ক্রিকেট লেজেন্ডস

ভেরি ভেরি স্পেশাল

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 23:02 শুক্রবার, 14 ডিসেম্বর, 2018

|| ফ্রাইডে স্পেশাল ||

ভারতীয় ক্রিকেটের বিখ্যাত চার ব্যাটিং স্তম্ভের একজন হলেন ভিভিএস লক্ষণ। পুরো নাম ভাঙ্গিপুরাপ্পু ভেংকাটা সাই লক্ষ্মণ। টেকনিক্যালি সাউন্ড এবং টেম্পারমেন্টালি সলিড সাবেক এই ডানহাতি ব্যাটসম্যান বিখ্যাত ছিলেন তাঁর ন্যাচারাল ফ্লেয়ার এবং এলিগ্যান্সের কারণে। নমনীয় কব্জির মনোমুগ্ধকর রিস্টপ্লে ছিল তাঁর স্পেশালিটি। অফ স্টাম্পের অনেক বাইরের একটা বলকেও তিনি অনায়াসে কব্জির মোচড়ে লেগ সাইড বাউন্ডারিতে পাঠাতে পারতেন। ফ্লিক এবং গ্লান্সের পাশাপাশি কাভার ড্রাইভ, পুল আর স্কয়ার কাটটাও ভালোই খেলতেন। নিখুঁত টাইমিং ও প্লেসমেন্টের দিক থেকে তিনি ছিলেন সময়ের সেরাদের একজন।

উইজডেনের সাবেক সহ-সম্পাদক গিডিওন হেইয়ের ভাষায়, "At his sublime best, VVS Laxman is a sight for the gods. Wristy, willowy and sinuous, he has the rare gift of being able to hit the same ball to either side."

ক্রিকইনফোর বিশিষ্ট কলাম লেখক সম্বিত বলের ভাষায়, “There was no exaggeration to his movements: footwork minimal, bat-swing precise, wrists supple, and timing - the soul of his batting - ethereal.”

লক্ষ্মণের রিস্টপ্লে প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাবেক কোচ জন রাইট বলেছেন, “Watch him, but don't try to imitate. Only VVS can play them.”

মূলত মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হলেও ক্যারিয়ার জুড়ে ১ থেকে ১০ নম্বর পর্যন্ত প্রায় সব পজিশনে ব্যাট করেছেন লক্ষ্মণ। এমনকি ওপেনার হিসেবেও খুব একটা খারাপ ছিলেন না। তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসগুলোর বেশিরভাগই অবশ্য এসেছে ৩, ৫ এবং ৬ নম্বরে।

রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেটে লক্ষ্মণ ছিলেন কিছুটা শ্লথ। তবে এই অক্ষমতাকে তিনি ঢেকে দিয়েছিলেন তাঁর সহজাত স্ট্রোকপ্লে এবং কাউন্টার অ্যাটাক করতে পারার ক্ষমতা দিয়ে। বাজে বলকে যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে কখনও কার্পণ্য করতেন না তিনি। পেস অথবা স্পিন — দুই ধরনের বোলিংয়ের বিপক্ষেই ছিলেন সমান স্বচ্ছন্দ। বিশেষ করে স্পিনের বিপক্ষে তাঁকে মনে করা হয় সর্বকালের সেরাদের একজন।

চলুন জেনে আসি লক্ষ্মণের 'ভেরি ভেরি স্পেশাল' কিছু 'ম্যাচ উইনিং' এবং 'ম্যাচ সেভিং' ইনিংস সম্পর্কে।

❐ ৫১, বিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, আহমেদাবাদ, ১৯৯৬

লক্ষ্মণের অভিষেক টেস্ট। প্রথম ইনিংসে মাত্র ১১ রানে আউট হলেও জাত চিনিয়েছিলেন দ্বিতীয় ইনিংসে। ৮২ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকতে থাকা ভারতকে তিনি উদ্ধার করেছিলেন ১২৫ বলে ৫১ রানের সাহসী এক ইনিংস খেলে।

