ক্রিকেট লিজেন্ডস

এক তর্জনী শিল্পীর গল্প

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 16:59 শুক্রবার, 10 মে, 2019

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

১৯৯৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের দলে ডাক পেয়েছিলেন কুড়ি বছরের এক তরুণ অফ স্পিনার। তবে সুযোগ হয়নি সেরা একাদশে। একই পরিণতি ২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের টেস্ট সিরিজেও। দু-দুটো টেস্ট সিরিজ রিজার্ভ বেঞ্চে কাটানোর পর অ্যাশলি জাইলসের ইনজুরিতে অবশেষে সুযোগ মেলে ওয়ানডেতে। কিন্তু ব্লুমফন্টেইনে অভিষেক ম্যাচে মাত্র ৫ ওভার বল করে উইকেটশূন্য থাকায় ছিটকে যান দল থেকে। এরপর নির্বাচকেরা আর ফিরেই তাকালেন না তাঁর দিকে।

তখন থেকেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবেরা তাঁকে খেপাতে আরম্ভ করল 'এক ম্যাচের প্লেয়ার' বলে। দুষ্টু বন্ধুরা যা করে থাকে আর কি! ট্র্যাজেডি নিয়েও রসিকতা! বন্ধুদের রসিকতায় তো আর রাগ করা যায় না তাই তাঁকেও সেসব হাসিমুখে মেনে নিতে হতো। কিন্তু মনের ভেতর ঠিকই তৈরি হতো জেদ। প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে একা একা প্রতিজ্ঞা করতেন, 'যেভাবেই হোক আবারও সুযোগ করে নিতে হবে ইংল্যান্ড জাতীয় দলে।'

এভাবেই কেটে গেল আটটি বছর। ২০০০ সালে প্রথম ওয়ানডে খেলার পর দীর্ঘ ৮ বছর বিরতি। অবশেষে ডাক পেলেন শ্রীলঙ্কা সফরের ওয়ানডে দলে। ততদিনে অবশ্য সেই ২০০০ সালে অভিষেক হওয়া দলটির অধিনায়ক নাসের হুসেইন, নিক নাইট, ড্যারেন গফ, গ্রায়েম হিকসহ ৯ জনই অবসর নিয়ে ফেলেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে। বিক্রম সোলাংকি, ক্রিস রিডরা তখনও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেললেও জাতীয় দল ছিল তাঁদের জন্য দূরের বাতিঘর! অথচ সোয়ান ফিরলেন রাজার মতো! হ্যাঁ, এতক্ষণ ধরে যার কথা বলছি, তিনি হলেন সাবেক ইংলিশ অফ স্পিনার গ্রায়েম সোয়ান। 

শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে দারুণ বোলিংয়ের পুরস্কারস্বরূপ ৪ ম্যাচে পেলেন ৮ উইকেট। পাশাপাশি অবদান রাখলেন ব্যাট হাতেও। একটা ম্যাচে ৩৭ বলে ৩৪ রানের 'ফিনিশিং নক' খেলে জেতালেন দলকে। আরেকটা ম্যাচে বল হাতে ৪ উইকেটের সাথে ব্যাট হাতে ১৭ বলে ২৫ রানের 'ক্যামিও' খেলে হলেন ম্যাচসেরা। তবে টেস্ট সিরিজটা এবারও কাটাতে হল বেঞ্চে বসেই। খুব বেশিদিন অবশ্য অপেক্ষা করতে হয় নি। ডিসেম্বরে ভারত সফরেই হয়ে গেল পরম আরাধ্য টেস্ট অভিষেক।

শুরুটা হয়েছিল একেবারে স্বপ্নের মতো। নিজের প্রথম ওভারেই তুলে নিলেন গৌতম গম্ভীর (৩য় বলে) আর রাহুল দ্রাবিড়ের (৬ষ্ঠ বলে) উইকেট। দুটোই এলবিডব্লু। ইতিহাসের মাত্র 'দ্বিতীয়' বোলার হিসেবে গড়লেন অভিষেক টেস্টের প্রথম ওভারে 'জোড়া উইকেট' শিকারের কীর্তি। প্রথমজন হলেন রিচার্ড জনসন। তিনিও ইংলিশ!

