ক্রিকেট লিজেন্ডস

শেন বন্ডঃ ফাস্ট, ফিউরিয়াস, ড্যাশিং

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 11:23 শনিবার, 23 ফেব্রুয়ারি, 2019

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

তাঁকে বলা হত স্যার রিচার্ড হ্যাডলির যোগ্য উত্তরসূরি। হ্যাডলির পর সত্যিকার অর্থেই নিউজিল্যান্ড পেয়েছিল এমন একজনকে, যিনি প্রতিপক্ষের শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত বইয়ে দিতে পারেন। যার সামনে সুযোগ ছিল সর্বকালের সেরা ফাস্ট বোলারদের ছোট্ট তালিকায় ঢুকে যাবার। সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছিলেন, কিন্তু ইনজুরি বাধায় এগোতে আর পারলেন কই? বলছিলাম হ্যাডলি পরবর্তী যুগে নিউজিল্যান্ডের অবিসংবাদিত সেরা ফাস্ট বোলার শেন বন্ডের কথা।

ফাস্ট, ফিউরিয়াস, ড্যাশিং! শেন বন্ডকে এককথায় পরিচয় করিয়ে দিতে এই তিনটি বিশেষণই যথেষ্ট। রূপালি পর্দার নায়ক জেমস বন্ড যেভাবে কৌশলে তার শত্রুদের ধরাশায়ী করেন, ক্রিকেট মাঠের শেন বন্ডও ঠিক সেভাবেই গতির সাথে সুইং মিশিয়ে ব্যাটসম্যানদের কুপোকাত করতেন। স্পেশাল এজেন্ট বন্ডের মারদাঙ্গা সিনেমার মতই অ্যাকশনে ভরপুর ছিল কিউই স্পিডস্টার বন্ডের ক্যারিয়ার।

সুঠাম দেহ, সুদর্শন চেহারা, আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা আর লড়াকু মানসিকতার অধিকারী বন্ডের প্রধান সম্পদ ছিল গতি। ঘন্টাপ্রতি ১৪৫ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি গতিতে বল করে আলোচনায় এসেছেন ক্যারিয়ারের একদম শুরু থেকেই। তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন বিশ্বের দ্রুততম 'তিন' ফাস্ট বোলারের একজন। ব্রেট লি আর শোয়েব আখতারের সাথে একই ব্র্যাকেটে উচ্চারিত হত শেন বন্ডের নামটাও। তবে বন্ডের ফাস্ট বোলারসুলভ আগ্রাসন যা ছিল সব মাঠের ভেতরেই, মাঠের বাইরে তিনি ছিলেন নিপাট ভদ্রলোক।

ফর্মের তুঙ্গে থাকা বন্ড ছিলেন ব্যাটসম্যানদের ত্রাস। বন্ডের গতির কাছে হার মানেন নি, এমন ব্যাটসম্যান বোধ হয় চাইলেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই গতির নেশাটাই শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল বন্ডের জন্য। একের পর এক ইনজুরি বাঁধিয়ে ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে মাঠের বাইরে।

বন্ডের কেবল দুরন্ত গতিই ছিল না, গতির সঙ্গে ছিল মনোমুগ্ধকর সুইংয়ের প্রদর্শনী। আর ছিল দারুণ কন্ট্রোল, অ্যাকুরেসি এবং বাউন্স। অধিকাংশ ফাস্ট বোলারের যেটা ছিল না কিন্তু বন্ডের ছিল, তা হল একই লাইন এবং লেংথে ক্রমাগত বোলিং করে যাবার ক্ষমতা। নিখুঁত লাইন-লেন্থের কারণে অনেক সময় তাঁকে তুলনা করা হত গ্লেন ম্যাকগ্রার সাথে। এছাড়াও বন্ডের আরেকটি বিশেষ গুণ ছিল ধারাবাহিকতা। ইনজুরি বাধায় ক্যারিয়ারে বারবার ছন্দপতন হয়েছে, কিন্তু ধারাবাহিকতায় এতটুকু ছেদ পড়তে দেন নি কখনো।

নিউজিল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিংয়ের ভাষায়, ”Bond combined fearsome pace with control and accuracy, assets which helped him find success in all forms of the game.”