ভারতের বেঁধে দেয়া ১৭০ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে প্রোটিয়ারা অলআউট হয়েছিল ১১৫ রানে। পেসার জাভাগাল শ্রীনাথ একাই নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। জয়ের ব্যবধান ছিল ৫৪ রান। সুতরাং বলা যায়, লক্ষ্মণের ৫১ রানের 'ছোট্ট কিন্তু স্পেশাল' ইনিংসটাই ছিল ম্যাচের 'টার্নিং পয়েন্ট'।

❐ ১৬৭, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, সিডনি, ২০০০

৪০২ রানে পিছিয়ে থেকে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসের খেলা শুরু করেছিল ভারত। ড্র কিংবা জয় তো দূরের কথা; ইনিংস পরাজয় এড়ানোটাই ছিল মূল লক্ষ্য। এদিকে অস্ট্রেলীয় পেসারদের আগুনঝরা বোলিং তোপে ৩৩ রান তুলতেই ৩ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। ভিভিএস লক্ষ্মণের ক্যারিয়ারের 'প্রথম' টেস্ট সেঞ্চুরিটা তুলে নিতে এর চাইতে বিশেষ উপলক্ষ বোধ হয় আর হতে পারত না!

নিজের হাতে থাকা ব্যাটটাকে তলোয়ার বানিয়ে লক্ষ্মণ শুরু করলেন কাউন্টার অ্যাটাক; এবং সেটাও চিরচেনা শৈল্পিক ভঙ্গিমায়। ম্যাকগ্রা-লি-ফ্লেমিংদের পিটিয়ে ১৯৮ বলে খেললেন ১৬৭ রানের 'বিধ্বংসী কিন্তু নান্দনিক' এক ইনিংস, মাত্র সোয়া চার ঘন্টায়! বাউন্ডারি মেরেছিলেন ২৭টা!

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক ও ধারাভাষ্যকার ইয়ান চ্যাপেলের মতে, “A strike rate of 84 in a 150-plus knock was unheard of in those days. When all the Indian batsmen were falling like bowling pins, his batting was on a totally different level.”

শেষ পর্যন্ত ভারত ইনিংস পরাজয় এড়াতে না পারলেও লক্ষ্মণের ১৬৭ রানের মাস্টারক্লাসের মাহাত্ম্য তাতে এতটুকুও কমে যায় না; বরং আরও বেড়ে যায়। জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন যে, ভারতীয় ইনিংসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল মাত্র ২৫ রান! এসেছিল অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির ব্যাট থেকে।

❐ ২৮১, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, কলকাতা, ২০০১

২০০১ সালের বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির দ্বিতীয় টেস্ট। কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে টানা ১৬ টেস্ট জয়ী বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি ভারত। অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর দুর্দান্ত সেঞ্চুরি (১১০), ম্যাথু হেইডেনের ৯৭ এবং টেলএন্ডারদের দৃঢ়তায় প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ দাঁড়ায় ৪৪৫ রান। হরভজন সিং একাই নেন ৭ উইকেট।

জবাবে দ্বিতীয় দিন চা বিরতির কিছুক্ষণ আগে শুরু হওয়া ভারতের প্রথম ইনিংসটা শেষ হয় তৃতীয় দিন সকালেই; মাত্র ১৭১ রানে। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হবার আগে দলীয় সর্বোচ্চ ৫৯ রান আসে ভিভিএস লক্ষ্মণের ব্যাট থেকে।

২৭৪ রানে পিছিয়ে থাকায় ফলোঅনে পড়ে ভারত। প্রথম ইনিংসে ভাল করায় এদিন লক্ষ্মণকে তিন নম্বরে প্রমোশন দিয়েছিলেন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। লক্ষ্মণ যখন ব্যাটিংয়ে নামেন তখন দলীয় সংগ্রহ ছিল ১ উইকেটে ৫২ রান, অর্থাৎ তখনও ২২২ রানে পিছিয়ে ভারত। তারপর পঞ্চম দিন সকালে যখন তিনি আউট হলেন, ভারতের স্কোর তখন ৬০৮/৫! স্কোরবোর্ডে লক্ষণের নামের পাশে লেখা একটি সংখ্যা, ২৮১!

