো খাতা নিয়েই আজকের আয়োজন।

ঐতিহাসিক লর্ডসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) তৎকালীন সভাপতি ম্যালকম গ্রে বাংলাদেশকে পূর্ণ মর্যাদার টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা দিয়েছিলেন। টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পথটা খুব সহজ ছিল না। বাকি ৯টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের সমর্থন পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। জিততে হয়েছিল কূটনৈতিক অনেক যুদ্ধও।

টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য প্রথম শর্ত ছিল দেশে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট চালু থাকতে হবে। যদিও সে সময় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের পাঠটাই শুরু হয়নি লাল সবুজের এই দেশে। তখনও দেশের প্রধান খেলা ছিল ফুটবল। তবে সব জয় করে ক্রিকেট প্রাণ কয়েকজন সংগঠকদের হাত ধরে সাদা জার্সিতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ।

এই দুই যুগে বাংলাদেশের সাফল্যের পাল্লা ভারি না হলেও, দারুণ কিছু জয় আছে। সেরা মুহূর্তের কথা বলতে গেলে সবার উপরে উঠে আসবে ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর স্মৃতি। এ ছাড়া শততম টেস্টে লঙ্কানদের জয়টি অনেক কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসে পাতায় লেখা থাকবে। তবে বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গেলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৩ সালে প্রথম টেস্ট জয় কোনো ভাবেই বাদ পড়তে পারবে না।

২০০০ সালের ১০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে টেস্ট আঙিনায় পা রাখার পর বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত খেলেছে ১১৯টি টেস্ট। এর মধ্যে ১৪টি টেস্ট জিতেছে টাইগাররা। ড্র হয়েছে ১৬টি ম্যাচ।  ৮৯টি টেস্টে পরাজয় সঙ্গী হয়েছে বাংলাদেশের। অর্থাৎ মোট ম্যাচের ৭৫ শতাংশই হেরেছে বাংলার বাঘেরা। হেরে যাওয়ার ম্যাচের প্রায় অর্ধেকটা (৪৩) আবার ইনিংস পরাজয়। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে টেস্ট ম্যাচ জিততে কতটা কাঁচা টিম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক এবং উদ্বোধনী টেস্ট খেলা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান খালেদ মাসুদ পাইলট মনে করেন এই দুই দশকে বাংলাদেশের আরও উন্নতির প্রয়োজন ছিল।

ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে পাইলট বলেন, '২০ বছর হয়েছে এটা খুবই ভালো লাগছে যে আমরা খুব ভালো জায়গায় যাচ্ছি। আরও ভালো হওয়া উচিত ছিল। আরও উন্নতি হওয়া উচিত ছিল। ২০ বছরে সব মিলিয়ে প্রায় তিনটি জেনারেশন পার হয়ে গেছে। আমাদের একটা জেনারেশন ছিল, আমরা শুরু করেছিলাম। তারপর মাশরাফিদের একটা জেনারেশন ছিল। এখন সাকিব, তামিম, মুশফিকদের জেনারেশন চলছে। কোনো সন্দেহ নেই যে তারা ভালো খেলোয়াড়। এই চারজন, পাঁচজন ভালো। তবে আমাদের আরও ২০ জনের মতো কোয়ালিটি প্লেয়ার থাকা উচিত ছিল ব্যাকআপ। তাহলে আমি বলতাম যে ভালো জায়গায় অবস্থান করছি।'

ভারতের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টেই ১৪৫ রানের ইনিংস খেলে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস বানারম্যান ও জিম্বাবুয়ের ডেভ হটনের পর তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজ দলের অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। ২০০১ সালে আশরাফুল নিজের অভিষেক টেস্টে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ানের রেকর্ড গড়েছিলেন। যা এখনও রেকর্ড বইয়ে খোদাই করা আছে। এ ছাড়া সোহাগ গাজীর একই টেস্টে সেঞ্চুরি আর হ্যাটট্রিকের রেকর্ড বিশ্ব ক্রিকেটে এখনও অনন্য। এমন সব ব্যক্তিগত রেকর্ডে অনেকে উজ্জ্বল থাকলেও পাইলটের আক্ষেপ দল হিসেবে বাংলাদেশের উন্নতির জায়গাটা খুবই ধীর। 

