সাক্ষাৎকার

শ্রীনি, মাশরাফি-ধাওয়ানদের ইঞ্জিনিয়ার

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 19:45 সোমবার, 11 ফেব্রুয়ারি, 2019

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেপন্ডেন্ট ||

শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন... ২৭ বছর বয়সী দক্ষিণ ভারতের এই তরুণ উপমহাদেশের অধিকাংশ তারকা ক্রিকেটারদের বন্ধু বনে গেছেন। ক্রিকেটারদের ক্রিকেটীয় রোগবালাই এর সমাধান তাঁর জন্য কোনো ব্যাপারই না। বাংলাদেশ জাতীয় দলের তারকা এক ক্রিকেটারের ভাষায়, 'শক্তি দুর্বলতা বের করা শ্রীনির ২ মিনিটের কাজ।' শ্রীনি পড়াশোনা করেছেন কম্পিউটার ইঞ্জিয়ারিং বিষয়ে। কাজ করছেন ক্রিকেটে অ্যানালিস্ট হিসেবে। ইঞ্জিনিয়ারিং গুণ ব্যবহার করে ক্রিকেটারদের শক্তি, দুর্বলতা ও সমাধান খুঁজে বের করে কোচ ও অধিনায়ককে সাহায্য করে থাকেন তিনি। বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাথে আছেন এক বছরের মতন। একই সাথে বিপিএলে রংপুর রাইডার্স, আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ ও পিএসএলে মুলতান সুলতানের অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করছেন তিনি। ক্রিকফ্রেঞ্জির সাথে বিশেষ সাক্ষাৎকারে একজন ইঞ্জিনিয়ার থেকে টেস্ট খেলুড়ে দেশের সাপোর্ট স্টাফের অংশ হওয়ার গল্প বলেছেন শ্রীনিবাস চন্দ্রশেখরন। 

পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হল...

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে ক্রিকেটে কিভাবে আসলেন?

শ্রীনিঃ আমি বিভাগীয় দলের হয়ে খেলছিলাম। আমার এক কোচ এসে বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করার পর তোমার পরিকল্পনা কী? আমি বলেছি আমার কোন ধরনের ভবিষ্যৎ ভাবনা নেই। তবে যাই হোক না কেনো, আমি স্পোর্টস সম্পর্কিত কোন জায়গায় কাজ করতে চাই। আমি শুধু ক্রিকেটে নয়, অন্য স্পোর্টসেও নজর ছিল আমার। তখন তিনি আমাকে বলেছেন, 'এখানে এক কোম্পানি (অ্যানালিস্ট কোম্পানি) আছে। তুমি সেখানে গিয়ে সাক্ষাৎকার দিচ্ছ না কেনো?' তখন আমি সাক্ষাৎকার দিলাম এবং সবকিছু জায়গামত বসে গেল। এরপর আমরা রঞ্জি ট্রফিতে কাজ করা শুরু করলাম। সেই বছর আমরা ভারতের সব ঘরোয়া টুর্নামেন্ট জয় করেছি। পর পর দুই বছর এভাবে কাজ করেছি, সাফল্যের সাথে। মানুষজন তখন আমাকে চিনতে শুরু করে। এরপর হায়দ্রাবাদের যোগ দেই। সেই বছর হায়দ্রাবাদও আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর বিপিএলে যোগ দেই, বিপিএলেও রংপুরের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হই।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ অ্যানালিস্ট হতে চাইলে কি করতে হবে?

শ্রীনিঃ প্রথম যে বিষয়টা বেশি দরকার, তা হলো খেলার প্রতি তীব্র আকর্ষণ থাকতে হবে। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবাই মনে করে যে সফটওয়ারই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আসলে তা নয়। আসল ব্যাপার হলো খেলার বিষয়ে আপনার জ্ঞান। আপনি যখন এই বিভিন্ন লিগে চোখ রাখবেন, তখন কিন্তু একজন খেলোয়াড় সম্পর্কে আপনার ধারণা বেড়ে যাবে। এবং সেই খেলোয়াড়ের বিপক্ষে যখন আপনি খেলতে যাবেন, বা আপনার দল খেলতে যাবে, তখন কিন্তু তার সম্পর্কে আপনার ধারণাও কাজে দেবে। মূল কথা হলো, খেলাটা আরো বেশি করে মনোযোগ দিয়ে দেখা। টিভি স্ক্রিনে খেলা দেখে আপনি অনেক কিছু বুঝতে পারবেন না। আপনাকে তাই চিন্তা করতে হবে। ভাবতে হবে একজন খেলোয়াড় কেনো এটা করছে, কেনো ওটা করছে। কেনো অধিনায়ক অমুককে বল দিলো, কেনো অমুককে বল দিলো ইত্যাদি। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ একজন সর্বোচ্চ পর্যায়ের অ্যানালিস্টের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী?