৪৫২ বলে ২৮১ রান! বাউন্ডারি ৪৪টা! প্রতিপক্ষ, কন্ডিশন ও পরিস্থিতি বিবেচনায় আক্ষরিক অর্থেই এটা ছিল 'অতিমানবীয়' ইনিংস। ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা 'ভেরি ভেরি ক্রুশাল' এই মাস্টারক্লাসের সৌজন্যেই ২৭৪ রানে পিছিয়ে থাকা ভারত অস্ট্রেলিয়াকে ছুঁড়ে দিতে পেরেছিল ৩৮৪ রানের বিশাল লক্ষ্য। যে লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে হরভজন সিংয়ের ঘুর্ণিজাদুতে (৬/৭৩) মাত্র ২১২ রানেই গুটিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়া। ফলোঅনে পড়া ভারত শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা জিতে নেয় ১৭১ রানে।

লক্ষণের '২৮১' রানের ইনিংসের 'ইমপ্যাক্ট' আসলে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। ৩৭৬ রানের 'এপিক' পার্টনারশিপ গড়ার পথে লক্ষ্মণকে যোগ্য সঙ্গ দেয়া রাহুল দ্রাবিড়ের অনবদ্য ১৮০ এবং হরভজন সিংয়ের ১৩ উইকেট শিকারের কীর্তিকেও আড়াল করে দিয়েছিল যে ইনিংস! লক্ষ্মণের ২৮১ রানের 'মহাকাব্যিক' ইনিংসটিকে সর্বকালের ৬ষ্ঠ সেরা টেস্ট ইনিংসের স্বীকৃতি দিয়েছে উইজডেন।

ওই ইনিংস প্রসঙ্গে এক স্মৃতিচারণায় শেন ওয়ার্ন বলেছিলেন, “I was bowling in the footmarks and Laxman was hitting the same ball through cover or whipping it through midwicket. It was so hard to bowl then.”

সাবেক অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির ভাষায়, “That innings had a big impact on Indian cricket. It had given us a huge sense of relief and made us have belief in ourselves that we’re not behind… Since then, we never looked back as Indian cricket kept improving.”

❐ ৬৯* ও ৭৪, বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পোর্ট অব স্পেন, ২০০২

টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরিতে (১১৭) ভর করে প্রথম ইনিংসে ভারত করেছিল ৩৩৯ রান। ৬ নম্বরে নেমে লক্ষ্মণ খেলেছিলেন ১২৩ বলে অপরাজিত ৬৯ রানের 'ভাইটাল' একটি ইনিংস। জাভাগাল শ্রীনাথকে নিয়ে শেষ উইকেট জুটিতে যোগ করেছিলেন ৪১ রান।

এরপর দ্বিতীয় ইনিংসেও লক্ষ্মণের ব্যাট থেকে এসেছিল ১৫৭ বলে ৭৪ রানের একটি 'গেম চেঞ্জিং' নক। মাত্র ৫৬ রানে ৪ উইকেট খুইয়ে পথ হারানো ভারত ঘুরে দাঁড়িয়েছিল লক্ষ্মণের ব্যাটে চড়েই।

চতুর্থ ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লক্ষ্য ছিল ৩১৩ রান। শেষ পর্যন্ত ২৭৫ রানে গিয়ে থেমেছিল তারা। ভারতের জয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র ৩৭ রান। লক্ষ্মণের ৬৯* ও ৭৪ রানের দুটি 'ভেরি ভেরি স্পেশাল' ইনিংসই মূলত ব্যবধান গড়ে দিয়েছিল খেলায়।