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'এখন হয়তো আমরা ঘরের মাঠে ম্যাচ জিতছি। এমন অনেক দেশ পিছিয়ে আছে শ্রীলঙ্কা বলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলেন, সে জায়গাটা আমাদের ধরে ফেলা উচিত ছিল। অ্যাওয়ে ম্যাচ তাদের দেশে গিয়ে জিতে আসা। আমরা উন্নতি করেছি কিন্তু উন্নতিটা অনেক ধীর। আমরা অনেক বড় বড় ব্যক্তিগত অর্জন পেয়েছি। তবে বলতে পারবো না আমরা টেস্টে পাঁচ নম্বরের মধ্যে, ছয় নম্বরের মধ্যে।'

টেস্টে বাংলাদেশের উন্নতির পথ বাতলে দিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। তিনি মনে করেন বাংলাদেশে এখনও টেস্টে ২০ উইকেট নেয়ার মতো বোলার তৈরি হয়নি। তাঁর মতে টেস্ট জিততে হলে দলে এমন বোলার থাকতে হবে যারা ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও ২০ উইকেট নেয়ার সক্ষমতা রাখবেন। 

আশরাফুল বলেছেন, 'টেস্ট নিয়ে আমাদের ভালো প্ল্যানিং করা উচিত। আমরা মুমিনুলকে টেস্ট স্পেশালিস্ট ধরি। তামিম, মুশফিক ওরা নিয়মিত খেলছে। আমার মনে হয় আমাদের বোলিংটা আরেকটি উন্নতি করতে পারলে ভালো হতো। টেস্ট ম্যাচ জিততে হলে আপনার উইকেট লাগবে। এখনও ওই মানের বোলার আমাদের তৈরি হয়নি। আপনি যদি ফ্রেশ উইকেট দেন, যে উইকেটে বল ঘুরবে না। একজন ইজি উইকেট। ওইসব উইকেটে যদি উইকেট নিতে পারেন তাহলে আপনি টেস্ট ম্যাচ জিততে পারবেন।'

বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বকনিষ্ঠ এই টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আরও বলেন, 'ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঘরের মাঠে যে দুটো ম্যাচ জিতেছি, প্রথম দিন প্রথম বল থেকেই বল স্পিন হচ্ছিলো। সে সময় আমারা ফলাফল পেয়েছি। আমাদের সেই মানের বোলার তৈরি করতে হবে যারা ব্যাটিং সহায়ক উইকেটেও ২০ উইকেট নিতে পারবে। তাহলে টেস্ট ক্রিকেটে উন্নতি করতে পারবো। আফগানিস্তানের রশিদ খান বলেন, নবী বলেন, ওরা কিন্তু যেকোনো উইকেটে ভালো করতে পারে। আমাদের এই জিনিসটিই মিসিং। ২০ বছরে আমরা ওই মানের বোলার একজনও পাইনি।'

টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১২ দলের মধ্যে এখন নবম। বাংলাদেশের নিচে থাকা জিম্বাবুয়ে এখন ক্রিকেট থেকেই বিলুপ্তির পথে। আর বাকি দুই দেশ আফগানিস্তান আর আয়ারল্যান্ড এই টেস্টের অভিজাত আঙিনায় নবাগত। এর মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে কদিন আগে দেশের মাটিতে হেরেছে বাংলাদেশ। এমন পারফরম্যান্সের পর বাংলাদেশের উন্নতির গ্রাফটা উপরের দিকে নিয়ে যেতে না পারলে, আরও কয়েক দশক আক্ষেপে পুড়তে হবে বাংলাদেশের টেস্ট অনুরাগীদের।