বিশ্বকাপ স্পেশাল

ইতিহাসে ১৯৮৭ এর বিশ্বকাপ

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 11:40 বৃহস্পতিবার, 23 মে, 2019

|| বিশ্বকাপ স্পেশাল ||

বিশ্বকাপের প্রথম তিন আসরের আয়োজক দেশ ছিল ইংল্যান্ড। সেই ধারা ভেঙে ১৯৮৭ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয় যৌথভাবে ভারত ও পাকিস্তানকে। উপমহাদেশে প্রথমবার আয়োজিত এই বিশ্বকাপ ওয়ানডে ক্রিকেটকে নিয়ে যায় অনন্য এক উচ্চতায়।

আয়োজকের পাশাপাশি পরিবর্তন এসেছিল স্পন্সরশিপেও। লন্ডনভিত্তিক প্রুডেন্সিয়াল কোম্পানির জায়গায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স। টুর্নামেন্টের নাম 'প্রুডেনশিয়াল কাপ’ থেকে বদলে হল ‘রিলায়েন্স কাপ’। এছাড়া পরিবর্তন আনা হয় সময়সূচীতেও। প্রথম তিনবার যেমন বিশ্বকাপ হয়েছিল জুন মাসে, এবার বদলে যায় সেটিও। উপমহাদেশের গরম আবহাওয়ার কথা চিন্তা করে বিশ্বকাপ নিয়ে যাওয়া হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে।

যৌথ আয়োজনের কারণে বেড়ে যায় ভেন্যুর সংখ্যাও। টুর্নামেন্টের মোট ভেন্যু ছিল ২৪টি। ভারতের ১৪ আর পাকিস্তানের ১০।

তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয় খেলার দৈর্ঘ্যে। উপমহাদেশে যেহেতু ইংল্যান্ডের মতো দেরি করে সন্ধ্যা নামে না, সে কারণে ম্যাচের দৈর্ঘ্য ৬০ থেকে কমিয়ে আনা হয় ৫০ ওভারে। আরেকটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ছিল আম্পায়ারিং। ১৯৮৭ বিশ্বকাপেই প্রথমবারের মতো ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন 'নিরপেক্ষ' আম্পায়ার।

এত সব পরিবর্তনের ভিড়ে অপরিবর্তিত ছিল কেবল টুর্নামেন্টের ফরম্যাট। এবারও ডাবল লিগ পদ্ধতিতে প্রতিটি দল এক অপরের সঙ্গে খেলেছিল দু’বার করে।

মজার ব্যাপার হল, ১৯৮৩ বিশ্বকাপে যে দলগুলো খেলেছিল, ১৯৮৭ বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল সেই দলগুলোই। সাতটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের সঙ্গে আইসিসি ট্রফি বিজয়ী জিম্বাবুয়ে। গ্রুপ এ-তে ছিল ভারত, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং জিম্বাবুয়ে। গ্রুপ বি-তে পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কা।

উপমহাদেশে আয়োজিত প্রথম বিশ্বকাপ। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বকাপকে ঘিরে উন্মাদনা-উত্তেজনার পারদ ছিল তুঙ্গে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ভারত আর পাকিস্তানের 'স্বপ্নের ফাইনালের' স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিয়েছিল প্রথম তিন আসরের স্বাগতিক ইংল্যান্ড আর 'আন্ডারডগ' অস্ট্রেলিয়া। ইডেনের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে মাইক গ্যাটিংয়ের ইংল্যান্ডকে মাত্র ৭ রানে পরাজিত করে প্রথমবারের মত শিরোপা ঘরে তোলে অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া।

১৯৮৭ বিশ্বকাপের সূচনা পর্বটা ছিল এককথায় দুর্দান্ত। আসরের প্রথম চার ম্যাচেই জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি হয়েছিল শেষ ওভারে!