❐ ১৫৪*, বিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কলকাতা, ২০০২

১৩৯ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিল ভারত। তখনও খেলা বাকি প্রায় দুই দিন। এবং শুরুতেই ডানহাতি পেসার মারভিন ডিলনের জোড়া আঘাত! মাত্র ১১ রানের মধ্যেই নেই দুই ওপেনার শেবাগ ও বাঙ্গার। দলীয় ৭৭ রানের মাথায় যখন ৪র্থ উইকেটের পতন ঘটে, তখন রীতিমতো পরাজয়ের শঙ্কা জেঁকে বসে ভারতীয় শিবিরে। ভারত তখনও ৬২ রানে পিছিয়ে; অথচ খেলা বাকি প্রায় পাঁচ সেশনের মত।

খেলার এই যখন অবস্থা তখন শচীন টেন্ডুলকারকে নিয়ে দাপটের সাথে ঘুরে দাঁড়ান ভিভিএস লক্ষ্মণ। ৫ম উইকেট জুটিতে দুজনে মিলে যোগ করেন ২১৪ রান।

১৭৬ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে টেন্ডুলকার বিদায় নিলেও শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন লক্ষ্মণ। পার্থিব প্যাটেল, হরভজন, শ্রীনাথ, কুম্বলেদের নিয়ে বেশ কয়েকটি 'মাঝারি' সাইজের জুটি গড়েন তিনি। ৩৯৭ বলে অপরাজিত ১৫৪ রানের 'ম্যাচ সেভিং' ইনিংস খেলে 'জয়ের সমান' এক ড্র নিশ্চিত করে তবেই মাঠ ছাড়েন।

❐ ১৪৮, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, অ্যাডিলেড, ২০০৩

প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়া করেছিল ৫৫৬ রান। জবাব দিতে নেমে নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারাতে থাকে ভারত। লক্ষ্মণ যখন ব্যাটিংয়ে নামেন, তখন দলের স্কোর ৮৫/৪। এমন বিপর্যয়ের মুখ থেকে দলকে উদ্ধার করতে আরও একবার ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ভিভিএস। রাহুল দ্রাবিড়কে সাথে নিয়ে রচনা করেন আরও একটি অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের গল্প। ৫ম উইকেটে লক্ষ্মণ-দ্রাবিড় মিলে উপহার দেন ৩০৩ রানের আরও একটি মহাকাব্যিক জুটি।

দ্রাবিড় হাঁকিয়েছিলেন ডাবল সেঞ্চুরি আর লক্ষ্মণ খেলেছিলেন ২৮২ বলে ১৪৮ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। বাউন্ডারি মেরেছিলেন ১৮টা যার ১৩টাই ছিল অফ সাইডে!

এই ইনিংস সম্পর্কে ক্রিকইনফোর ম্যাচ রিপোর্টে লিখেছিল, “The Aussies targeted Laxman outside offstump but the languid strokeplayer had an answer on each occasion; of his 18 boundaries, 13 were placed through the offside.”

চতুর্থ ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার দেয়া ২৩০ রানের লক্ষ্যটা ভারত পেরিয়েছিল ৪ উইকেট হাতে রেখেই। ২৩৩ ও ৭২* রানের ইনিংস খেলে 'ম্যাচসেরা' হয়েছিলেন রাহুল দ্রাবিড়।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে জেতা ভারতের এই 'ঐতিহাসিক' টেস্ট ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে আছে দ্রাবিড়ের ব্যাটিং এবং আগারকারের (৬/৪১) বোলিং বীরত্বের জন্য। কিন্তু 'পার্শ্বনায়ক' লক্ষ্মণের ১৪৮ রানের ইনিংসটির অবদান কোন মতেই আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না।

❐ ১৭৮, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, সিডনি, ২০০৪

অনেক কারণেই এটা ছিল একটা ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচ। কিংবদন্তি অজি অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহর বিদায়ী টেস্ট ম্যাচ বলে কথা! অনবদ্য ৮০ রানের 'ম্যাচ সেভিং' ইনিংস খেলে টেস্ট ক্যারিয়ারের বিদায়লগ্নটাকে স্মরণীয় করে রেখেছিলেন তিনি। শচীন টেন্ডুলকারের সেই 'বিখ্যাত' ২৪১ রানের ইনিংসটাও এসেছিল এই ম্যাচেই। ম্যাচের রেজাল্টের ঘরে ড্র লেখা থাকলেও এই ম্যাচে ক্রিকেটীয় উত্তেজনার কোন কমতি ছিল না।