বোলিংয়ের সময় খুব একটা লম্বা রানআপ নিতেন না বন্ড। তবে বোলিং অ্যাকশনটা ছিল চমৎকার ফ্লুইড, রিদমিক এবং অ্যাথলেটিক। নতুন বলে ইনসুইং এবং আউটসুইং দুটোই করাতে পারতেন; তবে ইনসুইংটা ছিল ন্যাচারাল। পাশাপাশি পুরোনো বলে রিভার্স সুইংয়েও ছিলেন পারদর্শী। তবে বন্ড সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিলেন লেট সুইংয়ে। এক্সপ্রেস গতির সাথে যখন লেট সুইং যোগ হত, রীতিমতো 'আনপ্লেয়েবল' হয়ে উঠতেন তিনি।

ব্যাটসম্যানের বুট লক্ষ্য করে ছোঁড়া তীব্র গতির ইয়র্কার বা 'টো ক্রাশার' দিয়ে স্টাম্প উপড়ে ফেলাকে রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করেছিলেন তিনি। বন্ডের লেট সুইং করে ভেতরে ঢোকা 'ইনডিপার'গুলো যেসব ব্যাটসম্যান ফেস করেছেন, একমাত্র তারাই জানেন কতটা বিপজ্জনক ডেলিভারি ছিল সেগুলো। বন্ডের ইয়র্কারে পায়ের অগ্রভাগ থেঁতলে যাওয়ার ভয়ে ম্যাথু হেইডেনের মত কেউ যখন বুটের ওপর 'টো-গার্ড' লাগিয়ে খেলতে নামেন, তখন আর বলার অপেক্ষা না যে ব্যাটসম্যানদের মনে ঠিক কতটা ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি!

বারবার ইনজুরির পাল্লায় পড়ে ক্যারিয়ারটা খুব বেশি লম্বা করতে পারেননি বন্ড। দীর্ঘ নয় বছরের ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলতে পেরেছেন মাত্র ১৮টি! তাতেই উইকেট নিয়েছেন ৮৭টি, গড় মাত্র ২২.০৯! স্ট্রাইক রেট ৩৮.৭! ইনিংসে ৫ উইকেট ৫ বার, ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়েছেন ১ বার। সেরা বোলিং ৫১ রানে ৬ উইকেট, হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে।

টেস্টে ৫০ উইকেটের মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন ১২তম ম্যাচেই, যা নিউজিল্যান্ডের পক্ষে দ্রুততম ৫০ উইকেটের রেকর্ড। ক্যারিয়ারটা পূর্ণতা পেলে হয়ত দেশের পক্ষে দ্রুততম ১০০ উইকেটের রেকর্ডও তাঁর হত (রেকর্ডটি স্যার রিচার্ড হ্যাডলির, ২৫ টেস্টে)।

উল্লেখ্য, একবিংশ শতাব্দীর ক্রিকেটারদের মধ্যে টেস্টে সেরা বোলিং গড়ের (২২.০৯) রেকর্ডটা বন্ডের দখলে।  আর বন্ডের ক্যারিয়ার স্ট্রাইক রেট (৩৮.৭) তো টেস্ট ইতিহাসেরই দ্বিতীয় সেরা! মাত্র ৩৪.১ স্ট্রাইক রেট নিয়ে এক নম্বরে আছেন ঊনবিংশ শতকের কিংবদন্তী পেসার জর্জ লোহম্যান।

টেস্টের মত সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও বন্ডের সাফল্যের পাল্লাটা বেশ ভারি। ৮২ ওয়ানডেতে তাঁর শিকার ১৪৭ উইকেট। উইকেটপ্রতি রান খরচ করেছেন একুশেরও কম! ৫ উইকেট চারবার আর ৪ উইকেট নিয়েছেন সাতবার। সেরা বোলিং ১৯ রানে ৬ উইকেট, বিপক্ষ ভারত।

একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অন্তত ১০০ উইকেট পাওয়া বোলারদের মধ্যে ৪র্থ সেরা বোলিং গড় (২০.৮৮) এবং ৩য় সেরা স্ট্রাইক রেটের (২৯.২) অধিকারী হওয়াটাও কিন্তু কম কৃতিত্বের নয়।

উল্লেখ্য, নিউজিল্যান্ডের হয়ে ওয়ানডেতে দ্রুততম ১০০ উইকেটের (৫৪ ম্যাচ) রেকর্ডটি বন্ডের দখলে।

এছাড়া কুড়িটি আন্তর্জাতিক টি২০ ম্যাচ খেলে বন্ড পেয়েছেন ২৫ উইকেট। ইকোনমি রেট মাত্র ৭! সেরা বোলিং শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৮ রানে ৩ উইকেট।

১৯৭৫ সালের ৭ জুন, তাসমান সাগরপাড়ের ছোট্ট দেশ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জন্মেছিলেন শেন এডওয়ার্ড বন্ড। ছোটবেলায় ক্রিকেট খেলতেন অনেকটা শখের বসেই। অন্যদের তুলনায় বন্ডের ফার্স্ট ক্লাস অভিষেকও হয়েছে বেশ খানিকটা দেরিতে, প্রায় ২২ বছর বয়সে! ক্যান্টারবুরির হয়ে নেমেছিলেন সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টসের বিপক্ষে। এমনকি নিয়মিত খেলতেনও না; ক্যারিয়ারের প্রথম তিন মৌসুমে প্রথম শ্রেণীর ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ১২টা!

নিউজিল্যান্ডের মত দেশে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে তেমন আয় রোজগার হত না বন্ডের। জীবিকার তাগিদে একদিন তাই ক্রিকেট ছেড়ে যোগ দিলেন পুলিশের চাকরিতে। কিন্তু কিছুতেই মন টিকল না সেখানে। অবশেষে ফিরে এলেন ২০০০-০১ মৌসুমে। কিছুদিনের মধ্যেই ফাস্ট বোলিং হয়ে উঠল তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান, মেতে উঠলেন গতির নেশায়।

নির্বাচকদের রাডারে ছিলেন অনেক দিন ধরেই, জাতীয় দলের দরজা খুলতে তাই খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি তাঁকে। ২০০১ সালে হোবার্টের বেলেরিভ ওভালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। অভিষেকে অবশ্য মনে রাখার মত খুব বেশি কিছু করতে পারেন নি তিনি। অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহকে শূন্য রানে ফিরিয়ে দিলেও বিনিময়ে গুনতে হয়েছিল ১৩৫ রানের মাশুল!

পার্থে পরের টেস্টের দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৭৪ ও ৮০ রান খরচায় নিলেন কেবল একটি করে উইকেট! অবশ্য তাঁর দুই শিকার হেইডেন আর ল্যাঙ্গারের কেউই রানের খাতা খুলতে পারেননি!

টেস্ট সিরিজ শেষে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভিবি ট্রায়াঙ্গুলার সিরিজ। বন্ডের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট বলা যায় এই সিরিজকেই। ৯ ম্যাচ খেলে মাত্র ১৬.৩৮ গড়ে ২১ উইকেট নিয়ে অভিষেক সিরিজেই নিজের জাত চিনিয়েছিলেন তিনি; হয়েছিলেন সিরিজসেরা।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে নিয়েছিলেন তিন উইকেট। কেয়ার্নস, ভেটোরি, বন্ড, হ্যারিসদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ১৯৯ রানের স্বল্প পুঁজি নিয়েও জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। বন্ডের শিকার তিন ব্যাটসম্যান ছিলেন যথাক্রমে মার্ক ওয়াহ (১), রিকি পন্টিং (৪৫) এবং মাইকেল বেভান (২৭)।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম ম্যাচসেরার পুরস্কারটাও পেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে, সিরিজের ৮ম ম্যাচে। মাত্র ২৫ রান খরচায় একাই নিয়েছিলেন ৫ উইকেট। বন্ডের বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ১৬৫ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল স্বাগতিকরা।

উল্লেখ্য, সেই সিরিজে অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক রিকি পন্টিংকে নিজের প্রিয় শিকার অর্থাৎ 'বানি'তে পরিণত করেছিলেন বন্ড। ছয়বারের দেখায় ৬ বারই আউট করেছিলেন পন্টিংকে!