ভারত সফরে দুই টেস্ট খেলে সোয়ান নিয়েছিলেন ৮ উইকেট। সেই থেকে শুরু; এরপর আর কোনদিন পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ২০০৯ সালে এক পঞ্জিকাবর্ষে তুলে নিলেন ৫৪ উইকেট। জানিয়ে রাখি, এক বছরে কোন ইংলিশ স্পিনারের অর্ধশতাধিক টেস্ট উইকেট লাভের ঘটনা এটাই প্রথম!

অথচ বছরের শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দলে 'ফার্স্ট চয়েজ' স্পিনার হিসেবে রাখা হয়েছিল মন্টি পানেসারকে। কিন্তু সিরিজের প্রথম দুই টেস্টে প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে ব্যর্থ হন তিনি। তখন সোয়ান ছিলেন কেবল একটা সুযোগের অপেক্ষায়। অবশেষে অ্যান্টিগাতে তৃতীয় টেস্টেই এসে গেল সেই সুযোগ! আর সুযোগ পেয়েই ইনিংসে ৫ উইকেটসহ (৫/৫৭) নিলেন ৮ উইকেট। বারবাডোজে সিরিজের চতুর্থ টেস্টে আবারও নিলেন ৫ উইকেট।

"জ্যামাইকা টেস্টে আমাকে বাদ দিয়েছিল স্ট্রাউস। এরপরই পণ করলাম সুযোগ পেলে বোঝাব কী ভুলটাই না করেছে সে। আমার জন্য ওই সিরিজটা ছিল বিশাল এক টার্নিং পয়েন্ট"। নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের পুনর্জন্মের ব্যাখ্যা এভাবেই দিয়েছিলেন গ্রায়েম সোয়ান।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই ফিরতি সিরিজের প্রথম টেস্টে আরও একবার জ্বলে উঠলেন ব্যাটে-বলে। নয় নম্বরে নেমে ৬৩ রানের 'ভাইটাল' ইনিংস আর বল হাতে ৬ উইকেট নিয়ে জেতালেন দলকে; হলেন ম্যাচসেরা। অনেকের মতেই প্রথম ইনিংসে সোয়ানের ৫ ওভারের স্পেলটাই (৩/১৬) ছিল ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট।

সোয়ানের অ্যাশেজ অভিষেকটা অবশ্য মোটেও ভালো যায় নি। ক্যারিয়ারের প্রথম অ্যাশেজ। হয়ত স্নায়ুচাপে ভুগছিলেন বলেই কার্ডিফ টেস্টে ৩৮ ওভার বোলিং করেও ছিলেন উইকেটশূন্য! তবে দুই ইনিংসে ৪৭ ও ৩১ রান করে ব্যাট হাতে অবদান রেখেছিলেন ঠিকই। লর্ডসে বল হাতে ৪ উইকেট আর হেডিংলিতে ব্যাট হাতে ৬২ রানের ইনিংস খেলে দলে নিজের জায়গাটা টিকিয়ে রাখলেন। তারপর ওভালে শেষ টেস্টে নিলেন ৮ উইকেট (৪/৩৮ ও ৪/১২০)। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে করলেন 'মূল্যবান' ৬৩ রান।

আর এভাবেই ব্যাট হাতে দুটো ফিফটিসহ ২৪৯ রান ও বল হাতে ১৫ উইকেট পাওয়া সোয়ান হয়ে উঠলেন ইংলিশদের অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারের অন্যতম নায়ক।

অ্যাশেজ জিতলেও অ্যাশেজ পরবর্তী ওডিয়াই সিরিজটা ইংল্যান্ড হেরেছিল যাচ্ছেতাইভাবে। টানা ছয় ম্যাচ হারের পর শেষ ম্যাচে জয়ের মুখ দেখেছিল কেবল সোয়ানের কল্যাণে। বল হাতে ক্যারিয়ার সেরা ২৮ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন গ্রায়েম সোয়ান।

২০০৯ সালের ডিসেম্বর। দক্ষিণ আফ্রিকার গতিময় বাউন্সি উইকেট; যেখানে ঐতিহ্যগতভাবেই স্পিনারদের জন্য তেমন সহায়তা থাকে না। সেখানে একজন স্পিনার হয়েও দুর্দান্ত বোলিং করলেন সোয়ান। চার ম্যাচে দুইবার নিলেন ইনিংসে ৫ উইকেট। সেঞ্চুরিয়ন টেস্টে বল হাতে ৫ উইকেটের পর ব্যাট হাতে করলেন দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ও ক্যারিয়ার সেরা ৮৫ রান; জিতে নিলেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।