প্রথম ইনিংসে ভারত দাঁড় করিয়েছিল ৭০৫ রানের 'ম্যামথ' টোটাল। চতুর্থ উইকেটে শচীন-লক্ষ্মণ মিলে গড়েছিলেন ৩৫৩ রানের ম্যারাথন জুটি। লক্ষ্মণ উপহার দিয়েছিলেন ২৯৮ বলে ১৭৮ রানের একটি নিখুঁত, কমপ্যাক্ট ইনিংস। কেবল বাউন্ডারিই মেরেছিলেন ৩০টা। কোয়ালিটি ও ফ্লুয়েন্সি বিবেচনায় লক্ষ্মণের ২৮১ রানের ইনিংসটির চাইতেও সিডনির ১৭৮-কে এগিয়ে রাখেন অনেকে।

লক্ষ্মণে মুগ্ধ হয়ে টেন্ডুলকার নাকি বলেছিলেন, "When Laxman bats, you just watch. But tell yourself not to try those things."

অপূর্ব এই ইনিংসটির বর্ণনা দিতে গিয়ে উইজডেন লিখেছিল, “Laxman’s innings was simply magical. He caressed balls that pitched outside off through the leg side with the most delicate flicks of the wrist; he cut and drove on both front and back foot with flowing grace; and yet, there was no risk in his batting.”

❐ ৬৯, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, মুম্বাই, ২০০৪

ইতিহাসের অন্যতম ঘটনাবহুল টেস্ট ম্যাচ ছিল এটি। প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতে হেরে সিরিজে ২-০ তে পিছিয়ে ছিল ভারত। এদিকে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের পিচকে বলা হচ্ছিল ডাস্টবোল বা ধূলির আধার। অজি দলপতি রিকি পন্টিং স্বয়ং যে উইকেটকে ‘nowhere near test standard’ বলে রায় দিয়েছিলেন।

ঐতিহাসিক মুম্বাই টেস্ট স্মরণীয় হয়ে থাকার কারণ আছে বেশ কয়েকটি। বৃষ্টির কারণে প্রথম দিনে খেলা হয়েছিল মাত্র ১১ ওভার। তারপরেও ম্যাচে ফলাফল এসেছিল মাত্র ৩ দিনেই! ১০৭ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ৯৩ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া! শুধুমাত্র তৃতীয় দিনেই পড়েছিল ২০ উইকেট! পার্টটাইম বাঁহাতি স্পিনার মাইকেল ক্লার্কের ওপর ভর করেছিল জনি ব্রিগসের আত্মা! মাত্র ৯ রান খরচায় ক্লার্ক একাই নিয়েছিলেন ৬ উইকেট!

এরকম ভুতুড়ে এক ম্যাচে, আনপ্লেয়েবল পিচে ১২৭ বলে ৬৯ রানের এক অনবদ্য মাস্টারক্লাস উপহার দিয়েছিলেন একজন। নাম তাঁর ভিভিএস লক্ষ্মণ। দুদলের চার ইনিংস মিলিয়ে এটাই ছিল সর্বোচ্চ ইনিংস। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে লক্ষ্মণের ৬৯ আর টেন্ডুলকারের ৫৫ — এই দুটো ইনিংসই মূলত ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

❐ ৭৯, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, পার্থ, ২০০৮

স্টিভ বাকনর ও মার্ক বেনসনের বাজে আম্পায়ারিং এবং কুখ্যাত মাঙ্কিগেট কেলেঙ্কারির কারণে কলঙ্কিত সেই সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছিল স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া এবং ভারত।

এদিকে 'দ্বিতীয়বারের' মত টানা ১৬ টেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়া অস্ট্রেলিয়ার সামনে ১৭তম টেস্ট জয়ের হাতছানি। স্মরণীয় এই উপলক্ষের জন্য পার্থের ওয়াকার চেয়ে উপযুক্ত ভেন্যু বোধ হয় আর হতে পারত না। কিন্তু রিকি পন্টিংকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে উল্টো ভারতই ম্যাচটা জিতে নিয়েছিল ৭২ রানে!

