বাংলাদেশ ক্রিকেট

বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড়-ছোট সমাচার

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 11:45 রবিবার, 23 সেপ্টেম্বর, 2018

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

বাংলাদেশ দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সাথে অপেক্ষাকৃত তরুন ক্রিকেটারদের পারফর্মেন্সের মিশেল খুঁজতে হলে ২০১৫ সালে ফিরতে হবে। বিশ্বকাপে ভয়ডরহীন বাঁহাতি ওপেনার সৌম্য সরকার ও বোলিং আক্রমণে ফাস্ট বোলার তাসকিন আহমেদ ছিলেন দলের অন্যতম পারফর্মার। বিশ্বকাপের পরেই মুস্তাফিজুর রহমানের অভিষেক বাংলাদেশ দলের তারুণ্যের জয়জরকার বইয়ে দেয়।

টপ অর্ডারে সৌম্য সরকারের অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকতার সাথে মাশরাফি, রুবেল ও সাকিবদের অভিজ্ঞতার সাথে যোগ হয় তাসকিন ও মুস্তাফিজের নতুনত্ব। ব্যাটিং এর ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার নিজের দিনে তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমদের ছাপিয়ে দিয়েছেন সৌম্য সরকার।

দলের ফ্রন্ট লাইন পেসারদের কাজ সহজ করে একা হাতে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। ফলাফলও বাংলাদেশ দল হাতেনাতে পেয়েছে। একের পর এক বড় দলকে নিয়ে রীতিমত ছেলেখেলায় মেতেছিল মাশরাফির বাংলাদেশ।

কিন্তু ২০১৫ সালের ধারবাহিকতায় স্রোত থমকে যায় খুব দ্রুতই। সৌম্যর পড়ন্ত ফর্ম, মুস্তাফিজের ইনজুরির পর তাসকিনের বোলিং অ্যাকশনের ত্রুটি ধরা পড়া, সব মিলিয়ে কেমন জানি ছন্নছাড়া হয়ে যায় বাংলাদেশ দল। তরুনরা ফিকে হয়ে যাওয়ায় খুব দ্রুতই অভিজ্ঞদের দায়িত্বটা আরও বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ দলের ধারাবাহিকতার গ্রাফও ঊর্ধ্বমুখী পথ হারিয়ে বসে। এই সময়টায় বেশ কয়েকজন ফর্মের কারণে ছিটকে পড়েছেন, সুযোগ পেয়েছেন বিজয়, লিটন দাসরা। কিন্তু ২০১৬, ২০১৭ পার করে ২০১৮ সালে এসেও তরুনদের প্রত্যাশিত পারফর্মেন্স পাচ্ছে না বাংলাদেশ।

সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য ২০১৮ সালে এসে ২০১৫ সালের সেই সোনালি অতীত মনে করিয়ে দিলেন। ইঙ্গিত দিলেন, তরুনদের একটু খানি অবদান বাংলাদেশ দলের পারফর্মেন্স কয়গুণ বৃদ্ধি করতে পারে।  

'যখন ওরা আরেকটু ভাল করে আমাদের দল কিন্তু আরও বেশি ভাল করে। ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে আমরা যখন সিরিজগুলো জিতেছি, তখন আমাদের তরুণ ক্রিকেটারদের পারফর্মেন্স অনেক ভাল ছিল। একারণে আমাদের পারফর্মেন্সের লেভেল আরও অনেক বেশি ছিল। ওইটা যদি ধারাবাহিকভাবে আমরা ধরে রাখতাম, তাহলে আরও বেশি ভাল হত।'

সাকিব বাংলাদেশের ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেটার হবেন, যিনি কিনা পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ধারাবাহিক পারফর্ম করে এসেছেন। ২০০৬ সালের দিকে অভিষিক্ত সাকিবের সাথে বাংলাদেশ দলের বাকি সিনিয়র ক্রিকেটারদের মধ্যে ধারবাহিকতা ইস্যুতে বিস্তর তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায়।

মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও তামিম ইকবালের ক্যারিয়ারের প্রথম চার বছরের পরিসংখ্যান থেকে ব্যাটসম্যান সাকিবের পরিসংখ্যান যথেষ্ট সমৃদ্ধ। 

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদঃ ৫১ ইনিংসে ৫ ফিফটি, গড় ২৮.৯১, স্ট্রাইক রেট ৬৭.৪২। (২০০৭, ০৮, ০৯, ২০১০)

মুশফিকুর রহিমঃ ৫১ ইনিংসে ৪ ফিফটি, গড় ২২.৪৮, স্ট্রাইক রেট ৬১.৭৯। (২০০৬, ০৭, ০৮, ২০০৯)

তামিম ইকবালঃ ৮৯ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি, ১৬ ফিফটি, গড় ২৯.২৩, স্ট্রাইক রেট ৭৯.২৩। (২০০৭, ০৮, ০৯, ২০১০)

সাকিব আল হাসানঃ ৭১ ইনিংসে ৪ সেঞ্চুরি, ১২ ফিফটি, গড় ৩৫.৯১, স্ট্রাইক রেট ৭৬.৫৮। (২০০৬, ০৭, ০৮, ২০০৯)

তরুন ক্রিকেটারদের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের ক্যারিয়ারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন খোদ সাকিব আল হাসানই। 'আমরা ওদের উপর এতোটা চাপ দিয়ে ফেলছি, যার কারণে অল্প সময়ে ওদের জন্য ভাল করার সম্ভাবনাটা আরও করে যায়। আপনারা যাদের কথা বলছেন, আমাদের চার-পাঁচজন আসলে আমরা কেউই কিন্তু আগে বীর পালোয়ান ছিলাম না। 

'আপনারা হয়তো শেষ তিন-চার বছরের ক্যারিয়ার দেখছেন। কিন্তু এর আগে ছয়-সাত বছর আমরা চার-পাঁচজন কতটুকুই বা ভাল খেলেছি! একটা মূহুর্তের মধ্যে পড়তে পড়তে মানুষ যখন শিখবে তখনই ভাল করা সম্ভব আমরা হয়তো তাদের সেই সুযোগটা দিতে পারছি না ওইভাবে। ওই সময়টাও তৈরি করতে পারছি না। এই রকম পরিস্থিতিতে ওদেরও কঠিন ভালো পারফর্মেন্স করা।'

ওয়ানডে ফরম্যাটে বাংলাদেশ দলের হয়ে কমপক্ষে ১৫ ইনিংস খেলা অপেক্ষাকৃত তরুন ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ার ঘেটে দেখলে সাকিবের কথাই সত্যি প্রমানিত হয়।

নাসির হোসেনঃ ৫২ ইনিংসে ১ সেঞ্চুরি, ৬ ফিফটি, গড় ২৯.১১, স্ট্রাইক রেট ৭৯.৮১।

এনামুল হক বিজয়ঃ ৩৪ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি ও ৩ ফিফটি, গড় ৩০.৫২, স্ট্রাইক রেট ৭০.৯০।