ডারবানে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ক্যারিয়ার সেরা ৯ উইকেট (৪/১১০ ও ৫/৫৪) নিয়ে ম্যাচসেরা হলেন আরও একবার। যে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে খেলে বাদ পড়েছিলেন, সেই একই দলের বিপক্ষে প্রায় ১০ বছর পর টানা দুটো টেস্টে তিনি 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ'!

কেপটাউনে সিরিজের তৃতীয় টেস্টে বল হাতে নিলেন ৫ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ৯ উইকেট পড়ার পর ব্যাট হাতে ১৮ মিনিট ক্রিজে অতিবাহিত করে ইংল্যান্ডের ম্যাচ বাঁচানোর অন্যতম নায়কও ছিলেন গ্রায়েম সোয়ান।

লোয়ার অর্ডারে নিয়মিত ব্যাট হাতে অবদান রাখার পাশাপাশি ৪ টেস্টে ২১ উইকেট নিয়ে সোয়ান হলেন সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি। স্বাভাবিকভাবেই সিরিজসেরার পুরস্কারটাও উঠেছিল তাঁর হাতেই। 

টেস্ট সিরিজ জিতলেও ওয়ানডে সিরিজে ইংল্যান্ডকে ফিরতে হয়েছিল খালি হাতেই। বল হাতে ৩ ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়েও দলকে হোয়াইটওয়াশের লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারেন নি সোয়ান।

দুর্দান্ত একটা বছর শেষ করেই থেমে থাকেন নি তিনি। ২০০৯ যেখান থেকে শেষ করেছেন, নতুন বছরটাও শুরু করেছিলেন সেখান থেকেই। আগের বছরে ৫৪ উইকেট পাওয়া সোয়ান ২০১০ সালে ৬৪ উইকেট নিয়ে ছাড়িয়ে যান নিজেকে।

বাংলাদেশ সফরে এসে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত শিকার করলেন ম্যাচে ১০ উইকেট, চট্টগ্রাম টেস্টে। ২৫ গড়ে ১৬ উইকেট নিয়ে দলকে সিরিজ জেতালেন ২-০ ব্যবধানে আর নিজে হলেন সিরিজসেরা। এরপর ওয়ানডে সিরিজে ৩ ম্যাচ খেলে নিলেন ৭ উইকেট।

২০১০ সালে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে অনুষ্ঠিত আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি২০ জিতে চমক দেখিয়েছিল ইংল্যান্ড। কারণ এটাই ছিল কোন বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে তাদের প্রথম শিরোপা। মাত্র ১৪ গড় আর ৬.৫ ইকোনমিতে ১০ উইকেট নিয়ে তাতে উল্লেখযোগ্য একটা ভূমিকা রেখেছিলেন গ্রায়েম সোয়ান।

ওয়ার্ল্ড টি২০ জয়ের পর পাকিস্তানের বিপক্ষে চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজে মাত্র ১২.২৫ গড়ে ২২ উইকেট নিয়ে দলের সিরিজ জয়ে (৩-১) নেতৃত্ব দিলেন সামনে থেকে। এরপর মাত্র ১৯ গড়ে পাঁচ ম্যাচে ১১ উইকেট নিয়ে জেতালেন ওয়ানডে সিরিজটাও।

২০১০-১১ সালে ইংলিশদের টানা দ্বিতীয়বারের মত অ্যাশেজ জয়ে অ্যান্ডারসন (২৪), ট্রেমলেটদের (১৮) পাশাপাশি ১৭ উইকেট নিয়ে বল হাতে অবদান রেখেছিলেন সোয়ানও।

অসাধারণ একটা বছর কাটানোর পর ২০১১ সালে সোয়ান জিতলেন 'ইংলিশ ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের' পুরস্কার। এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে সোয়ানের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত ইসিবি লিখেছিল, "Remarkable 12 months in which his attacking offspin and hard-hitting lower-order batting have proved instrumental in one of the most successful years that the England cricket team has ever known."