২০০২ সালে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট সিরিজ (১-০) জয়ের কীর্তি গড়েছিল ব্ল্যাক ক্যাপসরা। যার অন্যতম নেপথ্য নায়ক ছিলেন শেন বন্ড। মাত্র ১৮.০ গড়ে ১২ উইকেট নিয়ে হয়েছিলেন সিরিজসেরা।

২০০৩ বিশ্বকাপের ৫ম সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি বোলার ছিলেন শেন বন্ড। ৮ ম্যাচ খেলে মাত্র ১৭.৯৪ গড়ে নিয়েছিলেন ১৭ উইকেট।

পোর্ট এলিজাবেথে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ এক ম্যাচে মাত্র ২৩ রানের বিনিময়ে ৬টি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন বন্ড। গিলক্রিস্ট, হেইডেন, পন্টিং, মার্টিন, সাইমন্ডসের মত ব্যাটসম্যানদের নামিয়ে এনেছিলেন সাধারণের পর্যায়ে! শেষ পর্যন্ত নিউজিল্যান্ড ম্যাচটা হেরে গেলেও তাই ম্যাচসেরার পুরস্কারটা উঠেছিল বন্ডের হাতেই।

উল্লেখ্য, বন্ডের ক্যারিয়ারের দ্রুততম ডেলিভারিটি রেকর্ড হয়েছিল ২০০৩ বিশ্বকাপে। ভারতের বিপক্ষে ঘন্টায় ১৫৬.৪ কিলোমিটার।

২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের মাটিতে অনুষ্ঠিত একটি ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতের বিপক্ষে মাত্র ১৯ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন বন্ড; যেটা ছিল তখনও পর্যন্ত ওয়ানডেতে কোন কিউই বোলারের সেরা বোলিং ফিগার। বন্ডের ভয়ঙ্কর গতি, অসহনীয় বাউন্স ও বিষাক্ত সুইংয়ের থাবায় রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়েছিল ভারতের 'তথাকথিত' বিশ্বসেরা ব্যাটিং লাইনআপ। কিউই পেসারদের বোলিং তোপে একটা সময় তাদের স্কোর দাঁড়িয়েছিল ৪৪/৮!

বন্ড সেদিন ধ্বংসযজ্ঞটা চালিয়েছিলেন মূলত উদ্বোধনী স্পেলে। বন্ডের করা ইনিংসের প্রথম ওভারটাই ছিল একটা মাস্টারক্লাস; বাঁহাতি ওপেনার সৌরভ গাঙ্গুলিকে রীতিমতো ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিলেন যে ওভারে। হাজার চেষ্টা করেও বন্ডের একটা বলে ব্যাট ছোঁয়াতে পারেন নি তিনি। 

বিখ্যাত সেই ওভারের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছিল ক্রিকেট বিষয়ক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট ক্রিকইনফো। সেটা হুবহু তুলে দিচ্ছি আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে। 

“The first ball, slanted across at great pace, looped up off a protective prod and fell between the two. 

The next, pitched short outside leg, climbed past Ganguly's chest above off, barely giving him time to register the ball. 

The third, a similar delivery but pushed further up, was fended without conviction. 

The fourth, again short and cutting across, carried the threat of injury but Ganguly evaded it reflexively. 

The fifth was a repeat of the fourth. Even Bond's run-up was intimidating now. 

The force with which he delivered the last ball was like a farewell explosion, aimed at the head, the edge, the batsman's self-respect. Somehow Ganguly survived.”