প্রথম ইনিংসে স্বাগতিকদের বিরুদ্ধে ১১৮ রানের 'হেলদি' লিড পেয়েছিল ভারত। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নেমে মোটেই সুবিধা করতে পারছিল না তারা। ১২৫ রান তুলতেই হারিয়ে বসেছিল ৬ উইকেট! সেখান থেকে দলীয় স্কোরটা তিনশ'র কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার পুরো কৃতিত্বটাই ছিল ভিভিএস লক্ষ্মণের। এক প্রান্ত আগলে রেখে টেলএন্ডারদের সহায়তায় তিনি খেলেছিলেন ১৫৬ বলে ৭৯ রানের একটি 'ক্রুশাল' ইনিংস।

চতুর্থ ইনিংসে জয়ের জন্য অজিদের সামনে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪১৩ রান। শেষ পর্যন্ত তারা অলআউট হয় ৩৪০ রানে। 'লক্ষ্মণ মাস্টারক্লাস' বাদেও এ ম্যাচের আরও একটি হাইলাইটস হয়ে থাকবে 'রিকি পন্টিং ভার্সেস ইশান্ত শর্মা দ্বৈরথ'।

❐ ১০৩*, বিপক্ষ শ্রীলঙ্কা, কলম্বো, ২০১০

ইতিমধ্যেই সিরিজে ১-০ তে পিছিয়ে ভারত। পি সারা ওভালের স্পিনিং ট্র্যাকে জয়ের জন্য ভারতের লক্ষ্য দাঁড়াল ২৫৭ রান। এদিকে শ্রীলঙ্কার বোলিং আক্রমণে রয়েছে তিন ইনফর্ম বোলার — সুরজ রণদীভ, লাসিথ মালিঙ্গা এবং অজান্তা মেন্ডিস।

তৃতীয় দিন শেষে ভারতের স্কোর ৫৩/৩। চতুর্থ দিন সকালেই তা পরিণত হল ৬২ রানে ৪ উইকেটে। সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হল দলীয় ৭১ রানের মাথায়। ব্যক্তিগত ৫৪ রানে রণদীভের ৫ম শিকার হয়ে প্যাভিলিয়নের পথে হাঁটা ধরলেন শচীন টেন্ডুলকার। অথচ জয় থেকে তখনও ১৮৬ রান দূরে সফরকারী ভারত।

কথায় বলে, “Cometh the hour, cometh the man.” দল যখন ভয়ানক বিপদে কিংবা চাপের মুখে, ঠিক তখনই লক্ষ্মণের ভেতর থেকে তাঁর সেরাটা বেরিয়ে আসত। তার ব্যতিক্রম হল না এবারও। ব্যাট হাতে আরও একবার নিজের সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিলেন লক্ষ্মণ। সুরেশ রায়নাকে নিয়ে অবিচ্ছিন্ন ৬ষ্ঠ উইকেটে গড়লেন ১৮৭ রানের 'ম্যাচ উইনিং' পার্টনারশিপ; ১২টি চারের সাহায্যে খেললেন ১৪৯ বলে অপরাজিত ১০৩ রানের 'ফ্লুয়েন্ট' ইনিংস। রণদীভের এক্সট্রা টার্ন এন্ড বাউন্স, মেন্ডিসের 'ক্যারম বল' ধাঁধা কিংবা মালিঙ্গার টো ক্রাশার — লক্ষ্মণের অবিচলতার কাছে হার মেনেছিল সবই।

