তাইবুর কলাম

ক্রিকেট ও অহংবোধ

তাতেন্দা তাইবু

তাতেন্দা তাইবু
প্রকাশের তারিখ: 23:50 বুধবার, 08 আগস্ট, 2018

মেরিয়াম ওয়েবস্টারের মতে অহংবোধ হলো নিজের সম্পর্কে একটি অভিমত মাত্র। 

ক্রিকেটে এই বিষয়টি কতোটা প্রভাব ফেলে, ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবে? কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোচরা, বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ে অনেকেই এখন ক্রিকেটে অহংবোধের গুরুত্ব বুঝে উঠতে শুরু করেছে। এই জন্যই কোচরা ক্ষুদে ক্রিকেটারদের অনেক বেশি ইতিবাচক মানসিকতা লালন করতে উৎসাহিত করে আসছে।

যদিও এর কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। এভাব চলতে থাকলে ক্ষুদে ক্রিকেটাররা শুধু নিজের সম্পর্কেই ভাবতে শুরু করে। 

আপনি কি কখনো এখন কোন ক্রিকেটার দেখেছেন যে কিনা বলছে, 'আমি বুঝি না নির্বাচকরা ওর মধ্যে কি দেখেছে? অথবা 'সে কখনই আমাকে আউট করতে পারবে না যখন আমি ক্রিজে থাকবো, অথবা সে আমার বলে কখনই ছয় মারতে পারবে না।'

ড্রেসিং রুমে সাধারনত এইসব নিয়ে আলাপ হয়, শুধু মাত্র অহংবোধের জায়গা থেকে। অনেকে মনে করবেন এমন ঘটনা শুধু ক্লাব লেভেলের ক্রিকেট কিংবা বন্ধুদের মধ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু না, এমন ঘটনা সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটের হয়। 

আমি ১৪ বছর বয়সী ছিলাম, যখন আমার এক বন্ধু অন্য ক্রিকেটারকে খাটো করে দেখাকে বন্ধ করতে বলেছিল। আমরা কোন এক শিতের বিকেলে টেনিস বল ক্রিকেট খেলছিলাম। ব্যাট ছিল না আমাদের, একটা ষ্ট্যাম্প দিয়েই ব্যাটের কাজ চালিয়ে নিচ্ছিলাম আমরা। 

ব্যাটসম্যান দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাটিং করত, আর দেয়ালে আঁকা বিশাল আকৃতির স্ট্যাম্প বোলারদের বাড়তি সুবিধা দিত। আমি আউট না হয়ে বাকিদের তুলনায় অনেকক্ষণ ব্যাট করেছিলাম। এক পর্যায়ে আমাকে আউট করতে না পারা বোলারদের কাহিল অবস্থা দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিতে থাকি।

বিদ্রূপ করে ডানহাতি ব্যাটসম্যান হওয়া সত্ত্বেও বাঁহাতে ব্যাট করা শুরু করি। বোলার শেষ পর্যন্ত আমাকে আউট করে এবং আমার বোলিং করার পালা আসে। এতক্ষণ ব্যাট হাতে ভালো সময় কাটানোর পর আমার করা প্রথম বলটি সেই সহজেই সামলে নিল।

প্রথম বলের পর আমি দ্বিতীয় বল করার আগে ব্যাটসম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলাম, 'চিন্তা কর না। আমার তোমাকে আউট করতে তিন বলও লাগবে না। পরের বলেই তুমি আউট!' 

আমি কথা গুলো মন থেকে বলি নি কারন আমি জানি সেও যথেষ্ট ভালো ব্যাটসম্যান। আমি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার রাগী বন্ধুর আবির্ভাব, যে এতক্ষণ ধরে এইসব ভেতর ভেতর সহ্য করছিল।

এরপর পেছন থেকে আসা স্ট্যাম্পের আঘাত আমার হাসি বন্ধ করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি উঠে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলাম, না হয় দ্বিতীয় দফা মার পড়তে পারে এই ভয়ে। আমার বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া ওই আঘাত যে কোন কড়া শব্দের বার্তার চেয়েও স্পষ্ট ছিল। 