সাত ওভারের ভয়ঙ্কর সুন্দর এক স্পেলে (৭-৩-১৩-৫) বন্ড একে একে প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়েছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, বেণুগোপাল রাও, বীরেন্দর শেবাগ এবং মোহাম্মদ কাইফকে।

উল্লেখ্য, ২১৫ রানের মামুলি পুঁজি ডিফেন্ড করে ব্ল্যাক ক্যাপসরা জিতেছিল ৫১ রানে।

নাথান অ্যাস্টলের সেঞ্চুরিতে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল নিউজিল্যান্ড। আর মাত্র ৮.৬৪ গড়ে ১১ উইকেট নিয়ে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছিলেন শেন বন্ড।

কেবল ওয়ানডে সিরিজই নয়, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজেও কিউইদের জয়ের নায়ক ছিলেন শেন বন্ড। যথারীতি সিরিজসেরার পুরস্কারটা উঠেছিল মাত্র ৯.২৩ গড়ে ১৩ উইকেট পাওয়া বন্ডের হাতেই। 

২০০৬ সালের মার্চে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মত ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেন বন্ড। অকল্যান্ড টেস্টের শেষ দিনে লারা (০), সারওয়ান (৪), ব্রাভো (১৭) এবং ডুইন স্মিথকে (০) ফিরিয়ে দেয়া 'শ্বাসরূদ্ধকর' এক স্পেলের জন্য ম্যাচসেরাও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। উত্তেজনায় ঠাসা নাটকীয়তায় ভরপুর এক লড়াই শেষে ব্ল্যাক ক্যাপসরা জিতেছিল মাত্র ২৭ রানে।

২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইতিহাসে প্রথমবারের মত ট্রান্স-তাসমান সিরিজে অস্ট্রেলিয়াকে হোয়াইটওয়াশ (৩-০) করেছিল নিউজিল্যান্ড। সিরিজের সেরা বোলার বন্ড মাত্র ১০.৩৩ গড়ে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট; অবিশ্বাস্য ৩.৩৫ ইকোনমি রেটে!

সিরিজের প্রথম ম্যাচটা হয়েছিল ওয়েলিংটনে। যে ম্যাচে ৯.৩ ওভার বোলিং করে মাত্র ২৩ রানে ৫ উইকেটের এক অবিস্মরণীয় স্পেল উপহার দিয়েছিলেন বন্ড। যার সৌজন্যে অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয়েছিল দেড়শ'র নিচে! হেরেছিল ১০ উইকেটের লজ্জাজনক ব্যবধানে!

বিধ্বংসী সেই স্পেল প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণায় ম্যাথু হেইডেন বলেন, “He was close to unplayable on that day. He bowled beautifully with clever variations and used the new ball to full effect.”

২০০৭ বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সেমিফাইনালে ওঠার পেছনেও উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল বন্ডের। ৮ ম্যাচ খেলে মাত্র ১৬.৩৮ গড়ে নিয়েছিলেন ১৩ উইকেট।

উল্লেখ্য, দুটি বিশ্বকাপ খেলে বন্ডের শিকার ৩০ উইকেট, মাত্র ১৭.২৩ গড়ে! সবথেকে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বকাপে বন্ডের ইকোনমি রেট মাত্র ৩.৫১! এই মারকাটারি ব্যাটিংয়ের যুগে একজন ফাস্ট বোলারের জন্য যা রীতিমতো গর্বের ব্যাপার!

২০০৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বর্ষসেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন শেন বন্ড। এছাড়া আইসিসি মনোনীত বর্ষসেরা টেস্ট একাদশেও জায়গা পেয়েছিলেন তিনি।

২০০৮ সালের জানুয়ারিতে বন্ড নাম লিখিয়েছিলেন ভারতের ‘বিতর্কিত’ টি২০ লীগ আইসিএলে। যার অপরাধে বন্ডের সাথে কেন্দ্রীয় চুক্তি বাতিল করেছিল নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। ফলে প্রায় দুই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নির্বাসনে ছিলেন তিনি। তবে এ ঘটনায় নিজেকে 'নির্দোষ' এবং 'অন্যায়ের শিকার' বলে দাবি করেছিলেন সাবেক এই স্পিডস্টার। 

২০০৯ সালের নভেম্বরে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে শেষবারের মত ফিরেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সাদা পোশাক আর লাল বলের হোম সিরিজের দলে। প্রত্যাবর্তনের ম্যাচে দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট, হয়েছিলেন ম্যাচসেরা। শেন বন্ড কি তখনও ভাবতে পেরেছিলেন পাকিস্তানের বিপক্ষে ডানেডিন টেস্টটাই হয়ে থাকবে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট? কিংবা মোহাম্মদ আসিফকে করা মেডেন ওভারটিই হয়ে থাকবে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর শেষ ওভার?