উল্লেখ্য, পিঠে ব্যথা থাকায় সেদিন রানার নিয়ে খেলতে হয়েছিল লক্ষ্মণকে।

❐ ৭৩*, বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া, মোহালি, ২০১০

ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার সবচাইতে উত্তেজনাপূর্ণ দ্বৈরথগুলোর একটি ছিল ২০১০ সালের মোহালি টেস্ট। শেষ দিনে জয়ের জন্য ভারতের প্রয়োজন ছিল ২১৬ রান। 'নাইটওয়াচম্যান' জহির খানের বিদায়ের পর লক্ষ্মণ যখন ব্যাটিংয়ে নামলেন, ভারতের স্কোর ৭৬/৫। ঘন্টখানেক পরই তা পরিণত হল ১২৪ রানে ৮ উইকেটে! জয়ের জন্য তখনও প্রয়োজন আরো ৯২ রান। এদিকে অজি 'পেস-ত্রয়ী' মিচেল জনসন, ডগ বলিঞ্জার আর বেন হিলফেনহস ছিলেন নিজেদের সেরা ফর্মে। নিখুঁত লাইন লেন্থ আর গতির সাথে তাঁরা মেশাতে আরম্ভ করেন বিষাক্ত রিভার্স সুইং।

পিঠের ব্যথা সইতে না পেরে একপর্যায়ে 'রানার' নিলেন লক্ষ্মণ। 'জেনুইন টেলএন্ডার' ইশান্ত শর্মাকে নিয়ে ৯ম উইকেটে গড়লেন ৮১ রানের 'ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া' তুলনাহীন এক পার্টনারশিপ। ৫ বাউন্ডারিতে ৯২ বলে ৩১ রানের 'মহামূল্যবান' এক ইনিংস খেলে ইশান্ত যখন হিলফেনহসের ৪র্থ শিকারে পরিণত হলেন, ভারত জয় থেকে তখনও ১১ রান দূরে। প্রজ্ঞান ওঝাকে (৫*) নিয়ে বাকি কাজটুকু নিরাপদেই সারলেন লক্ষ্মণ, দলকে ১ উইকেটে ম্যাচ জিতিয়ে তবেই মাঠ ছাড়লেন। ইনজুরি নিয়ে খেলেও উপহার দিলেন ৭৯ বলে অপরাজিত ৭৩ রানের 'ক্লিনিক্যাল' এক ইনিংস।

❐ ৯১, বিপক্ষ নিউজিল্যান্ড, আহমেদাবাদ, ২০১০

দুদলের প্রথম ইনিংস শেষ হতেই লেগেছিল সাড়ে তিন দিন। বাকি দেড় দিনে রেজাল্ট আসার সম্ভাবনা প্রায় ছিল না বললেই চলে। অথচ এই মরা টেস্টেই প্রাণের সঞ্চার করেছিলেন কিউই ফাস্ট বোলার ক্রিস মার্টিন।

মার্টিনের বিধ্বংসী বোলিংয়ে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৫ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত! যার ৪টাই নিয়েছিলেন মার্টিন। গম্ভীর, শেবাগ, দ্রাবিড়, টেন্ডুলকার, রায়না — টপ অর্ডারের ছয় ব্যাটসম্যানের ৫ জনই ফিরে গেছেন প্যাভিলিয়নে। এদিকে ভারতের লিড তখন মাত্র ৩৭ রান!

আরে চিন্তা কিসের? ভারতের 'ক্রাইসিস ম্যান' লক্ষ্মণ আছে না!

