রেকর্ডবুক

আলবার্ট ট্রট- 'ফাদার অফ ডাবল হ্যাটট্রিক'

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক
প্রকাশের তারিখ: 22:05 শনিবার, 25 এপ্রিল, 2020

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

হ্যাট্রিক ক্রিকেটে হরহামেশা না হলেও কালেভদ্রে হয়ে থাকে। কিন্তু তাই বলে একই ইনিংসে জোড়া হ্যাটট্রিক। তাও আবার একই জনের! কি বিস্ময় লাগছে, রোমাঞ্চে পুলকিত হচ্ছে হৃদয়? ক্রিকেট বিশ্ব এমনই এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল ১৯০৭ সালের ২২ মে তারিখে।

এই ইতিহাসের রচয়িতা প্রাক্তন ইংলিশ অফ স্পিনার আলবার্ট ট্রট। সাদা চামড়ার এই মানুষটি সেদিন রীতিমতো আপন বোলিং শৈলীতে লর্ডস তথা পুরো ক্রিকেট জগৎকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথম শ্রেণির এক ম্যাচে তিনি একই ইনিংসে দুই দুইবার হ্যাট্রিকের অমৃত স্বাদ লাভ করেছিলেন এই ইংলিশ বোলার।

রূপকথার নায়ক হওয়ার আগে অবধি বাইশ গজের রেকর্ড বুকে তিনি সমাদৃত ছিলেন বিশালাকার ছক্কার মালিক হিসেবে। সেকেলে মন্থর গতির ব্যাটিং সিলেবাসে নতুনত্ব আনা কয়েকজন পিঞ্চ হিটারদের মধ্যে আমাদের গল্পের নায়ক ছিলেন একজন। লর্ডসের গ্র‍্যান্ড স্ট্যান্ডভেদী গগনচুম্বী সেই ওভার বাউন্ডারির নাম ভাঙিয়ে খেয়েছেন বেশ কয়েক কাল যাবৎ।

নিজের সময়ের সেরা স্পিনারদের একজন ভাবা হতো তাকে। দূর্বোধ্য ঘূর্ণির ভেল্কিবাজীতে কুপোকাত করেছেন বাঘা বাঘা সব ব্যাটসম্যানদের। জাতীয় দলের হয়ে ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা করতে পারেননি ট্রট। ৫ টেস্ট খেলে নামের পাশে যোগ করেছেন ২৬ উইকেট।

তবে, তাঁর প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ার বেশ সাফল্যমণ্ডিত। পাশাপাশি ঈর্ষনীয়ও বটে। স্বদেশী ক্লাব মিডলসেক্স এবং অষ্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া লীগের জনপ্রিয় দল ভিক্টোরিয়ার হয়েও মাঠ মাতিয়েছেন এই রেকর্ড বয়। দুই ক্লাবের হয়ে সর্বসাকুল্যে খেলা ৩৭৫ টি ম্যাচে ২১.০৯ গড়ে তাঁর উইকেট সংখ্যা ১৬৭৪।

ঘরোয়া ক্রিকেটের এক ম্যাচে মুখোমুখি মিডেলসেক্স এবং সামারসেট। ঘরের ছেলের পারফরম্যান্স স্বচক্ষে দেখতে গ্যালারি ভর্তি উপচে পড়া দর্শকের ঢল। কিন্তু কে জানতো এক দিন ইতিহাস গড় রেকর্ড গড়বেন আলবার্ট? চলুন দেখে আসি কিভাবে তিনি নাম লেখালেন রেকর্ড বুকে।

প্রথম দিন :

ট্রটের দলের বিচিত্র নামধারী কাপ্তান গ্রেগার ম্যাকগ্রেগর টসে জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন। ইনিংসের গোড়াপত্তনকারী ফেলহ্যাম ওয়ার্নার এবং ফ্র‍্যাঙ্ক টরেন্ট ওপেনিং জুটিতে দলকে এনে দেন মজবুত ভিত্তি। তাদের যুগলবন্দী থেকে আসে ৮৯ রান। প্রতিপক্ষের দাপুটে শুরুর পরেও বুক চিতিয়ে লড়ে যাওয়া সামারসেটের দুই বোলিং কান্ডারি টেলবাট লুইস এবং অসবার্ট মর্ডানের হাত ধরে অসামান্য প্রত্যাবর্তন করে সামারসেট। তাদের আঁটোসাঁটো বোলিং নৈপুণ্যে ২৮৬ তে থামে মিডেলসেক্সের প্রথম ইনিংস। ব্যক্তিগত চল্লিশোর্ধো রান আসে একমাত্র এডওয়ার্ড লিটিলজোনের উইলো থেকে। ট্রটকে লুইসের বলে বোল্ড হয়ে ফিরতে হয় মাত্র ১ রানে।