এমন অনেক ক্রিকেটার আছে যারা এমন পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, বিশেষ করে যখন তাদের সম্পর্কে বলা কথা গুলোতে কিছুটা হলেও সত্য লুকিয়ে থাকে। মাঝেমাঝে হয় নি, কোন ক্রিকেট নিজেকে অন্য সবার তুলনায় অনেক বড় মনে করতে থাকে। সে ভাবতে থাকে তাকে কেউই স্লেজিং করতে পারে না, বরং সম্মান দাবীদার সে। এমন অবস্থার সাথে মানিয়ে নেয়া সহজ নয়। যদিও বড় ক্রিকেটাররা এভাবে চিন্তা করে না, নিজেকে এইসব জড়ায় না। উল্টো তারা নিজেদের ক্লাস প্রদর্শন করে পারফর্ম করে যায়।

অহংকার অন্যভাবেও আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ড্রেসিং রুমের পরিবেশের মধ্যে কি হচ্ছে সেটা ক্রিকেট সমর্থকরা জানে না। তারা একজন প্লেয়ারকে আউট হওয়ার পর হেটে যেতে দেখে। কিন্তু ড্রেসিং রুমে কি হচ্ছে কেউ জানে না। 

প্লেয়ার আউট হয়ে ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করার পরের অবস্থার ভিন্ন রহস্য থাকে। কেউ আউট হয়ে ড্রেসিং রুমে ফেরার পর দলের সদস্যদের দিকে তাকিয়ে সান্তনা প্রত্যাশা করে, সে চিন্তা করতে চায় যে সে দলের বাকি সদস্যদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। প্লেয়ার জানে যে দলের সদস্যরা তার পারফর্মেন্সের দিকে চেয়ে ছিল। এমন সময় প্লেয়ারের উপর দলের আস্থা না থাকা সবচেয়ে বাজে অনুভূতি। দলের বিশ্বাস যদি সেই ক্রিকেটারের উপর না থাকে, তাহলে বড় মানসিক ধাক্কা সহ্য করতে হয়।

অনেকে এমন সময় সকল উপদেশ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে। আবার তুলনামুলক ভাবে মানসিকভাবে শক্ত ক্রিকেটার ব্যর্থতার তিক্ত স্বাদ থেকেই প্রেরণা খুঁজে নেয় এবং পরবর্তী সুযোগে নিজেকে প্রমানের জন্য মুখিয়ে থাকে। 

একটু খুলে বলি। জো রুট দারুন একজন ব্যাটসম্যান। তার নিখাদ টেকনিক ব্যাটিংকে খুবই সহজ করে তোলে। তার ব্যাটিংয়ে একটাই সমস্যা খুঁজে পাবেন আপনি, সেটা হচ্ছে ফিফটিকে সেঞ্চুরি পরিনত করার দুর্বলতা... যা তার মাপের ব্যাটসম্যানের জন্য আরও উন্নত হওয়া উচিত। 

এজবাস্টন টেস্টের প্রথম ইনিংসে রুটের ব্যাট থেকে আসা ৮০ রানের ইনিংসটি যে কোন ক্রিকেটপ্রেমীর মনে গেঁথে যাবে। এর কিছুদিন আগেই শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে তিনি ম্যাচ জেতানো জোড়া সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। 

ভারতের স্পিনারের নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু জো (রুট) সম্পূর্ণ স্বাচ্ছন্দ্যে খেলেছেন। প্রথম সেঞ্চুরির তুলনায় দ্বিতীয় সেঞ্চুরিটি বেশি মনে থাকবে, তার 'ব্যাট ড্রপ' উদযাপনের কারনে।

আমি করে দেখিয়েছি, এরচেয়ে বেশি আমি কি করতে পারি...এমন কিছুই হয়তো বুঝাতে চেয়েছেন তিনি। 

এখন জো'র সেঞ্চুরি উদযাপনের সাথে কি টি-টুয়েন্টি দল থেকে বাদ পড়ার কোন সম্পর্ক রয়েছে? নাকি 'ব্যাট ড্রপ' উদযাপনের মানে কি আগের ম্যাচে ব্যাটিংয় অর্ডারে নিচে নামিয়ে আনার জবাব? রুটের অহংবোধ কি তাকে ওয়ানডেতে ভালো করার ক্ষেত্রে বাড়তি প্রেরণা দিয়েছে?

শুধু জো রুটই এর জবাব দিতে পারবে!