মমিনুল হকঃ ২৫ ইনিংসে ৩ ফিফটি, গড় ২৩.০০, স্ট্রাইক রেট ৭৪.০৯।

মোসাদ্দেক হোসেনঃ ২০ ইনিংসে ১ ফিফটি, গড় ৩১, স্ট্রাইক রেট ৭৮.২১।

সাব্বির রহমানঃ ৪৮ ইনিংসে ৫ ফিফটি, গড় ২৪.৫১, স্ট্রাইক রেট ৯৩.৫২।

সৌম্য সরকারঃ ৩১ ইনিংসে ১ সেঞ্চুরি ও ৬ ফিফটি, গড় ৩৪.৫৩, স্ট্রাইক রেট ৯৬.৬০।

লিটন দাসঃ ১৫ ইনিংসে কোন ফিফটি নেই, গড় ১২.৭১, স্ট্রাইক রেট ৭১.৪৮।

কিন্তু একই সাথে পাইপলাইনে থাকা এত ক্রিকেটারের ফর্মে না থাকা অবাক করছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের শুভাকাঙ্ক্ষীদের। নাজমুল আবেদিন ফাহিম, বাংলাদেশ দলের সিনিয়র ক্রিকেটাদের মেন্টর পাইপলাইনের বিবর্ণ অবস্থার জন্য ক্রিকেট কর্তাব্যক্তিদের ভুল পন্থাকে দায়ী করছেন। তরুনরা হয়ে উঠুক দলের পার্শ্বনায়ক, এই ফর্মুলায় এগোচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ ২০১৫ সালে সৌম্য-মুস্তাফিজরা অভিজ্ঞদের ছাপিয়ে নায়ক বনে গিয়েছিল, তাতেই এসেছিল অভাবনীয় সাফল্য।

'ভীতিকর বিষয় হচ্ছে তাদের এখন যে অবস্থানে থাকার করা, তারা সেই অবস্থানে নেই। আর আমি বারবারই বলি, আমরা যেভাবে তাদের দেখেছি শুরু থেকে, সেই বিষয়টা ভুল ছিল। আমরা ওদেরকে নেতা হওয়ার সুযোগ দিচ্ছি না, আবার আমরা ওদেরকে পরিণত হিসেবেও দেখছি না। আমরা চাই ওরা সাকিব বা তামিমদের ছায়ায় বেড়ে উঠবে, যা আদতে ভুল। যেটা হওয়া উচিত ছিল, মোসাদ্দকের উচিত ছিল সাকিবের চাইতে এখন ভাল ব্যাটিং করা। সাব্বিরের উচিত ছিল তামিমের চেয়ে ভাল ব্যাটিং করা। যেন দশ বছর পরে এরা যদি আরও ভাল খেলে তাহলে আমরা আরেকটা উচ্চতায় যেতে পারি। কিন্তু এমনটা হয়নি।'

মেধায় এগিয়ে থাকার পরও নেতা হয়ে না ওঠায় বড় চিন্তার উদয় হচ্ছে না তরুনদের, যার প্রভাব পড়ছে পারফর্মেন্সে।

'ওরা অনেক মেধাবী, এখনকার ক্রিকেটারদের চাইতেও অনেকে মেধাবী। কিন্তু ওদের গড়ে তোলায় ভুল আছে। আর এদের মধ্যেও আমি কোনো ব্যক্তিগত উদ্যম দেখি না। কেননা সাকিব, তামিম, রিয়াদদের আমরা দেখেছি তারা কি পরিশ্রমী ছিল। জাতীয় দলকে ভাল উচ্চতায় নিতে এরা অনেক পরিশ্রম করেছে, নিজের জন্য না কিন্তু। তো এখনকার যারা তরুণ তাদের মধ্যে ওই স্পৃহাটুকু নেই। এই দায়বদ্ধতা তাদের একার না, আমাদেরও। আমরা তাদের মধ্যে নেতাসুলভ কিছু দেখতে চাইনি, বা তাদের গড়ে তুলিনি।'

'একটা দল যখন মাঠে বিশৃঙ্খল অবস্থায় পড়ে, তখন তাদের পথ দেখাতে পারে একজন নেতাই; অনুসারীরা না কিন্তু। মাঠে এক থেকে এগারো সবাইকেই নেতা হতে হবে। এতে দলের ম্যানেজমেন্টের ভূমিকা থাকতে হবে। সবসময় এগুলো বলার জন্য সাকিব, তামিম, মাশরাফিরা থাকবে না। আজকে যে নতুন, তাকেও নিজেকে নেতা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নয়তো খারাপ অবস্থায় সে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, ভাগ্যের উপরে নির্ভর করবে।'