ক্রিকফেঞ্জি স্পেশাল

জ্যাক ক্যালিসঃ পূর্ণতার আরেক নাম

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট

ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট
প্রকাশের তারিখ: 14:58 শুক্রবার, 27 জুলাই, 2018

১৪০ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে তিনিই প্রথম এবং একমাত্র ক্রিকেটার যার টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই আছে ১০ হাজারের বেশি রান ও ২৫০টির বেশি উইকেট! শচীনের 'সেঞ্চুরি'র সেঞ্চুরি, ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড় কিংবা মুরালির ১৩৪৭ আন্তর্জাতিক উইকেটের মতোই তাঁর এই অর্জনকে মনে করা হয় 'অস্পৃশ্য'।

বলছিলাম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৫ হাজারের বেশি রান এবং ৫শ'র বেশি উইকেটের মালিক, 'তর্কযোগ্যভাবে' সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার, প্রোটিয়া কিংবদন্তি জ্যাক হেনরি ক্যালিসের কথা।
ক্যালিসের ব্যাটিং পরিসংখ্যানের দিকে একবার খেয়াল করুন। ১৬৬ টেস্টে ৫৫.৩৭ গড়ে ১৩২৮৯ রান, ৪৫টা সেঞ্চুরি, ৫৮টা হাফ সেঞ্চুরি।

সাথে যোগ করুন ৩২৮ ওয়ানডেতে ৪৪.৩৬ গড়ে ১১৫৭৯ রান, ১৭টা হান্ড্রেড, ৮৬টা ফিফটি!  এবারে অবসরপ্রাপ্ত ক্রিকেটারদের মধ্যে টেস্টে সর্বাধিক রান সংগ্রাহকদের তালিকাটা দেখুন।

শচীন টেন্ডুলকারঃ ১৫,৯২১ রান, গড় ৫৩.৭৮

রিকি পন্টিংঃ ১৩,৩৭৮ রান, গড় ৫১.৮৫

জ্যাক ক্যালিসঃ ১৩,২৮৯ রান, গড় ৫৫.৩৭

রাহুল দ্রাবিড়ঃ ১৩,২৮৮ রান, গড় ৫২.৩১

কুমার সাঙ্গাকারাঃ ১২,৪০০ রান, গড় ৫৭.৪০

ব্রায়ান লারাঃ ১১,৯৫৩ রান, গড় ৫২.৮৮

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এঁদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে থাকা ক্যালিসই একমাত্র 'অলরাউন্ডার'। অর্থাৎ একজন অলরাউন্ডার হয়েও তিনি সর্বকালের সেরা রান সংগ্রাহকদের একজন।  সমসাময়িক গ্রেটদের মাঝে কেবল কুমার সাঙ্গাকারার গড়ই ক্যালিসের চেয়ে বেশী।

আর সেঞ্চুরি সংখ্যায় ক্যালিসের (৪৫) উপরে আছেন কেবল শচীন টেন্ডুলকার (৪৯)। অথচ দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং টেস্টে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ক্যালিসের 'ব্যাটসম্যান' পরিচয়টি ক্রিকেটের বোদ্ধা মহলে বরাবরই 'আন্ডাররেটেড'। 

টেস্টে ৪ নম্বর পজিশনে মিনিমাম ৭৫ ইনিংস খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেরা ব্যাটিং গড় জ্যাক ক্যালিসের। তিনি ৪ নম্বরে ব্যাট করেছেন ১৭০ ইনিংসে, রান করেছেন ৯০৩৩, গড় ৬১.৮৭, সেঞ্চুরি ৩৫টা।
টেস্টে ৪ নম্বর পজিশনে ক্যালিসের চেয়ে বেশি রান আছে কেবল শচীন টেন্ডুলকারের। ২৭৫ ইনিংসে শচীনের সংগ্রহ ১৩৪৯২ রান, গড় ৫৪.৪০, সেঞ্চুরি ৪৪টা।

জ্যাক ক্যালিস ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন বিশুদ্ধ ক্লাসিক্যাল ঘরানার ব্যাটসম্যান। ক্রিকেটের কোচিং ম্যানুয়ালে একেকটা শট যে নিয়মে খেলতে বলা আছে, ক্যালিস ঠিক সেভাবেই খেলেছেন। তাঁর ট্রেডমার্ক শট ছিল ধ্রুপদী কাভার ড্রাইভ এবং ফ্লিক অফ দ্য হিপ। সলিড এবং কমপ্যাক্ট ডিফেন্সিভ টেকনিকের কারণে একবার সেট হয়ে গেলে তাঁকে আউট করাটা ছিল দুঃসাধ্য।

ব্যাটসম্যান হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল ধৈর্য্য, মনঃসংযোগ, টেম্পারমেন্ট, মানসিক দৃঢ়তা, নিষ্ঠা এবং দায়িত্ববোধ। নিজের উইকেটের সঠিক মূল্য দিতে জানতেন তিনি। বলা হয়ে থাকে যে, “No batsman prized his wicket more highly than Kallis.”