হায়দরাবাদে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে জাভেদ মিয়াঁদাদের দুরন্ত সেঞ্চুরিতে (১০০ বলে ১০৩) শ্রীলঙ্কাকে ১৫ রানে হারায় পাকিস্তান। স্বাগতিকদের জয়টা আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হয়েছিল তাদের। ২৬৮ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে এক পর্যায়ে শ্রীলঙ্কার স্কোর ছিল ৭ উইকেটে ১৯০। শেষদিকে টেইলএন্ডারদের নিয়ে একাই লড়াই চালিয়ে যান অরবিন্দ ডি সিলভা। তাঁর ৩১ বলে ৪৬ রানের লড়াকু ইনিংসের সৌজন্যেই শেষ ওভার পর্যন্ত জয়ের সম্ভাবনা বেঁচে ছিল লঙ্কানদের।

ওদিকে একই গ্রুপের অন্য খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২ উইকেটে পরাজিত করে ইংল্যান্ড। ক্যারিবীয়দের দেয়া ২৪৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে প্যাট্রিক প্যাটারসন (৩/৪৯), কার্ল হুপারদের (৩/৪২) তোপে ১৬২ রান তুলতেই ৭ উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। তবে অ্যালান ল্যাম্বের অপরাজিত ৬৭ (৬৮ বলে) রানের সুবাদে ৩ বল ও ২ উইকেট হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় তারা।

অন্যদিকে ‘এ’ গ্রুপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে স্বাগতিক ভারত হেরে বসে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। মাত্র ১ রানের রুদ্ধশ্বাস এক জয় দিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে অজিরা।

ওপেনার জিওফ মার্শের সেঞ্চুরিতে (১১০) ভর করে ৬ উইকেটে ২৭০ রানের চ্যালেঞ্জিং টোটাল দাঁড় করিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। জবাবে সিধু (৭০), শ্রীকান্ত (৭৩), গাভাস্কারদের (৩৭) ব্যাটে সহজ জয়ের পথেই এগোচ্ছিল ভারত। কিন্তু দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে এসে আচমকা রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন ডানহাতি পেসার ক্রেইগ ম্যাকডারমট (৪/৫৬)। সাথে যোগ দেন সাইমন ও'ডোনেল, স্টিভ ওয়াহরাও। ফলাফল ২০৭/২ থেকে ২৬৯ রানে অলআউট ভারত!

পঞ্চাশতম ওভারে মাত্র ৬ রান ডিফেন্ড করে রীতিমতো 'ডেথ বোলিং বিশেষজ্ঞ' বনে যান স্টিভ ওয়াহ। শেষ দুই বলে ভারতের দরকার ছিল ২ রান। কিন্তু ওভারের পঞ্চম বলে বোল্ড হয়ে যান শেষ ব্যাটসম্যান মনিন্দর সিং।

'এ' গ্রুপের আরেক ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অল্পের জন্য অঘটনের হাত থেকে রক্ষা পায় নিউজিল্যান্ড। টসে হেরে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নেমে মার্টিন ক্রো'র 'ক্লাসিকাল' ৭২ আর মার্টিন স্নেডেনের 'পরিশ্রমী' ৬৬ রানের সৌজন্যে নিউজিল্যান্ড করেছিল ৭ উইকেটে ২৪২। জবাব দিতে নেমে শুরুতেই হোঁচট খায় ডেভ হটনের দল। কোন কারণ ছাড়াই নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে তারা। ১০ রানে দুই, ৬৭ রানে চার, ১০৭ রানে হারায় সাত উইকেট! এরপরই শুরু হয় অলরাউন্ডার ইয়ান বুচার্টকে নিয়ে অধিনায়ক ডেভ হটনের বীরোচিত ফাইটব্যাক!

১৩ বাউন্ডারি আর ৬ ছক্কায় সাজানো ১৩৭ বলে ১৪২ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে প্রায় 'অসম্ভব' এক জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলেন হটন। অবশেষে দলীয় ২২১ রানের মাথায় স্নেডেনের বলে মার্টিন ক্রো'র অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে পরিণত হন তিনি। অনেকের মতে ওটা ছিল 'ক্যাচ অব দ্য টুর্নামেন্ট'।

জিম্বাবুইয়ানদের জয়ের আশা তখনো বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বুচার্ট (৫৪)। কিন্তু জন ট্রাইকোসকে নিয়ে শেষ উইকেট জুটিতে ১৮ রান তুলেও শেষরক্ষা করতে পারেন নি তিনি। তিন বল বাকি থাকতে ২৩৯ রানে অলআউট জিম্বাবুয়ে। মাত্র ৩ রানের নাটকীয় এক জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে কিউইরা।

