এশিয়া কাপের প্রস্তুতি

শেষ বেলায় নতুন রূপে মাশরাফি?

জুবাইর

জুবাইর
প্রকাশের তারিখ: 19:38 সোমবার, 03 সেপ্টেম্বর, 2018

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

ওয়েস্ট ইন্ডিজে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ২৫ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলেন। তামিম ইকবালের সেঞ্চুরিতে পাওয়া ভিত থেকে ৩০০ ছাড়ানো স্কোর গড়তে হলে দ্রুত কিছু রান দরকার ছিল।

সেই সময়ে ইনিংসের ৩৯তম ওভারে ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে নামেন মাশরাফি। ডাগ আউটে দুই স্বীকৃত ব্যাটসম্যান সাব্বির রহমান ও মোসাদ্দেক হোসেন থাকার পরও সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচের গুরুত্বের জায়গা থেকে দ্রুত রান তোলার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন কাপ্তান মাশরাফি। 

সেখান থেকে ৪টি চার ও ১টি ছয়ের সাহায্যে দ্রুত ৩৬ রানের ইনিংসের সাথে আরেক প্রান্তে থাকা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সাথে অর্ধশত ছাড়ান জুটি গড়েন তিনি। ইনিংসের চার ওভার বাকি থাকতে উইন্ডিজ পেসার হোল্ডারের বলে মাশরাফি আউট হলেও তার ইনিংসটি বাংলাদেশের স্কোর তিনশ ছাড়াতে সাহায্য করে।

শেষ পর্যন্ত সিরিজের শেষ ম্যাচে ১৮ রানের জয় তুলে নিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জয় করে নেয় মাশরাফির বাংলাদেশ। বলা চলে, শেষের দিকে ১৪৪ স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা মাশরাফির ক্যামিও ইনিংসটিই পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল।

২০১৬ সালের টি-টুয়েন্টির এশিয়া কাপের পাকিস্তানের বিপক্ষে বাঁচা মরার ম্যাচেও ব্যাটিং অর্ডারে এক ধাপ এগিয়ে ম্যাচের গতিপ্রকৃতি বদলে দিয়েছিলেন তিনি। একই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৪ রানে জেতা ম্যাচে তাঁর ব্যাট থেকে আসে ২৯ বলে ৪৪ রান, যা বাংলাদেশকে সিরিজে সমতা আনতে সাহায্য করে।

কিন্তু ব্যাটসম্যান মাশরাফির কাছ থেকে এমন ইনিংস ধারাবাহিকভাবে পেয়ে আসে নি বাংলাদেশ ক্রিকেট। অথচ উইলো হাতে দেশকে ঢের সাফল্য এনে দিতে পারতেন তিনি। নাজমুল আবেদিন ফাহিম, জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের প্রিয় কোচ বলেছেন, 

'মাশরাফির কাছ থেকে আমরা ব্যাটিং এ যা পেয়েছি, তারচেয়ে অনেক ভালো ব্যাটসম্যান হওয়ার সুযোগ ছিল তাঁর। আমরা তাঁকে সেই জায়গাটা দেই নি এবং পরে হয়তো সেও বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছে। সে নিজেকে প্রথমে একজন বোলার হিসেবে বিবেচনা করে, দ্বিতীয়তেও নিজেকে বোলার হিসেবে ভেবেছে। তারপর ব্যাটিং নিয়ে কিঞ্চিৎ ভেবেছে। তাঁর ব্যাটিং সামর্থ্য অনেক বেশি ছিল।'

লোয়ার অর্ডারে বোলারদের বিপক্ষে বাহু ফলানোর সামর্থ্য থাকার পরও ধারাবাহিকভাবে সাত নম্বরে খেলতে দেখা যায় না মাশরাফিকে। অথচ বাংলাদেশ দলের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ম্যাচের চাহিদা অনুযায়ী সেই পজিশনের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যাটসম্যান এক মাশরাফিই।

'এই পজিশনে যারা খেলে তাঁরা রানের দ্রুত মরিয়া থাকবে। তাঁরা আগ্রাসী ধাঁচের ব্যাটসম্যান হবে... যে কিনা ব্যাটিং এর গড় বা ব্যাটিং এর দৃষ্টিনন্দন দিক নিয়ে ভাববে না। এই মানসিকতাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। হ্যাঁ, এই পাগলামিটাই দরকার। 