ক্যালিসের ব্যাটিং স্টাইল সম্বন্ধে উইজডেন বলছে, “He’s not Brian Lara or Ricky Ponting in terms of aggression or flair but he is rock solid and, added to that, has every shot in the book. Also his cover drive and flick off the hip are right up there in terms of execution and attractiveness.”

দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় ক্রিকেট লেখক টেলফোর্ড ভাইস ক্যালিসের লফটেড ড্রাইভের 'শৈল্পিক' ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, “Certainly, his lofted drive, which begins with a menacing backlift before uncoiling into the irresistible momentum of a mighty downward swoop of the bat and finishing in a twirl of Baroque, might be described as Mozart in motion.”

২০১২ সালে 'দ্য টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় প্রকাশিত এক আর্টিকেলে সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভন লিখেছিলেন, “As a technician, he is right up there with the likes of Dravid and Mahela Jayawardene. He has that calmness under pressure - facing spin or quick bowling - whether his team were in a difficult position or a good position.”

এবার আসি ক্যালিসের 'বোলার' এবং 'ফিল্ডার' পরিচয়ের সার্থকতা প্রসঙ্গে। টেস্টে বল হাতে ক্যালিসের শিকার ৩২.৬৫ গড়ে ২৯২ উইকেট। ম্যাচে কখনও ১০ উইকেট পাননি। ইনিংসে ৫ উইকেট নিয়েছেন ৫ বার। সেরা বোলিং ৫৪ রানে ৬ উইকেট। 

এছাড়া ওয়ানডেতে ৩১.৭৯ গড়ে নিয়েছেন ২৭৩টি উইকেট। ৪ ও ৫ উইকেট নিয়েছেন ২ বার করে। সেরা বোলিং ৩০ রানে ৫ উইকেট।

ডানহাতি মিডিয়াম পেসার ক্যালিস ছিলেন একজন ক্লাসিক 'হিট দ্য ডেক' বোলার। একগাদা অলরাউন্ডারে ঠাসা প্রোটিয়া দলে ক্যালিসের রোলটা ছিল মূলত ফোর্থ সিমারের। 

উল্লেখ্য, টেস্টে 'ফোর্থ সিমার' রোলে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক জ্যাক ক্যালিস। ৯২ ম্যাচে ক্যালিস শিকার ৩০.৭৪ গড়ে ১৩৯ উইকেট যা ফোর্থ সিমারের ভূমিকায় টেস্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

ক্যালিসের ন্যাচারাল ডেলিভারি ছিল আউটসুইঙ্গার। তবে আচমকা বাউন্সার দিয়ে ব্যাটসম্যানদের অস্বস্তিতে ফেলতেন মাঝেমধ্যেই। বলে খুব বেশি গতি না থাকলেও সহায়ক পিচ-কন্ডিশন পেলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারতেন যে কোন সময়। 

উইজডেনের ভাষ্যমতে, “Yet, bowling is by no means a minor arrow in his quiver, but a weapon always potent and sometimes destructive.”

সাবেক ইংলিশ পেসার অ্যাঙ্গাস ফ্রেজারের মতে, “It always amused me when people described him as a medium-pacer because he could bowl as quick as anyone when the mood was right.”

জ্যাক ক্যালিসকে মনে করা হয়, ইতিহাসের সবচাইতে বিশ্বস্ত স্লিপ ক্যাচারদের একজন। টেস্টে ২০০ আর ওয়ানডেতে ১৩১টি ক্যাচের পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে তিনি ঠিক কতটা উঁচুদরের ফিল্ডার ছিলেন। টেস্টে ক্যালিসের চেয়ে বেশি ক্যাচ আছে শুধুমাত্র রাহুল দ্রাবিড় (২১০) এবং মাহেলা জয়াবর্ধনের (২০৫)।

উইজডেনের চোখে, “In the slips, he was safe as a bank; his rattlesnake reflexes make ridiculous catches look regulation.”

ক্যালিসের ফার্স্ট ক্লাস অভিষেক ১৯৯৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে, ওয়েস্টার্ন প্রভিন্সের হয়ে। তার ঠিক দু'বছর পরই টেস্ট ডেব্যু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। অবশ্য মনে রাখার মত কিছু করতে পারেন নি সে ম্যাচে। 

ক্যালিসের টেস্ট ক্যারিয়ারের শুরুটা অবশ্য মোটেও ভালো ছিল না- প্রথম পাঁচ ম্যাচ শেষে ব্যাটিং গড় ছিল মাত্র ৮! অথচ দিন শেষে তাঁর ক্যারিয়ার গড় শচীন, লারা, দ্রাবিড়, পন্টিংদের ওপরে!