রাওয়ালপিন্ডিতে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮ রানের জয় তুলে নেয় পাকিস্তান। অথচ ম্যাচের ৯২ ওভার পর্যন্ত ইংল্যান্ডই ছিল পরিষ্কার ফেবারিট। ২৪০ চেজ করতে গিয়ে ২২১ রানেই গুটিয়ে যাওয়া ইংলিশরা শেষ ৬ উইকেট হারায় মাত্র ১৫ রানে! ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন লেগ স্পিনার আব্দুল কাদির।

এদিকে জিম্বাবুয়েকে ৯৬ রানে হারিয়ে জয়ের ধারা অব্যাহত রাখে অস্ট্রেলিয়া; আর শ্রীলঙ্কাকে ১৯১ রানে বিধ্বস্ত করে প্রবল প্রতাপে ফিরে আসে প্রথম ম্যাচে হোঁচট খাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভিভ রিচার্ডসের ১২৫ বলে ১৮১ রানের (১৬টি চার ও ৭টি ছক্কা) বিস্ফোরক ইনিংসে ভর করে ৩৬০ রানের (তৎকালীন রেকর্ড) বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করিয়েছিল ক্যারিবীয়রা। জবাবে ৪ উইকেট হারিয়ে ১৬৯ রানের বেশি তুলতে পারেনি লঙ্কানরা।

শুরুর হোঁচট সামলে ফিরে এসেছিল ভারতও। গ্রুপ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে তারা ১৬ রানে হারায় নিউজিল্যান্ডকে। সেই ধারা অব্যাহত রেখে টানা পাঁচ ম্যাচে জয় তুলে নেয় কপিল দেবের দল।

ভারতের সমান পাঁচ ম্যাচ জিতেছিল অস্ট্রেলিয়াও। একমাত্র হার ফিরতি লেগে ভারতের বিপক্ষে। তবে দুই দলের পয়েন্ট সমান হওয়ায় গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হয় নেট রান রেটে। যেখানে এগিয়ে ছিল ভারতীয়রাই। ‘বি’ গ্রুপে আরেক স্বাগতিক পাকিস্তানও হয়েছিল গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন। ভারতের মতই জিতেছিল ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে হেরেছিল কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে।

গ্রুপ পর্বের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের সেই বিখ্যাত লাস্ট ওভার। জয়ের জন্য শেষ ওভারে পাকিস্তানের প্রয়োজন ছিল ১৪ রান। ক্রিজে ছিলেন ৯ নম্বরে নামা আবদুল কাদির ও শেষ ব্যাটসম্যান সেলিম জাফর। বোলার কোর্টনি ওয়ালশ, আগের ৯ ওভারে যিনি ৪ উইকেট পেয়েছেন মাত্র ২৬ রান খরচায়।

প্রথম তিন বল থেকে আসল ৪ রান। চতুর্থ বলে লং অফের ওপর দিয়ে বিশাল ছক্কা হাঁকালেন কাদির। পরের বলে নিলেন ২। ওভারের শেষ বল। জয়ের জন্য চাই আরও ২ রান। ওয়ালশ যখন বলটা করতে যাবেন, শেষ মুহূর্তে দেখলেন নন-স্ট্রাইক প্রান্তে আগেই ক্রিজ ছেড়ে অনেকটা বেরিয়ে গেছেন জাফর। স্টাম্প ভেঙে দিলেই মানকাডিংয়ের নিয়মে রানআউট হবেন তিনি। অথচ ওয়ালশ কী করলেন? বল করলেন না, স্টাম্পও ভাঙলেন না। কেবল 'সতর্ক' করে দিলেন জাফরকে! এদিকে শেষ বলে ২ রান নিয়ে ঠিকই ম্যাচটা বের করে ফেলেন কাদির।

ওয়ালশ সেদিন চাইলেই জাফরকে মানকাডিংয়ের ফাঁদে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেন নি। সেদিন মাঠের খেলায় ওয়ালশ হেরেছিলেন ঠিকই, কিন্তু স্পোর্টসম্যানশিপের যে অনন্য নজির তিনি স্থাপন করেছিলেন তা জিতে নিয়েছিল অসংখ্য ক্রিকেটপ্রেমীর হৃদয়।