শ্রীনিঃ একজন অ্যানালিস্টের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো খেলোয়াড়দের কাছাকাছি যাওয়া। মিটিংয়ে নিজের কথার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে চিন্তাটা তুলে ধরা। এটা খুব কঠিন। কিন্তু এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ কোনো ম্যাচ হারলে খেলোয়াড় বা কোচের সাথে অ্যানালিস্টেরও কী জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হয়?

শ্রীনিঃ আসলে আমরাও কিন্তু সাপোর্ট স্টাফ। কোচ এবং অ্যানালিস্ট কিন্তু সাপোর্ট স্টাফদেরই অন্তর্ভুক্ত। আমি, বোলিং কোচ, ব্যাটিং কোচ সবাই। কেউ কিন্তু কোনো ম্যাচ হারতে চায় না। তারপরও যদি কেউ হেরে যায়, তাহলে সেটাই মনে নিতে হয়। কখনো কখনো প্রতিপক্ষ অসাধারণ কিছু করে ফেলে। যেমন, নিদাহাস ট্রফিতে দিনেশ কার্তিক দারুণ খেলে বাংলাদেশকে হারিয়ে দেয়। এ ধরনের কিছু হলে তা মেনে নিতে হয়। ক্রিকেটে এরকম হয়। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ এমন নিশ্চয় হয় যে, আপনি হয়তো পরিকল্পনা করেছেন, কিন্তু সেটা মাঠে কাজে লাগেনি, এমন অবস্থায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করেন কিভাবে?

শ্রীনিঃ দেশ-কন্ডিশন বা উইকেটের কারণে অনেক কিছু হয়। অনেক সময় দেখা যায় একটা পরিকল্পনা নিয়ে আমরা খেলা শুরু করি, কিন্তু একটা ওভার পরেই দেখা যায় কন্ডিশন আমাদের ধারণার মতো নয়। তখন সাথে সাথে প্ল্যান 'বি' প্রয়োগ করার নির্দেশনা পাঠানো। সব সময়ই প্ল্যান 'এ', প্ল্যান 'বি' থাকে। সুতরাং পরিস্থিতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা করতে হয়। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা আপনার অনেক প্রশংসা করেন...

শ্রীনিঃ আমি যেহেতু ক্রিকেট খেলেছি, আমি নিজেই একজন ক্রিকেটার ছিলাম। সুতরাং ক্রিকেট আমার জন্য যথেষ্ট আবেগের, প্রায় ১৫-২০ বছর ধরে। আমি সব কিছুর খোঁজ রাখি। মনে করেন আমি এখন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগের সাথে আছি, আমি শুধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ দেখি না। আমি নিশ্চিত করি সারা বিশ্বের ক্রিকেটের খোঁজ খবর রাখতে, সব ধরনের তথ্য রাখতে। আর প্লেয়ারদের সাথে আমার বিশ্ব ও আস্থার বিষয় আছে। আমি যখন বিশ্বাসটা তৈরি করতে পারি, তখন তাঁরা বুঝতে পারে কি করা উচিত, কি করা উচিত না। তখন আপনি পরিকল্পনা করে সফল হতে পারবেন। আর ম্যাশ খুবই সহযোগিতাপরায়ন। সে যেহেতু জাতীয় দল ও রংপুরের অধিনায়ক, আমার তাঁর সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে। আমি যেই জিনিসটাই মনে করি শেয়ার করার মতন, আমি সেটা তাঁকে জানাই ও সে ভালো ভাবেই গ্রহন করে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ টেস্ট দলের হয়ে কাজ করা, গর্বের বিষয় অবশ্যই?

শ্রীনিঃ হ্যাঁ অবশ্যই। আমি শুধু ম্যাশ ও আরও কয়েকজন নয়, বাকি সবার সাথেই খুবই ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। এখানকার সাপোর্ট স্টাফ খুবই সহযোগিতাপরায়ণ। আমরা অনেকটা পরিবারের মতন। শুধু ক্রিকেটীয় সম্পর্ক নয়, ক্রিকেটের বাইরেও অনেক বিষয়ে আমরা একে অন্যের কাছে শেয়ার করে থাকি। অনেকটা বন্ধুর মতন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক খুশি ছিলাম, যখন আমি বাংলাদেশ দলের হয়ে ডাক পেয়েছিলাম। আমি আশা করছি আমি নিয়মিত বাংলাদেশ দলের হয়ে কাজ করতে পারব। আমি মুখিয়ে আছি, আরও সামনের বছর গুলোতে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করে যাওয়ার। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা আপনার কাজে কেমন আগ্রহ প্রকাশ করে?

