বিশ্ব ক্রিকেট

ক্রিকেটের স্বর্গোদ্যান লর্ডসের অজানা দিকদর্শন

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক

ক্রিকফ্রেঞ্জি ডেস্ক
প্রকাশের তারিখ: 19:25 মঙ্গলবার, 21 এপ্রিল, 2020

|| ডেস্ক রিপোর্ট || 

ক্রিকেটকে বলা হয়ে থাকে 'গেম অফ জেন্টলম্যান'; অর্থাৎ ভদ্রলোকের খেলা। ব্যাটে বলের লড়াইয়ের যাত্রাটা শুরু হয়েছিলো তৎকালীন জ্ঞানগর্ভা এবং রাজকার্যে সুদক্ষ রাণী ভিক্টোরিয়ার দেশ থেকে, মহাজাগতিক নিয়মানুসারে তখন সময়টা ছিলো উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। বাইশ গজের তীর্থভূমি “হোম অফ ক্রিকেট” খ্যাত লর্ডসে হাতে খড়ি হয় ব্যাট-বলের নান্দনিক খেলা ক্রিকেটের।

পরবর্তীতে হাটিহাটি পা পা করে চিত্তবিনোদনের আভিজাতিক খেলাটির প্রসার ঘটে বিশ্ব জুড়ে, সেদিন কেইবা ভেবেছিলো – ক্রীড়া জগতে সর্বজনগ্রাহ্য ফুটবলের পরেই আপন মহিমায় সে স্থান করে নিবে জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় স্থানে।

ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে শির দাড়া সটান করে দাঁড়িয়ে আছে ক্রিকেটের জন্মদাতা হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্যের লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড। অসংখ্য ম্যাচ, অজস্র রেকর্ড। সঙ্গে রয়েছে হাসি-কান্নার এক স্মৃতি বিজোড়িত অনিন্দ্য সুন্দর এক টুকরো সবুজ গালিচা। যা কিনা এই চিরসবুজ লর্ডসের তারুণ্যের প্রতীক।

কি নেই এখানে? সুসজ্জিত বেলকোনি, রাজা-মহারাজার পাক ঘরের ন্যায় সুবিশাল ডায়নিং স্পেস। সেই সঙ্গে রয়েছে মাঠ এবং মাঠের বাইরের সেনানীদের জানা-অজানা গপ্পো নিয়ে গড়া হাজারো পুস্তিকার প্রাচুর্যতাপূর্ণ এক লাইব্রেরী। আর তথ্যবহুল এই লাইব্রেরীর কেদারায় হেলান দিয়ে আবেশের পরশ মাখা ক্রিকেটের ভূ-স্বর্গ অবলোকন করার ইচ্ছে জাগতেই পারে যে কোন ক্রিকেটপ্রেমীর মনে। আজকে জানবার পালা চিরচেনা সেই লর্ডসের অজানা রকমারি সব মজাদার তথ্যগুলো।

আজকের এই বর্তমান লর্ডস প্লে গ্রাউন্ডটি মূলত পুরাকালের সেই আদি গ্রাউন্ড না। উত্তরসূরীর হিসেবে বলতে গেলে ধরে নেয়া যেতে পারে আজকের এই লর্ডস চিরস্থায়ী তৃতীয় পুরুষ। লন্ডন প্রবাসী থমাস লর্ড আজ থেকে ২৩২ বছর পূর্বে লন্ডনে নিজের নামে এক সুবৃহৎ ক্রিকেট স্টেডিয়াম নির্মাণ করেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৭৮৭ থেকে ১৮১৪ এই সময়কালে তিনি মোট ৩ খানা মাঠের উদ্ভাবন করেন।

লন্ডনের আজকের বর্তমান জার্সেট স্কয়ারই ছিলো আদি লর্ডস গ্রাউন্ড। জমি সংক্রান্ত সমস্যার জেরে ১৮১১ থেকে ১৮১৩ এ দু’বছর মূল মাঠের পরিবর্তে খেলা গড়ায় তাঁর উদ্ভাবিত দ্বিতীয় মাঠে। অবশেষে, এক বছর বাদে নতুন আঙ্গিকে ১৮১৪ সালে স্কুল ক্রিকেটের একটি ম্যাচ দিয়েই অভিষেক ঘটে একালের কারুকাজে সম্পূর্ণ ক্রিকেটের স্থায়ী স্বর্ণ দূর্গের।

যশ, খ্যাতিতে সম্পূর্ণ রাজাধিরাজ লর্ডস কি বাদবাকি আর পাঁচটা ক্রিকেট মাঠের মতো হবে? হওয়ার কথাও নয়। স্বভাবতই তাতে থাকবে অভিনবত্বের ছোঁয়া, ইউনিক ট্রেডিশন কিংবা হৃদয়স্পর্শী কোন চিরন্তন নিদর্শন। সেই লক্ষে ১৮৬৪ সালের প্রাক পর্যায়ে, ছোট্ট পরিসরে মেরিলিবন ক্রিকেট ক্লাব তথা এমসিসির পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে তোলা হয় একখানা জাদুঘর বা সংগ্রহশালা। জাদুঘরে তথাকথিত জাদুর দেখা না মিললেও নিঃসন্দেহে বলা যায় সেখানে সংরক্ষিত যেসকল এন্টিক সামগ্রীর নজির ছিলো তা যেকোন ক্রিকেট পিপাসুকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য বটে।