বল হাতে সোয়ানের ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের প্রতিফলন দেখা গেল র‍্যাঙ্কিং টেবিলেও। বিশ্বের বাঘা বাঘা বোলারকে টপকে সোয়ান উঠে এলেন আইসিসি টেস্ট বোলার র‍্যাঙ্কিংয়ের দ্বিতীয় স্থানে। স্পিনারদের মধ্যে শীর্ষস্থানটা অবশ্য অনেক দিন ধরেই ছিল সোয়ানের দখলে।

সোয়ানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন কিংবদন্তি লেগ স্পিনার শেন ওয়ার্নও। এক সাক্ষাৎকারে তিনি সোয়ানকে তাঁর দেখা বিশ্বের সবচাইতে 'ইম্প্রুভড' ক্রিকেটার হিসেবে উল্লেখ করেন।

২০১১ সালে ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মত অংশ নিলেন বিশ্বকাপে। শ্রীলঙ্কার কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে বাদ পড়া ইংলিশদের ব্যর্থ বিশ্বকাপ মিশনের অংশ ছিলেন সোয়ানও। খুব একটা খারাপ করেন নি অবশ্য; ৭ ম্যাচ খেলে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট।

২০১২ সালের এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের ম্যাচে ১০ উইকেট লাভ করেন সোয়ান। পিটারসেনের সেঞ্চুরি (১৫১) ও সোয়ানের দুর্দান্ত বোলিংয়ে (১০/১৮১) প্রথম টেস্ট হারের পর সিরিজে অবিশ্বাস্যভাবে ঘুরে দাঁড়ায় ইংলিশরা।

একই বছর ডিসেম্বরে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ভারতকে 'ভারতের মাটিতে' টেস্ট সিরিজ হারিয়ে ইতিহাস রচনা করে ইংল্যান্ড। যেখানে বল হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুই স্পিনার গ্রায়েম সোয়ান (২০ উইকেট) আর মন্টি পানেসার (১৭ উইকেট)। 

২০১২ সালেই ক্যারিয়ারে 'তৃতীয়বারের' মত এক পঞ্জিকাবর্ষে ৫০ বা তার বেশি উইকেট লাভের কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। সে বছর টেস্টে ২৭.৯৩ গড়ে নিয়েছিলেন ৫৯ উইকেট।

২০১৩ সালে টানা তৃতীয়বারের অ্যাশেজ শিরোপা ঘরে তোলে ইংল্যান্ড। দুবার ইনিংসে ৫ উইকেটসহ ২৬ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা বোলার ছিলেন গ্রায়েম সোয়ান। এর আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও টেস্ট সিরিজ জয়ের নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই ডানহাতি অফ স্পিনার। মাত্র ১৫ গড়ে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট।

টানা তিনটি অ্যাশেজ জয়ের পর ২০১৩-১৪ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ায় এসে রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়েছিল ইংলিশরা। সেবারের অ্যাশেজে বল হাতে জ্বলে উঠতে পারেন নি সোয়ান নিজেও; ছিলেন একেবারে বিবর্ণ! প্রথম ৩ টেস্টে সর্বসাকুল্যে পেয়েছিলেন মাত্র ৭ উইকেট!

টানা তিন ম্যাচ হেরে পিছিয়ে পড়ার হতাশাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি তিনি। তাছাড়া কনুইয়ের 'পুরনো' ইনজুরিটাও ভোগাচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। সিরিজের মাঝপথে তাই একরকম আচমকাই অবসরের ঘোষণা দিয়ে বসলেন তিনি! মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন সাবেক এই অফ স্পিনার। অথচ চাইলেই অন্তত আরও দুটো বছর তিনি খেলে যেতেই পারতেন। ইংল্যান্ড যে আজ পর্যন্তও তাঁর অভাব পূরণ করতে পারে নি!