পাকিস্তানের বিপক্ষে এই হার সেমিফাইনালের রেস থেকে একরকম ছিটকেই দিয়েছিল উইন্ডিজকে। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ফিরতি লেগের ম্যাচটা জিতলেও 'ডু অর ডাই' ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যায় ৩৪ রানে। পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ জিতেও তাই শেষরক্ষা হয়নি আগের তিন আসরের ফাইনালিস্টদের। পাকিস্তান (২০ পয়েন্ট) ও ইংল্যান্ডের (১৬ পয়েন্ট) পেছনে থেকেই গ্রুপ পর্ব শেষ করতে হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (১২ পয়েন্ট)। ক্যালিপসো সঙ্গীতের মূর্ছনা এবার থেমে যায় গ্রুপ পর্বেই।

বিশ্বকাপ রোমাঞ্চের এখানেই শেষ নয়। অস্ট্রেলিয়া বনাম নিউজিল্যান্ডের প্রথম লেগের শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচটার কথাই বা ভুলে যাই কী করে? তাসমান পাড়ের দুই প্রতিবেশীর লড়াইটা বৃষ্টির কারণে নেমে এসেছিল ৩০ ওভারে। ডেভিড বুনের 'অনবদ্য' ৮৭ (৯৬ বলে) আর ডিন জোন্সের 'ঝড়ো' ৫২ (৪৮ বলে) রানের সুবাদে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৪ উইকেটে ১৯৯ রান।

এদিকে মার্টিন ক্রো (৪৮ বলে ৫৮), জন রাইট (৪৪ বলে ৪৭) আর কেন রাদারফোর্ডের (৩৭ বলে ৩৮) দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে নিউজিল্যান্ডের জয়টাকে মনে হচ্ছিল অবশ্যম্ভাবী। ৪ উইকেট হাতে নিয়ে ব্ল্যাক ক্যাপসদের শেষ ওভারের সমীকরণ দাঁড়ায় ৭ রান। স্ট্রাইকে ছিলেন মার্টিন ক্রো, বল হাতে প্রস্তুত 'আইসম্যান' খ্যাত স্টিভ ওয়াহ। 

দলের জয় যখন নিঃশ্বাস দুরত্বে, তখনই কিনা অবিবেচকের মত ছক্কা হাঁকাতে গেলেন মার্টিন ক্রো! স্টিভ ওয়াহর স্লোয়ারে ধরা পড়লেন জিওফ মার্শের হাতে। এদিকে পরের বলেই উইকেটরক্ষক ইয়ান স্মিথ (১) হলেন বোল্ড। তার পরের বলে দুই রান নিতে গিয়ে রান আউট মার্টিন স্নেডেন (১)! শেষ তিন বলে লাগত ৬ রান। কিন্তু ওয়াটসন আর চ্যাটফিল্ড মিলে করতে পারলেন মাত্র ২! স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচে ৩ রানের রোমাঞ্চকর জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ল অ্যালান বোর্ডারের দল।

ম্যাচ শেষে অ্যালান বোর্ডার জানিয়েছিলেন স্টিভ ওয়াহর প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা ও কৃতজ্ঞতার কথা। বলেছিলেন, “আমি জানতাম ওই মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে একমাত্র স্টিভ। আমার সবসময়ই বিশ্বাস ছিল যে ও পারবে।”

টুর্নামেন্টের আরও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতীয় পেসার চেতন শর্মার হ্যাটট্রিক। যার তিনটাই ছিল ক্লিন বোল্ড! উল্লেখ্য, এটাই ছিল বিশ্বকাপ ইতিহাসের 'প্রথম' হ্যাটট্রিক।

নিয়মরক্ষার শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২২২ রানের লক্ষ্য ভারত পেরিয়েছিল ৯ উইকেট হাতে রেখে মাত্র ৩২.১ ওভারে! ওপেনার সুনীল গাভাস্কার পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র ওয়ানডে সেঞ্চুরি, মাত্র ৮৫ বলে! মেরেছিলেন ১০টি চার ও ৩টি ছক্কা! আরেক ওপেনার কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত করেছিলেন ৫৮ বলে ৭৫ (৩ ছক্কা, ৯ চার)।