১৯৯৬ সালে ওয়ানডে অভিষেকটাও ইংল্যান্ডের সাথে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের মূল স্কোয়াডে ছিলেন। কিন্তু নিজেকে ঠিক সেভাবে মেলে ধরতে পারেন নি। ৪ ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে করেছিলেন মাত্র ৬৩ রান।

টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান ১৯৯৭ সালে মেলবোর্নে। পঞ্চম দিনের ভাঙ্গা উইকেটে ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রার মত বোলারদের সামলে খেলেছিলেন ৩৫৭ বলে ১০১ রানের দুর্দান্ত 'ম্যাচ সেভিং' ইনিংস। সেদিন ক্যালিস নাকি এতটাই অবিচল ছিলেন যে, উপুর্যপরি স্লেজিং করেও তাঁর মনসংযোগ বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত ঘটাতে পারেন নি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার গ্রেগ ব্লিউয়েট। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে ব্লিউয়েট নাকি বলেছিলেন, 'ও কি বধির নাকি!'

১৯৯৮-২০০২ সাল পর্যন্ত সময়টাকে বলা যায় অলরাউন্ডার হিসেবে ক্যালিসের উত্থানকাল। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপের (আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) শিরোপা জিতেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল এবং ফাইনালের ম্যাচসেরার পুরস্কার জিতেছিলেন ক্যালিস। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেমিতে ১০০ বলে ১১৩ আর ফাইনালে উইন্ডিজের বিপক্ষে ৪১ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ৩০ রানে ৫ উইকেট। যথারীতি 'প্লেয়ার অফ দ্য টুর্নামেন্ট' এর ট্রফিটাও উঠেছিল ক্যালিসের (১৬৪ রান ও ৮ উইকেট) হাতে।

১৯৯৯ সালে লারা-চন্দরপল-অ্যাম্ব্রোসদের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে কেপটাউন টেস্টে আরও একবার ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত অলরাউন্ড নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন ক্যালিস। ব্যাট হাতে একটি সেঞ্চুরি (১১০) ও একটি ফিফটি (৮৮) করার পাশাপাশি বল হাতে নেন ৭ উইকেট (২/৩৪ ও ৫/৯০)।

উল্লেখ্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করা সেই সিরিজে ক্যালিসের অবদান ছিল ৬৯.২৮ গড়ে ৪৮৫ রান এবং ১৭.৫৯ গড়ে ১৭ উইকেট।

১৯৯৯ বিশ্বকাপেও অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দিয়ে সবার নজর কাড়েন তিনি। ব্যাটিংয়ে ৫২ গড়ে ৩১২ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নেন ৮ উইকেট। 

২০০০-০১ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে 'তৃতীয়' দক্ষিণ আফ্রিকান হিসেবে (অব্রে ফকনার ও ট্রেভর গডার্ডের পর) এক সিরিজে আড়াইশ'র বেশি রান ও ২০ উইকেটের 'ডাবল' অর্জন করেন জ্যাক ক্যালিস। 

২০০১ সালে প্রথমবারের মত টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই আইসিসি র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর অলরাউন্ডারের জায়গাটা দখল করেন জ্যাক ক্যালিস। প্রায় ৩ বছর একটানা এই শীর্ষস্থানটা ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। 

২০০৩ সালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হেডিংলি টেস্টটা ছিল ক্যালিসের ক্যারিয়ারের একটি স্মরণীয় মুহূর্ত। কেননা ব্যাট হাতে ব্যর্থ হলেও (৪১ ও ৬ রান) তাঁর ক্যারিয়ার সেরা বোলিং পারফরম্যান্সটা (৯ উইকেট) উপহার দিয়েছিলেন ওই ম্যাচেই।

মূল স্ট্রাইক বোলার শন পোলকের অনুপস্থিতিতে বোলিংয়ে বাড়তি ওয়ার্কলোড নিতে হয়েছিল ক্যালিসকে। হেডিংলি টেস্টের শেষ দিনে ইংলিশদের দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৪ রানে ৬ উইকেট তুলে নিয়ে দলকে দারুণ এক জয় এনে দিয়েছিলেন তিনি। এর আগে প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ৩৮ রানে ৩ উইকেট।

২০০৩-২০০৪ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১৮০.৫০ গড়ে ক্যালিসের ব্যাট থেকে আসে ৩৬১ রান। এছাড়া বল হাতে নেন ৬ উইকেট। ক্যারিয়ার সেরা ১৩৯ রানের ইনিংসটাও খেলেন এই সিরিজেই। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ জেতে ৩-১ ব্যবধানে। 