দ্বিতীয় দিন :

প্রথম দিনের তুলনায় এদিন নাটকের দৃশ্যপটে আসে অনেক পরিবর্তন। উৎকন্ঠা, উত্তেজনায় ঠাঁসা দ্বিতীয় দিনের শুরুতেই নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামা সামারসেট শিবিরে প্রথম আঘাত হানেন এডওয়ার্ড মিগনান। তার নান্দনিক এক আউটসুইংয়ে দলপতি লিতনাল প্যারায়েট ক্যাচ দিয়ে বসেন উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে। সেনাপ্রধানের বিদায়ে বিমর্ষ সামারসেট লড়তে থাকে লেন ব্রন্ড এবং রেনডাল জনসনের ব্যাটে ভর করে।

দু'জনে মিলে সচল রাখেন রানের চাকা। এদিকে গল্পের নায়ক, ইতিহাস সৃষ্টা ট্রট এ পর্যায়ে ছিলেন একেবারেই ফ্যাকাশে। প্রথম ৫ ওভারে ১০ রানের বিনিময়ে উইকেট শূন্য থাকতে হয় তাকে। অপরপ্রান্তে টরেন্ট ছিলেন রুদ্রমূর্তিধারী। ১৫ ওভারে ৪ মেইডেনের সহায়তায় ৪৭ রান খরচায় পকেটে পুড়ে নেন পাঁচ খানা টাটকা উইকেট। মিডেলসেক্সের চেয়ে কাটাকাটায় ৫০ রান দূরে থাকতেই ২৩৬ রানে ইনিংসের যবনিকাপাত ঘটে অতিথিদের।

স্বাগতিকদের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামে ধ্বস, ২১৩ রানে অল-আউট হয় তারা। ট্রটের ব্যাট থেকে আসে মূল্যবান ৩৫ রান।

ইতিহাস গড়া তৃতীয় দিন :

২৬৪ রানের লক্ষ্যে তৃতীয় দিনে ব্যাটিংয়ে নামে প্যালারয়েট বিগ্রেড। প্রথম ইনিংসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে দুই ওপেনার ব্রন্ড এবং প্যালারয়েট এবারেও দলকে এনে শুভসূচনা। তাদের ৫৬ রানের উদ্ভোধনী জুটি ভাঙেন টরেন্ট। প্যালারয়েটকে ফিরিয়ে দিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয় গ্রেগর বাহিনী।

স্কোরবোর্ডে আর ২১ রান তুলতেই ৭৭ রানে টরেন্টের দ্বিতীয় শিকার হয়ে প্যাভিলিয়নমুখী হন আরেক ওপেনার ব্রন্ড। নির্ভরতার প্রতীক লুইসকে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলে সফরকারীদের বেদনার অনলে ঘি ঢালেন ট্রট।

এরপরেই উপস্থিত হয় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, টানা তিন বলে একে একে মাসাই পয়েন্টারজ, স্যামি উডস এবং এ্যার্নি রবিনসনকে বিদায় করে হ্যাটট্রিক পূরণ করেন ট্রট। বিস্ময়কর ভাবে তিনজনের আউটের ধরন একই - বোল্ড। পরপর ৩ উইকেটের পতনের ফলে সামারসেটের দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭৭/৬। ট্রট বন্দনায় সরব হয়ে উঠে গ্যালারির আদ্যোপান্ত।   

২০ রানের ছোট্ট এক প্রতিরোধ্য পার্টনারশীপে রান গড়ায় ৯৭। ঠিক তখনই আবার লর্ডসের পুণ্যভূমিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে ট্রট বিস্ময়।