প্রথমে ধোনিকে (২২) নিয়ে ৫০ রানের জুটি গড়ে প্রাথমিক বিপর্যয় কিছুটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করলেন লক্ষ্মণ। এরপর ৭ম উইকেটে হরভজন সিংকে নিয়ে গড়লেন ১৬৩ রানের 'ম্যাচ সেভিং' পার্টনারশিপ। চাপকে জয় করে খেললেন ২৫৩ বলে ৯১ রানের আরও একটি 'লক্ষ্মণীয়' ইনিংস! পঞ্চম দিন বিকেলে দলীয় সংগ্রহ ২২৮ রানের মাথায় যখন আউট হলেন, ভারত তখন সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত।

সেদিন লক্ষ্মনের যোগ্য সাহচর্য পেয়ে ব্যাট হাতে জ্বলে উঠেছিলেন হরভজনও। হাঁকিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি (১১৫)।

❐ ৯৬, বিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকা, ডারবান, ২০১০

সেঞ্চুরিয়নে আগের টেস্টেই এক ইনিংস ও ২৫ রানের লজ্জাজনক হারের স্মৃতিটা তখনও টাটকা। এদিকে ডারবানের কিংসমিডে পরের টেস্টেও ভারতের জন্য অপেক্ষা করছিল ঘাসে ভরা সবুজ উইকেট। স্টেইন, মরকেল, সতসোবে ও ক্যালিসের সমন্বয়ে গড়া দক্ষিণ আফ্রিকার পেস চতুষ্টয়ের সামনে অবশ্য এ ম্যাচেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেন নি ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। তবে স্রোতের বিপরীতে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন একজন; ভিভিএস লক্ষ্মণ।

দুই ইনিংসেই দলের পক্ষে টপ স্কোরার ছিলেন লক্ষ্মণ (৩৮ ও ৯৬)। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ৩৩ রান!

দ্বিতীয় ইনিংসে ১৪১ রানে ৭ উইকেট পড়ার পর ৮ম উইকেট জুটিতে জহির খানকে (২৭) নিয়ে লক্ষ্মণ যোগ করেছিলেন 'হীরার চেয়েও দামী' ৭৬টি রান। লো স্কোরিং ম্যাচে ৭৬ রানের এই ক্রুশাল পার্টনারশিপটাই শেষ পর্যন্ত ফলাফল নির্ধারক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১২টি দৃষ্টিনন্দন বাউন্ডারিতে সাজানো ১৭১ বলে ৯৬ রানের 'ম্যাচ উইনিং' ইনিংস খেলে যথারীতি ম্যাচসেরাও হয়েছিলেন ভিভিএস লক্ষ্মণ।

চলুন এবারে এক নজরে দেখে নেয়া যাক ভিভিএস লক্ষ্মণের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার পরিসংখ্যান।

১৩৪ টেস্টে ৪৫.৯৭ গড়ে লক্ষ্মণের সংগ্রহ ৮৭৮১ রান। সেঞ্চুরি ১৭টি, হাফ সেঞ্চুরি ৫৬টি। 'টেস্ট ব্যাটসম্যানের' তকমা লেগে যাওয়া লক্ষ্মণ খুব একটা খারাপ খেলতেন না সীমিত ওভারের ক্রিকেটটাও। ৬ সেঞ্চুরি আর ১০ হাফ সেঞ্চুরিতে ৮৬ ওয়ানডেতে তিনি করেছেন ২৩৩৮ রান।

২০০২ সালে একবার জিতেছেন উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটারের খেতাব। ২০০৩ বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও জায়গা পেতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর বদলে নেয়া হল কিনা দীনেশ মঙ্গিয়াকে! কখনো ওয়ার্ল্ড কাপ না খেলতে পারা দুর্ভাগা ক্রিকেটারদের মধ্যে তাই এক নম্বরে থাকবেন ভিভিএস লক্ষ্মণ।

মজার ব্যাপার হল, লক্ষ্মণের ২৩টি আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির ১০টিই এসেছে 'প্রিয় প্রতিপক্ষ' অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে! দুটো ডাবল সেঞ্চুরির দুটোই হাঁকিয়েছেন অজিদের বিপক্ষে। ওয়ানডেতে লক্ষণের ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৩০.৭৬, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেটা ৪৬.১৮!

শেষ করব, লক্ষ্মণকে নিয়ে ফাস্ট বোলার ব্রেট লি'র করা একটি মজার উক্তি দিয়ে।

“If you get Dravid, great.
If you get Sachin, brilliant.
But if you get Laxman, its miracle.”