কালের বিবর্তনে বয়সে পরিণত হয়েছে সেই পুরোনো সংগ্রহশালা, সঙ্গে বেড়েছে ক্রিকেট অনুসারীদের আনাগোনাও। সেই গোড়ার দিক থেকে বর্তমান ক্রিকেটের চালচিত্র সবই চোখে পড়ে চার দেয়ালের এই প্রশস্ত ঘরে। অ্যাশেজের সেই ছোটো (মাত্র ছয় ইঞ্চি) শবাধার থেকে শুরু করে, সাবেক সকল ক্রিকেট গ্রেটদের চিত্রকর্ম, ব্যবহৃত পোশাক সামগ্রী কিংবা সেই মরণঘাতী বল যার আঘাতে ১৯৩৬ সালে মাঠে এক চড়ুই পাখির হৃদয়-বিদারক মৃত্যু হয়েছিলো। এক্ষেত্রে বল হাতে বোলিং প্রান্তের মানুষটা ছিলেন ভারতীয় সাবেক বোলার ডাঃ খান। গ্রেস কিংবা ব্র‍্যাডম্যান, কালজয়ী সকল ক্রিকেট রাজাদের ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি পরম যত্নে শোভা পাচ্ছে লন্ডনের এই সংগ্রহশালায়।

রসনা বিলাসীদের জন্যও রয়েছে সুসজ্জিত খাবার ঘর, সাথে ক্রিকেটারদের জন্য দেখবার মতো ড্রেসিংরুমেরও ব্যবস্থা রেখেছে কর্তৃপক্ষ।

তথ্যবহুল এবং নিদর্শনে ভরপুর বর্ণাট্য জাদুঘরের পাশাপাশি মেরিলিবন ক্রিকেট ক্লাবের রয়েছে হাজারো পুস্তিকা সমৃদ্ধ এক গ্রন্থাগার যেখানে বছর প্রতি ৪০০টি সংস্করণে ১৭,০০০ নতুন বইয়ের সন্ধান মেলে। মেরিলিবন লাইব্রেরীর ন্যায় পুরো দুনিয়ায় এমন ক্রিকেট নির্ভর রকমারি বইয়ের সর্ববৃহৎ এবং প্রাচুর্যতাপূর্ণ সংগ্রহশালা আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দায়। অনাদিকাল থেকে এ অবোধি বরেণ্য সব ক্রিকেটারদের অর্জনসহ, ক্রিকেটের টুকিটাকি সব খবর আদ্যোপান্ত জমা রয়েছে ইতিহাস নির্ভর এই রত্নভান্ডারে। সাংবাদিক এবং ক্রিকেট বিশ্লেষকদের সুবিধার্থে ক্লাবের কর্মকর্তারা সবসময় লাইব্রেরিতে উপস্থিত থাকেন। কার্যত এই সজ্জন ব্যক্তিবর্গের সহায়তায় সুবিন্যস্ত গ্রন্থশালার অভ্যন্তরে আপনারা নিজের পছন্দসই বই খুব সহজেই হাতে পেয়ে যাবেন। অন্যদিন এমন নজিরবিহীন নিরাপত্তার দেখা মিললেও ম্যাচের দিন চোখে পড়ে ভিন্ন চিত্র। সকল ক্রিকেট অনুরাগীদের জন্য ভবনের প্রবেশপথ রাখা হয় উন্মুক্ত।

শুধু কি ক্রিকেট? টেনিস-বাস্কেটবলের তারকাদের পদচারণায়ও মুখর হয়েছে ঐতিহাসিক লর্ডসের ময়দান। রক্তক্ষয়ী, ধ্বংসযজ্ঞের ছাপ রেখে যাওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিলগ্নে আমেরিকা এবং কানাডার বাস্কেটবল দল এক চ্যারিটি ম্যাচে অংশ নেয় এ মাঠেই। সেই ম্যাচের লভ্যাংশের অর্ধেক অর্থ অনুদান স্বরূপ জমা পড়ে কানাডার এক এতিমখানায়। আর বাকীটা বরাদ্দ করা হয় স্বামীহারা অসহায় বিধবা নারীদের উন্নয়নকল্পে। এছাড়া ২০১২’র লন্ডন অলিম্পিকের তীর নিক্ষেপ প্রতিযোগিতার ভেন্যু হিসেবে নির্বাচিত হয় লর্ডস।

স্বাগতিক ইংল্যান্ডের ইতিহাস নির্ভর ভূমিতে বরাবর প্রতাপ দেখিয়েছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া। লর্ডস যেন অজিদের এক প্রকারে সেকেন্ড হোম হয়ে উঠে। ২০০৯ সালের অ্যাশেজের দ্বিতীয় টেস্ট জিতে অজিদের রেকর্ডের ঘোড়ায় লাগাম টানে ইংলিশরা। ১৯৩৪ সালের পরে সেবারই প্রথম লাকি গ্রাউন্ড লর্ডসে ঘরের ছেলেদের কাছে হেরে অজিদের দর্প চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।

আজীবন কাল স্পোর্টিং উইকেটের তকমা গায়ে লেপনকারী লর্ডস নিরাশ করেনি কাউকেই। তার বাইশ গজের মমতাময়ী আশ্রয়ে সে সবাইকে সাফল্যমণ্ডিত করেছে উদার হস্তে। বোলার কিংবা ব্যাটসম্যানদের দু হাত ভরে দিয়ে যাচ্ছে সে। নীরবে, নিভৃতে নিজের সবুজ প্রান্তরে আতিথ্য দিয়ে চলেছে বাইশ গজের সেনানীদের।