অনূর্ধ্ব-১৯

বিকেএসপির ভালোবাসা ছাড়তে পারেননি আকবর

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 16:57 শুক্রবার, 28 ফেব্রুয়ারি, 2020

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

বাংলাদেশ ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত বিকেএসপি। একের পর প্রতিভাবান ক্রিকেটার জন্ম দেয়াই যেন এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। এখানকারই একটি রত্নের নাম আকবর আলী। অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে তাঁর নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। 

বয়স মোটে ১৮। এই বয়সেই যতটা পরিণত এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন আকবর তাতে করে ভবিষ্যতে যে তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের কাণ্ডারি হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। 

ছোটবেলা থেকে আকবরকে দেখে আসা শ্রেণি শিক্ষিকা লাইলুন নাহার কবিতাও ছাত্রের প্রতি অগাধ আস্থা রাখছেন। আগামীতে দেশের মুখ আরো উজ্জ্বল করবেন আকবর বলে প্রত্যাশা তাঁর। দীর্ঘদিনের এই শিক্ষিকার সঙ্গে বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) আবারো সাক্ষাতের সুযোগ এসেছিল আকবরের। আর এই সুযোগ করে দেয় তারই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপি।

গলায় ফুলের মালা, আকবর আলী ও তার পরিবার দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন। ছবি তোলা শেষে শ্রেণী শিক্ষকের সঙ্গে নিজের পরিবারের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন যুব বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক। পরিবারের সঙ্গে মিনিট দেড়েক কুশল বিনিময় শেষে সেই ম্যাডামের সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন আকবর। এমন দৃশ্য দেখা গেছে বিকেএসপির চত্বরে। 

সাধারণত খুব ভালো সম্পর্ক না হলে শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের তুই বলে ডাকেন না। কিন্তু সন্তানতুল্য আকবরকে বাবা ছাড়া কথাই বলেন না বাংলা শিক্ষিকা লাইলুন নাহার। তাদের উভয়ের কথোপকথন দেখে যে কেউই এক লহমায় বুঝতে পারবেন দুজনের সম্পর্কটা কতটা মজবুত।

আগ্রহের আতিশয্যে লাইলুন নাহারের কাছে জানতে চাওয়া হলো ছাত্র আকবরের কথা। আকবর সম্পর্কে ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে আলাপকালে লাইলুন নাহার শুরুতেই একটা কথা বলেন। খুবই ঠাণ্ডা মাথার সে। মানুষ হিসেবে অসাধারণ।

ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের বিনয়ী স্বভাব তাঁকে এবং অন্যদেরকে মুগ্ধ করেছে বারবার। সেই সঙ্গে আকবর যে বিকেএসপির প্রতি ভালোবাসা ছাড়তে পারেননি সেটাও জানা গেল লাইলুন নাহারের কাছ থেকে। উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করার পর খেলা চালিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ডিগ্রিতেও বিকেএসপিতে ভর্তি হন আকবর। খেলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও অংশ নিতে পারেননি তিনি। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিকে লাইলুন নাহার বলেন, 'আকবর সহ হাসান মুরাদ, জাতীয় দলের আমিনুল ইসলাম বিপ্লব ওরাও আমার ছাত্র। যুব বিশ্বকাপ দলের সবার শিক্ষক আমি। কিন্তু শ্রেণী শিক্ষক আমি আকবর আর মুরাদের। আমি বাংলা পড়াই। আকবর এখন ডিগ্রীর ছাত্র। এখান থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েছে। ও এখানেই পড়বে।'

'বিকেএসপির প্রতি ভালোবাসাটা ও ছাড়তে পারিনি। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে অনেক। কিন্তু খেলার জন্য ও অনেক ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। জীবনে অনেক বড় বড় ত্যাগ করেছে সে। কিন্তু আকবর ভালো মানুষ হতে চায়। বড় মানুষ হতে চায়।  সে সব সময় চাইতো ওকে সবাই ছাড়িয়ে যাক। বন্ধুদের সঙ্গে ওর দারুণ সম্পর্ক। সবার ডাকেই সাড়া দেয়।' 

খেলাধুলার পাশাপাশি ছোট বেলা থেকে পড়াশুনা ভালো ছিলেন আকবর। তবে খেলার মধ্যে থাকলে কিভাবে পড়াশুনা চালিয়ে যাবেন এই নিয়ে সন্দিহান ছিল তাঁর পরিবার। এক্ষেত্রে অবশ্য শিক্ষকদের সাহায্য পেয়েছেন তিনি। 

খেলার চাপ সামলে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার কৌশল শিক্ষকরাই বাতলে দিতেন আকবরকে। এর ফলস্বরূপ মাধ্যমিক পরীক্ষাতে এ প্লাস পান তিনি। ২০১২ সালে জেলা পর্যায়ে বাছাই পরীক্ষায় নাম লিখিয়ে বিকেএসপিতে ভর্তি হন আকবর। 

এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের আগে খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৭ দলেও। আছে বিকেএসপির বয়সভিত্তিক দলগুলোকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতাও। লাইলুন নাহার আরও জানালেন আকবরের মধ্যে এই নেতৃত্ব দেয়ার গুণ ছোট বেলা থেকেই। বাকি ৫ জনের থেকে আলাদা ভাবে সে সবাইকে নিয়ে চলে।