'একজন প্রপার ব্যাটসম্যান হলে সেই ইনিংসটা খেলতে পারত না। সে আরেকটু ভেবেচিন্তে খেলত, তাঁর স্ট্রাইক রেটটা হয়তো তখন কমে আসত। ম্যাচ শেষে যেই পার্থক্যটা তৈরি হয়েছে, সেটা হয়তো হতো না (উইন্ডিজদের বিপক্ষে ম্যাচ)।,' বলেছেন নাজমুল আবেদিন।

ক্যারিয়ারের শুরুর পাঁচ বছরে মাশরাফির স্ট্রাইক রেট ছিল ১০২, যা তখনকার বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রেক্ষাপটে এক কথায় অবিশ্বাস্য। এর মধ্যে কয়েকটি ইনিংস বাংলাদেশের ম্যাচ জয়ে সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল।

২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ের ঐতিহাসিক জয়ে ব্যাটে বলে অবদান রেখেছিলেন মাশরাফি। ঢাকার মাঠে সেই লো স্করিং ম্যাচে ৩৯ বলে ৩টি চার ও ১টি ছয়ে ৩১ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন তিনি।

তরুন মাশরাফির ইনিংসটি বাংলাদেশকে ২২৯ রানের লড়াই করার মত পুঁজি এনে দেয়। বাংলাদেশ সেই ম্যাচে ১৫ রানের জয় পায়। সেই সিরিজের পরের ম্যাচেও রানের দেখা পান তিনি। ২০ বলে ৩৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করতে নেমে। 

২০০৬ সালে কেনিয়ার বিপক্ষে মাশরাফির খেলা মাত্র ১৬ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি বাংলাদেশকে ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথমবারের মত ৩০০ রান স্পর্শ করতে সাহায্য করে। একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নাইরোবিতে ৫৩ বলে ৪৩ রানের ইনিংসটি টানটান উত্তেজনার ম্যাচে বাংলাদেশকে দুই উইকেটের জয় এনে দেয়। 

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে লোয়ার অর্ডারে নিয়মিত রান দিলেও পরবর্তীতে সেটা হয়ে ওঠে নি। একের পর এক ইনজুরিতে একজন সম্ভাবনাময় বোলিং অলরাউন্ডারকে হারিয়ে বসে বাংলাদেশ। ইনজুরি থেকে বার বার ফেরার লড়াই করা মাশরাফি তার মূল শক্তি বোলিংকেই গুরুত্ব দিয়েছেন।

ইনজুরি থাকে আলাদা করে ব্যাটিং এ সময় দেয়ার সুযোগ দেয় নি। ব্যাটসম্যান মাশরাফির সামর্থ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা দিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। তিনি তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, চাইলেই একজন অলরাউন্ডার হতে পারতেন মাশরাফি।

তবে ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় এসে হয়তো অলরাউন্ডার মাশরাফিকে আরও একবার ধারবাহিকভাবে ব্যাটিং ঝলক দেখাতে দেখা যাবে। ২০১৯ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে দলের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাটিং অর্ডারে এক ধাপ এগিয়ে আসতে পারেন তিনি। তবে সেজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার।

'এখন ওই নম্বরে ব্যাট করতে যেই ধারাবাহিকতাটা দরকার, সেটা তাঁর থাকবে কিনা এটা একটা বড় প্রশ্ন। কারণ সাত নম্বরে সবসময়ে ক্রিজে গিয়ে মারার মত অবস্থা হয়তো থাকবে না। মাঝে মাঝে সাত নম্বর ব্যাটসম্যানকেও ধরে খেলতে হয়। তবে ম্যাচের চাহিদা অনুযায়ী সে এক ধাপ ওপরে এসে খেলতে পারে। 

'সেই জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার, এখন থেকেই পরিকল্পনা থাকতে হবে। সেই জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে, নেটে অথবা ম্যাচে... সেই অবস্থার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। হুট করে এক ধাপ এগিয়ে ব্যাট করতে গেলে সেটা সবসময় কাজে আসবে না।'