৪ নভেম্বর, লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে ১৮ রানে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে অস্ট্রেলিয়া। ডেভিড বুনের ৬৫ আর মাইকেল ভ্যালেটার ৪৮ রানের সুবাদে প্রথমে ব্যাট করে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ২৬৭ রান। 'ম্যাচসেরা' ক্রেইগ ম্যাকডারমটের দুর্দান্ত বোলিং (৫/৪৪) দিনশেষে এই রানটাকেই প্রমাণ করেছিল যথেষ্ট। জাভেদ মিয়াঁদাদ (৭০) ও ইমরান খানের (৫৮) ফিফটি দুটি কেবল ব্যবধানই কমিয়েছিল।

পরদিন মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতকে ৩৫ রানে ধরাশায়ী করে ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে ইংল্যান্ড। সেদিন মুম্বাইয়ের উইকেট ছিল স্পিনবান্ধব 'স্লো টার্নার'। মূল একাদশে থাকা দুই বাঁহাতি স্পিনার রবি শাস্ত্রী ও মনিন্দর শর্মার সুবিধার কথা চিন্তা করে টসে জিতে আগে বোলিং নিয়েছিলেন কপিল দেব। কিন্তু ওপেনার গ্রাহাম গুচের সেঞ্চুরি (১১৫) ও অধিনায়ক মাইক গ্যাটিংয়ের (৫৬) ফিফটিতে ৬ উইকেট হারিয়ে ২৫৪ রানের ফাইটিং টোটাল দাঁড় করায় ইংল্যান্ড।

ভারতীয় স্পিন আক্রমণের 'কাউন্টার' হিসেবে সেদিন 'সুইপ' শটের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন গ্রাহাম গুচ আর মাইক গ্যাটিং। বিশেষ করে গুচের ইম্প্রোভাইজেশন ছিল চোখে পড়ার মত। কনভেনশনাল সুইপের পাশাপাশি স্লগ সুইপ, প্যাডল সুইপ, রিভার্স সুইপ — এমন কোন সুইপ নেই যে তিনি খেলেন নি! অফ স্টাম্প, মিডল স্টাম্প, লেগ স্টাম্প কিংবা অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলেও ইচ্ছেমত সুইপ খেলেছেন। গুচের ইনিংস সম্পর্কে উইজডেন বলছে, “He was sweeping everything in sight. He would stick out his front foot and flat-bat the ball anywhere between mid-wicket and fine-leg.”

২৫৫ রানের লক্ষ্যটা খুব বড় না হলেও ইংলিশ বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সামনে এক পর্যায়ে খেই হারিয়ে ফেলে ভারত। ২০৫/৫ থেকে ২১৯ রান পর্যন্ত যেতেই হারায় সবকটি উইকেট। ৪ উইকেট নিয়ে ভারতীয় শিবিরে ধস নামান অফ স্পিনার এডি হেমিংস। ম্যাচসেরা হন গ্রাহাম গুচ।

৮ নভেম্বর, ১৯৮৭। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে শিরোপার লড়াইয়ে মুখোমুখি দুই 'ভিনদেশি' চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ড। দুদলের জন্যই এটা ছিল বিশ্বকাপের দ্বিতীয় ফাইনাল।

টসে জিতে আগে ব্যাটিং নেয়া অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৫ উইকেটে ২৫৩ রান। ইনিংসের ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন টুর্নামেন্টজুড়ে দারুণ ফর্মে থাকা ওপেনার ডেভিড বুন (৭৫) আর শেষদিকে নেমে চমৎকার একটি ক্যামিও উপহার দিয়েছিলেন মাইকেল ভ্যালেটা (৩১ বলে ৪৫*)।

তবে ইডেনের পিচে এই রান নিরাপদ ছিল না মোটেও। গ্রাহাম গুচ (৩৫), বিল অ্যাথি (৫৮) আর মাইক গ্যাটিংয়ের (৪১) ব্যাটে চড়ে প্রথম শিরোপা জয়ের পথে বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছিল ইংল্যান্ড। তবে কাল হয়ে দাঁড়াল অধিনায়ক গ্যাটিংয়ের সর্বনাশা রিভার্স সুইপ! দলীয় ১৩৫ রানের মাথায় অ্যালান বোর্ডারকে অযথা রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দেন তিনি। ব্যস, এতেই ঘুরে গেল ম্যাচের মোড়!