বাংলার এই শিক্ষিকা আরও বলেন, 'পড়াশুনার পাশাপাশি ও খেলাধুলাতেও অনেক ভালো ছিল। আমরা সবাই বলে দিতাম কখন কি করতে হবে না হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার সময় আমরা সাহায্য করতাম। আকবর যেখানেই যেত বই নিয়ে যেত। আমরা বলে দিতাম যখন খুব বেশি চাপ থাকবে, যে বিষয়টা পড়তে সহজ মনে হয় সেটা পড়তে। আকবরের যে ধারণ ক্ষমতা, কৌশল এগুলো শিক্ষক হিসেবে আমাকে মুগ্ধ করেছে। এখন তো দেখছি আমি না, গোটা বিশ্ব ও মাতিয়ে তুলেছে। ওর মতো লক্ষ্মী ছেলে হয় না। ওর বিনীত আচরণ সবাইকে মুগ্ধ করেছে। আমি বিশ্বাস করি ও অনেক উপরে উঠবে। এখন পর্যন্ত ও অনেক ভালো একজন মানুষ। আশা করি এটা সে ধরে রাখবে।'

'আকবরের মধ্যে ছোট বেলা থেকেই নেতা ভাব ছিল। তবে কোনো বাজে দিকে এটা যায়নি। ও কাওকে জোর করে কিছু করাতো না। যেভাবে চমৎকার ভাবে বিশ্বকাপ জয় করেছে ঠিক সেভাবেই সবাইকে এক সঙ্গে রাখতো। ও কিন্তু বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে কিভাবে কি করতে হবে, টিকে থাকতে হলে কোন কোন দিকগুলো করতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে সেই নকশাটা মাথায় একে নিয়েছে। নেয়ার পরই সে শুরু করেছে। ওকে প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট খুব বেশি ভালোবাসতো। দুষ্টু ছেলেরাও ওকে মেনে চলতো। আকবর যে অধিনায়ক বা টিম লিডার এটা বাকি ৫জনের থেকে আলাদা। ওর প্রথম গুন ও খুব ঠাণ্ডা মাথার। ও মানুষকে কষ্ট দিয়ে বা ধাক্কা দিয়ে কিছু পেতে চায় না।' আরও যোগ করেন তিনি।

সপ্তম শ্রেণী থেকে আকবরের ক্লাস নিয়েছেন লাইলুন নাহার। তখন থেকেই তরুণ এই ক্রিকেটারের চিন্তা শক্তি সম্পর্কে অবগত তিনি। মাথার মধ্যে ছক একে সামনে চলতে পছন্দ করেন আকবর বলে জানান তাঁর শিক্ষিকা। 

তিনি বলেন, `সপ্তম শ্রেণী থেকে আমি আকবরের শ্রেণী শিক্ষক। ও এখান থেকেই ইন্টার মিডিয়েট পাশ করেছে। ও পড়াশুনায় ছোট বেলা থেকেই ভালো। বিশ্বকাপে আমরা যেমন দেখেছি ওর চিন্তা শক্তি যেমন পড়াশুনার বেলাতেও একই রকম। ছোট বেলা থেকেই ও বেশ চিন্তাশীল ছিল। এ কারণেই ওর ফলাফলও ভালো হয়। এ প্লাস পেয়েছিল। ও আমাদের কলেক প্রিফেক্ট (ক্যাপ্টেন) ছিল। সবাইকে নিয়ে কাজ করার যে পরিকল্পনা বা ছক বাঁধার যে চিন্তা এই বিষয়টা ওর মধ্যে খুব বেশি ছিল।'

বিকএসপির ইন্ডোর স্পোর্টস অঙ্গনে বৃহস্পতিবার সংবর্ধনা দেয়া হয় আকবরদের। সন্ধ্যা ৭ ঘটিকায় অনুষ্ঠান শুরু হলেও দুপুর থেকেই ছিল এর আমেজ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের  রিহার্সাল চলছিল। গেটের সামনে দাড়া করানো ছিল ফুল দিয়ে সাজানো একটি পিক আপ ভ্যান। সেখানে লাগানো ছিল আকবর সহ ৯ জনের ছবি।

বিকেল ৫টা নাগাদ আকবর-জয়দের দেখা মেলে। সাদা গেঞ্জিতে ফুলের মালা গলায় তাঁদের বরণ করে নেন সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা। ছিলেন নাজমুল আবেদিন ফাহিম স্যার, বিকএসপির ব্রিকেডিয়ার জেনারেল আবদুর রশিদ। শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে সকলেই ব্যস্ত ছিলেন আকবরদের নিয়ে ছবি তোলায়।

রাত সাড়ে আট ঘটিকায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হাজির হন প্রধান যুব এবং ক্রীড়া প্রতি মন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। বিকএসপির এই ৯ কৃতি শন্তানকে ব্লেজার পরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ক্রেস্ট এবং এক লক্ষ টাকার চেক প্রদান করেন তিনি। এছাড়া ৮ মার্চ গণভবনে বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেটারদের সংবর্ধনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী বলেও ঘোষণা দেন জাহিদ আহসান রাসেল।