২০০৮ সালে টেস্ট অভিষেকের পর থেকে কখনো একবারের জন্যও দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি। স্পিনে তাঁর ধারেকাছেও তো ইংল্যান্ডে এখনো কেউ নেই! ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন মাত্র ৬০টি। প্রায় ২৯ গড়ে সোয়ানের শিকার ২৫৫টি উইকেট। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ১৭ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট ৩ বার। আর ৭৯টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ঝুলিতে পুরেছেন ১০৪ উইকেট।

লোয়ার অর্ডারে সোয়ানের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংটাও ছিল দলের জন্য বাড়তি পাওনা। টেস্টে ৫টি ফিফটিসহ তাঁর সংগ্রহ ১৩৭০ রান। ব্যাটিং গড় ২২.০৯। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে আছে সেঞ্চুরি ৪টি, ৩৭টি হাফ সেঞ্চুরিসহ ৭৮১১ রান। নয় দশ নম্বরে নামা একজন লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানের জন্য সেটাও কম কিছু নয়!

সোয়ান ছিলেন ফ্লাইট এবং লুপনির্ভর একজন ক্ল্যাসিকাল অফ স্পিনার। আধুনিক অফ স্পিনারদের মতো ক্যারম বল বা দুসরায় নির্ভরতা ছিল না তাঁর। ফিঙ্গার স্পিনার হয়েও বোলিং একশন ছিল একদম নিখুঁত। হাই রিলিজ পয়েন্টের কারণে উইকেট থেকে বাড়তি বাউন্স বা 'ওভার স্পিন' আদায় করতে পারতেন। তাছাড়া বাতাসে খুব ভাল ড্রিফট পেতেন তিনি। অ্যাকুরেসি, কন্ট্রোল, অ্যাডাপ্টিবিলিটি, চেঞ্জ অব পেস আর বুদ্ধিমত্তায় ছিলেন অনন্য।

শেন ওয়ার্নের ভাষায়, “What has struck me most is that as an offspinner there are only certain ways you can get people out. But he [Swann] has more than that, he really changes his pace well. Normally when spinners bowl faster they lose their spin. But he can bowl quicker deliveries and still turn it.”

সোয়ানের ন্যাচারাল ভ্যারিয়েশন 'আর্ম বল'টাও বেশ কার্যকরী ছিল। তবে আর্ম বল ছাড়াও তাঁর একটা নিজস্ব ভ্যারিয়েশন ছিল যেটার নাম তিনি দিয়েছিলেন 'ফ্লাইং সসার বল'। আসলে টেকনিক্যালি বলটা ছিল টপ স্পিনার বা স্লাইডার; পড়ার পর তেমন টার্ন করত না কিন্তু আচমকা লাফিয়ে উঠত। সোয়ানের ভাষায়, “It rotates around its vertical axis and generally bounces straight on.”

সোয়ান ছিলেন একজন জেনুইন উইকেট টেকিং স্পিনার। রান আটকানোর চাইতে উইকেট নেবার দিকেই মনোযোগ দিতেন বেশি। বলে প্রচুর ফ্লাইট দিতেন; এমনকি টানা দু-তিনটি ছক্কা খাওয়ার পরেও ফ্লাইট দিতে পিছপা হতেন না। নিজের স্কিল ও সামর্থ্যের ওপর তাঁর ছিল শতভাগ আস্থা। সহজে ধৈর্য হারাতেন না। ব্যাটসম্যানকে খুব ভাল রিড করতে পারতেন। মোটকথা, সোয়ান জানতেন কীভাবে একজন ব্যাটসম্যানকে আউট করতে হয়।

শেন ওয়ার্নের ভাষায়, “He is always trying to work out in his mind how to get wickets. That is what I like about him – he attacks.”

মাত্র পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারেই তিনি ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ টেস্ট উইকেটের মালিক। ইংলিশ স্পিনারদের মধ্যে সোয়ানের (২৫৫) চেয়ে বেশি উইকেট পেয়েছেন কেবল সাবেক বাঁহাতি স্পিনার ডেরেক আন্ডারউড (২৯৭)। ১৯৮২ সালে আন্ডারউডের অবসরের পর এই সোয়ানের মধ্যেই প্রথম ম্যাচ জেতানো স্পিনারের দেখা পেয়েছিল ইংল্যান্ড।

সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক মাইকেল ভন যথার্থই বলেছেন, ‘গত ২০ বছরে সব ইংলিশ ক্রিকেটারের মধ্যে ওর (সোয়ানের) অভাবটাই সবচেয়ে বেশি অনুভব করব আমরা।'