স্পেলের অষ্টম ওভারের চতুর্থ বলে সামারসেটের মর্ডেন্ট ক্যাচ দিয়ে বসেন মিগন্যানের হাতে। পঞ্চম বলে বোল্ড হোন আলফ্রেড বেইলি আর ওভারের শেষ বলে আর্চি উইকহ্যামের আকাশে ভাসানো বল পুনরায় তালুবন্দী করেন মিগন্যান।

ব্যস এতেই রচিত হয় এক নতুন ইতিহাস। ক্রিকেট বিশ্বের প্রথম বোলার হিসেবে জোড়া হ্যাটট্রিকের মালিক বনে যান ট্রট। তাঁর রেকর্ডের দিনে ১৮৬ রানের বিশাল জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে মিডেলসেক্স কাউন্টি ক্লাব। ম্যাচ সেরার পুরস্কার জয়ী ট্রটের বোলিং ফিগার দাঁড়ায় ৮-২-২০-৭।
   
তবে, ট্রটের এই বোলিং মাধুর্যতা কিছুটা হলেও ম্লান করে দেন স্থানীয় দর্শকরা। তৃতীয় দিনের শুরুতে গ্যালারি ছিলো অনেকটাই ফাঁকা। অবশ্য এক্ষেত্রে দর্শকমহলকেও দুষে লাভ নেই বটে, তারা ভেবেছিলেন শেষ বিকেলের স্নিগ্ধতায় ঘরের ছেলের চোখ ধাঁধানো বোলিং কারিশমা উপভোগ করবেন, কিন্তু সে আর হলো কই? ট্রটের যে বড্ড তাড়া।

ফলশ্রুতিতে ভক্তকুলকে উপহার দিয়ে বসলেন "শুভংকরের ফাঁকি"। ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে আক্ষেপ করে ট্রট জানিয়েছিলেন, 'নিজেকে পাপীদের রাজা প্রতিপন্ন হচ্ছে।'

কিন্তু এরপরের গল্পটা হতাশা আর বিষাদের চাদরে মোড়া। বয়সের বিচারে তার জন্য জাতীয় দলের দরজায় পড়ে তালা। হয়তো এই বিষন্নতার জেরেই ১৯১০ সালে বিদায় জানান বর্ণিল, বর্ণাঠ্যে ঠাসা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটকেও।

বাইশ গজের যোদ্ধা পদবীটা প্রাক্তন হলেও মন থেকে প্রাণপ্রিয় ক্রিকেট ক্যানভাসকে ছাড়তে চাননি বিধায় আম্পায়ারিং পেশায় যোগদান করেন কিন্তু সেক্ষেত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হোন ট্রট। এরই মাঝে মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। অবশেষে, জীবনের কঠিন বাস্তবতার নিকটে নতি স্বীকার করা ট্রট বেছে নেন আত্নহননের পথ। ক্ষন জন্মা এই লিজেন্ডের জীবন প্রদীপ স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র ৪১ বছর ১৭৪ দিন।    

কথায় আছে, "রেকর্ড গড়া হয় সেটি ভাঙার জন্য"। প্রচলিত এই কথার প্রমাণ মেলে ভারতীয় ক্রিকেটার যোগিন্দার রাও এর কীর্তিতে। দীর্ঘ ৫৫ বছরের দূর্বোধ্য ট্রটের রেকর্ডে ভাগ বসান পাঞ্জাবের এই বোলার। ফলে ফের ক্রিকেট দুনিয়া সাক্ষী হয় আরও একটি রোমাঞ্চকর মূহুর্তের।

অভিষেকেই হ্যাটট্রিক করা রাও নিজের দ্বিতীয় ম্যাচেও করে বসেন আরেকটি হ্যাট্রিক। অবশ্য একটিতে তার উদরপূর্তি হয়নি। ১৯৬৩-৬৪ মৌসুমে অমৃতসারে নর্দান পাঞ্জাবের বিপক্ষে ম্যাচে একই ইনিংসে ডাবল হ্যাটট্রিক পূরণ করেন রাও। টানা দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিকের বিরল কীর্তির বদৌলতে খানিকটা হলেও ট্রটের তুলনায় রাও এগিয়ে সেকথা বলাই বাহুল্য।