শ্রীনিঃ প্রায় সবাই এটা করে। সবাই করে থাকে, এখন এত বেশি প্রযুক্তি আছে, তাদেরকেও প্রতিদিন উন্নতি করে যেতে হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকে থাকতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ, মুস্তাফিজের নাম নেয়া যায়। সে যখন এসেছিল, তাঁর যেই কাটার ছিল, সেগুলো ব্যাটসম্যানদের জন্য খেলার মতন ছিল না। এক বছর পর সবাই তার বোলিং বুঝে উঠতে পারে। সবাই ততক্ষণে যেতে গেছে ফিজ কি করতে পারে। এখন ফিজের কাজ কিভাবে সে বাকিদের থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে পারে। অনেকেই আছে এমন, মনে করেন লিটন দাসের মতন একজন, তাঁরা আমার কাছে আসে। কিন্তু এটা এমন না যে সবসময় তাঁরাই আমার কাছে আসবে, মাঝে মাঝে তাদেরকে আমার জানানো দরকার হয় তাঁরা ঠিক কাজটা করছে কিনা। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ এশিয়া কাপে মাশরাফির ক্যাচ ও শোয়েব মালিকের আউটের পেছনের গল্প কী ছিল?

শ্রীনিঃ টিম মিটিংয়ে আমাদের কথা হয়েছিল মালিকের সময় শর্ট মিড উইকেটে ফিল্ডার রাখার জন্য। তবে ম্যাশের ক্যাচটা অবিশ্বাস্য ছিল। আমি চিটাগং ভাইকিংয়ে ছিলাম এখানে আসার আগে। এশিয়া কাপের আগে পিএসএলে মুলতান সুলতান দলে ছিলাম আমি। আমি মালিককে খুব কাছ থেকেই দেখেছি, কিভাবে সে ইনিংস বড় করে সেটাও দেখেছি। আমি প্রতিপক্ষের দিকে না দেখে নিজেদের শক্তির দিকে আগে নজর দেই। এটা আমাকে গেইম প্ল্যান তৈরি করতে সাহায্য করে। এর মধ্যেই আমি খুঁজে পেয়েছি সে কিভাবে ইনিংস বড় করে। বাংলাদেশের হয়ে কাজ করার সময় এটা আমাকে সাহায্য করেছে। তখন আমি ম্যাশকে বলেছিলাম, এরপর সে অবিশ্বাস্য ম্যাচটি নিয়েছে। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ ভারতীয় অনেক তারকা ক্রিকেটারের সাথে আপনার ভালো সম্পর্ক... 

শ্রীনিঃ আমি ধাওয়ান (শেখর ধাওয়ান) ভাই এর সাথে ভালো সম্পর্ক গড়েছি। রাহুল (কেএল রাহুল) আমার খুব কাছের বন্ধুদের একজন। যেই দলের যান না কেন, যেখানেই কাজ করি না, আমার মূল কাজটা হল বিশ্বাস তৈরি করা। তাঁরা যদি আমাদের বিশ্বাস করে তাহলে তাঁরা আমার সাজেশন গুলো গ্রহন করে। যখন তাঁরা বুঝতে পারে, 'ওকে, সে কিছু জানে ক্রিকেট সম্পর্কে।' তখন আপনি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি শেয়ার করতে পারবেন। বাংলাদেশ কিংবা ভারতীয় যেই দলের প্লেয়ারই হোক না কেন, আপনি যাদের কাছে গিয়ে বলবেন না যে এটাই ঠিক, এটাই করুণ। বরং এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনি সেই বিশ্বাসটা তৈরি করা। তাঁরা আমার সাজেশন গ্রহন করবে নাকি করবে না সেটা তাদের বিষয়। আর সমাধান করা সহজ না। ওরা নেটে গিয়ে চেষ্টা করবে আমি যা বলেছি সেটা নিয়ে কাজ করতে, তাঁরা যদি ফলাফল পায় তখন এটা আমার জন্য সাফল্যের। প্লেয়াররা যদি চিন্তাও করে আমার সাজেশন নিয়ে, সেটাও আমার জন্য সাফল্যের।

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বিসিবির সাথে পূর্ণ মেয়াদে কাজ করতে চান না?

শ্রীনিঃ অবশ্যই চাই। কখনো ছুটি নিয়ে দেশে গেলে এক সপ্তাহ পরেই মনে হয় আমি কিছু একটা মিস করছি। আসলে এখানে ম্যাশ, তামিমের সাথে আমার সম্পর্কটা অন্য রকম। এ ছাড়া জুনিয়রদের সাথেও আমার সম্পর্ক ভালো। 

ক্রিকফ্রেঞ্জিঃ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন দেখেন?

শ্রীনিঃ গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ দারুণ সফল হয়েছে। সর্বশেষ চার এশিয়া কাপের তিনটাতেই ফাইনাল খেলেছে বাংলাদেশ। এরপর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল। সর্বশেষ এশিয়া কাপে আমরা জয় থেকে এক বছর দূরে ছিলাম। ছোট ছোট ব্যাপারগুলোই পার্থক্য গড়ে দেয়।