টেস্ট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডিসেম্বরে। ইচ্ছা ছিল, ইনজুরি বাঁচিয়ে আরো কিছুদিন সীমিত ওভারের ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু ইনজুরির কাছে হার মেনে শেষ পর্যন্ত সব ধরনের ক্রিকেট থেকেই অবসর নিয়ে ফেলেন বন্ড। ২০১০ সালের ১০ মে, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কুড়ি ওভারের ম্যাচটাই হয়ে রইল বন্ডের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

খেলোয়াড়ি জীবন শেষে বন্ড বেছে নিয়েছেন পেশাদার কোচিং ক্যারিয়ার। ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্ল্যাক ক্যাপসদের বোলিং কোচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। সাউদি-বোল্ট-হেনরি--ফার্গুসনদের আজকের এই উত্থানের পেছনে মূল কৃতিত্বটা বন্ডকেই দেয়া হয়। নিউজিল্যান্ড ২০১৫ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পর কোচিং ছেড়ে কিছুদিনের জন্য ছিলেন স্কাই স্পোর্টসের ধারাভাষ্য প্যানেলে। ২০১৭ তে নিয়োগ পান আইপিএলের দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বোলিং উপদেষ্টা হিসেবে। বর্তমানে নিয়োজিত আছেন বিগব্যাশের দল সিডনি থান্ডার্সের হেড কোচের দায়িত্বে।

শেন বন্ডকে বলা হত 'বিগ ম্যাচ প্লেয়ার'। বড় দলের বিপক্ষে হাই ভোল্টেজ ম্যাচে একটু বেশিই ভাল খেলতেন সব সময়। মজার ব্যাপার হল, বন্ড তাঁর সেরাটা সব সময় জমিয়ে রাখতেন 'পুরনো শত্রু' অস্ট্রেলিয়ার জন্য! 

ওয়ানডেতে অজিদের বিপক্ষে ১৭ ম্যাচে বন্ডের শিকার মাত্র ১৫.৭৯ গড়ে ৪৪ উইকেট! ইনিংসে ৫ এবং ৪ উইকেট নিয়েছেন তিনবার করে! এমনকি ক্যারিয়ারের একমাত্র ওডিয়াই হ্যাটট্রিকটাও করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে! ২০০৭ সালে হোবার্টের বেলেরিভ ওভালে পর পর তিন বলে ফিরিয়েছিলেন ক্যামেরন হোয়াইট, এন্ড্রু সাইমন্ডস এবং নাথান ব্র্যাকেনকে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কীর্তির অভাব নেই বন্ডের। ওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক, প্রথম ছয়বারের দেখায় ছয়বারই রিকি পন্টিংকে আউট করা, ব্রায়ান লারাকে চার টেস্টে তিনবার আউট করা, গিলক্রিস্ট-শেবাগদের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানদের ব্যাটের লাগাম টেনে ধরা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট সিরিজ জিতে ইতিহাস গড়ায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া, দেশের হয়ে দ্রুততম ৫০ (টেস্ট) এবং ১০০ (ওয়ানডে) উইকেটের রেকর্ড গড়া, আরও কত কী! তবে চোটাঘাতে জর্জরিত অমিত সম্ভাবনাময় এক ক্যারিয়ারের অসম্পূর্ণ গল্পটা যে শুধুই আক্ষেপের!

শেষ করব বন্ডকে নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি উক্তি দিয়ে, "For New Zealand, he was their new Richard Hadlee. For the world, he was Bond, Shane Bond."