'ওয়েল সেট' ব্যাটসম্যান গ্যাটিংকে হারানোর ধাক্কাটা আর কিছুতেই সামাল দিতে পারে নি ইংল্যান্ড। শেষদিকে অ্যালান ল্যাম্ব (৪৫) সাধ্যমতো চেষ্টা করলেও মিডল আর লোয়ার অর্ডারের ব্যর্থতায় তাদের কপালে জোটে ৭ রানের হার। আর বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচাইতে উত্তেজনাপূর্ণ ফাইনাল জিতে প্রথমবারের মত বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব অর্জন করে অস্ট্রেলিয়া।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

উইন্ডিজ: ৫০ ওভারে ৫ উইকেটে ২৫৩ (বুন ৭৫, ভ্যালেটা ৪৫*, জোন্স ৩৩, হেমিংস ২/৪৮)

ইংল্যান্ড: ৫০ ওভারে ৮ উইকেটে ২৪৬ (অ্যাথি ৫৮, ল্যাম্ব ৪৫, গ্যাটিং ৪১, স্টিভ ওয়াহ ২/৩৭)

ম্যাচসেরা: ডেভিড বুন।

টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ফেভারিটের তকমাটা ছিল 'ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন' ভারত আর পাকিস্তানের ওপরই। দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ও প্রথম তিন আসরের ফাইনালিস্ট ওয়েস্ট ইন্ডিজকেও ফেবারিট ধরেছিলেন অনেকে। ক্লাইভ লয়েডের অবসর কিংবা চোটের কারণে গর্ডন গ্রিনিজ, ম্যালকম মার্শালদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও শক্তিমত্তায় খুব একটা পিছিয়ে ছিল না ভিভ রিচার্ডসের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্বকাপের অন্যতম ধারাবাহিক দল ইংল্যান্ডকেই বা ফেলে দেবেন কী করে? তবে আগের দুই আসরের গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নেয়া অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে বাজি ধরার লোক ছিল খুব কমই। কাগজে-কলমে অস্ট্রেলিয়ার স্কোয়াডটাও তেমন শক্তিশালী ছিল না। এক ঝাঁক তরুণ, অনভিজ্ঞ ক্রিকেটার নিয়েই উপমহাদেশে এসেছিল তারা। ১৪ জনের স্কোয়াডে একমাত্র অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডার ছাড়া বাকি ১৩ জনেরই বিশ্বকাপ খেলার পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। অথচ শেষ পর্যন্ত কিনা তাদের হাতেই উঠেছিল ট্রফি! ১৯৮৩ বিশ্বকাপের মত 'অকল্পনীয়' না হলেও অ্যালান বোর্ডারের দলের শিরোপা জয়কে গণ্য করা হয় 'সারপ্রাইজ' হিসেবে। 

এবারে চলুন এক নজরে দেখে নিই ১৯৮৭ বিশ্বকাপের উল্লেখযোগ্য কিছু পরিসংখ্যান।

ব্যাটিং:

• সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৬০/৪, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা।

• সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক: গ্রাহাম গুচ (ইংল্যান্ড) ৫৮.৮৭ গড়ে ৪৭১ রান; দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ডেভিড বুন (অস্ট্রেলিয়া) ৫৫.৮৭ গড়ে ৪৪৭ রান।

• ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ইনিংস: ভিভ রিচার্ডস ১৮১*, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা।

• সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি: ২টি, জিওফ মার্শ (অস্ট্রেলিয়া)।

• সবচেয়ে বেশি হাফ সেঞ্চুরি: ৪টি, নভজ্যোত সিং সিধু (ভারত)।

সবচেয়ে বেশি ছক্কা: ৯টি, নভজ্যোত সিং সিধু (ভারত)।

বোলিং:

• সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি: ক্রেইগ ম্যাকডারমট (অস্ট্রেলিয়া) ১৮ উইকেট; দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন ইমরান খান (পাকিস্তান) ১৭ উইকেট।

• সেরা বোলিং: ক্রেইগ ম্যাকডারমট (অস্ট্রেলিয়া) ৫/৪৪, বিপক্ষ পাকিস্তান।

• ৫ উইকেট: ১টি, ক্রেইগ ম্যাকডারমট (৫/৪৪)।

উইকেটকিপিং:

• সর্বোচ্চ ডিসমিসাল: কিরণ মোরে (ভারত), ১১টি।

ফিল্ডিং:

• সর্বোচ্চ ক্যাচ: ৫টি, কপিল দেব (ভারত)।