একই মৌসুমে টানা ৫ টেস্টে সেঞ্চুরি (১৫৮, ১৭৭, ১৩০*, ১৩০* এবং ১৫০*) হাঁকিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়েন জ্যাক ক্যালিস। এক সিরিজে সাত শতাধিক রানসহ দুই সিরিজ মিলিয়ে ৭ ম্যাচে করেন ১০৬৬ রান, ১১৮.৪ গড়ে। এছাড়া বল হাতে নেন ১২ উইকেট।

উল্লেখ্য, টেস্ট ইতিহাসে টানা ৬ ম্যাচে সেঞ্চুরি আছে কেবল ব্র্যাডম্যানের। আর ক্যালিস ব্যতীত টানা ৫ ম্যাচে সেঞ্চুরির রেকর্ড আছে শুধুমাত্র ভারতের গৌতম গম্ভীর ও পাকিস্তানের মোহাম্মদ ইউসুফের।

২০০৪-০৫ সিজনে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ৩ সেঞ্চুরি ও ২ ফিফটিসহ ৬৯.৪৪ গড়ে ৬২৫ রান করেন জ্যাক ক্যালিস। তবে বল হাতে ছিলেন একেবারেই ব্যর্থ। ৭৫.৭৫ গড়ে উইকেট নিতে পেরেছিলেন মাত্র ৪টা! দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ হেরেছিল ২-১ ব্যবধানে।

২০০৬-০৭ সিজনে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ জয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন 'অলরাউন্ডার' জ্যাক ক্যালিস। ব্যাট হাতে ৫৪.৪০ গড়ে ২৭২ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। সিরিজসেরার পুরস্কারটাও উঠেছিল ক্যালিসের হাতেই।

২০০৭ সালে টানা ৪ টেস্টে সেঞ্চুরি (১৫৫, ১০০*, ১০৭*, ১৮৬, ১৩১) হাঁকান জ্যাক ক্যালিস। ফলে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান (৩ বার), কেন ব্যারিংটন ও ম্যাথু হেইডেনের পর 'চতুর্থ' ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্ট ক্যারিয়ারে দুইবার টানা ৪ টেস্টে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন জ্যাক ক্যালিস।

২০০৭ বিশ্বকাপে ৮০.৮৩ গড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষে সর্বোচ্চ ৪৮৫ রান করেন জ্যাক ক্যালিস। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে দলীয় ব্যর্থতার দিনে ব্যর্থ ছিলেন ক্যালিসও; ব্যাট হাতে করেছিলেন মাত্র ৫ রান।

শচীনের মত ক্যালিসেরও টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরি পেতে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১৫ বছর অতিবাহিত করার পর ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে কেপটাউন টেস্টে 'বহুল কাঙ্খিত' ডাবল সেঞ্চুরির (২০১*) দেখা পান ক্যালিস। এরপর ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কেপটাউনেই হাঁকান আরও একটি ডাবল সেঞ্চুরি (২২৪)। 

টেস্ট ক্যারিয়ারে মাত্র দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করলেও ১৫০ এর চেয়ে বেশি রানের ইনিংস খেলেছেন ১৪ বার যা ইতিহাসে ষষ্ঠ সর্বোচ্চ। বেশিরভাগ মানুষই হয়ত ক্যালিসকে মনে রাখবে তাঁর রক্ষণাত্মক স্টাইল এবং স্লো স্কোরিং রেটের কারণে।

অথচ টেস্টে দ্রুততম ফিফটির রেকর্ডটাও একসময় নিজের করে নিয়েছিলেন ক্যালিস (২৪ বলে, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০৫ সালে)। শুধু তাই নয়, অবসরে যাবার সময় তিনি ছিলেন টেস্ট ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছক্কার মালিক! টেস্টে ক্যালিসের (৯৭) চেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছেন কেবল অ্যাডাম গিলক্রিস্ট (১০০) এবং ব্রেন্ডন ম্যাককালাম (১০৬)।

ওয়ানডেতেও তাঁর ছক্কার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সাউথ আফ্রিকানদের মধ্যে ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছক্কা ক্যালিসের (১৩৭)। এক নম্বর জায়গাটা এবি ডি ভিলিয়ার্সের (২০৪) দখলে। ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ডারবানে ভারতের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেন জ্যাক ক্যালিস। ক্যারিয়ারের ৪৫তম টেস্ট সেঞ্চুরিটাও (১১৫) পেয়ে যান সে ম্যাচেই।
 
#সম্মাননাঃ

★ আইসিসি টেস্ট প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার : ২০০৫

★ আইসিসি ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার : ২০০৫

★ উইজডেন লিডিং ক্রিকেটার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড : ২০০৭

★ উইজডেন ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার : ২০১৩

অলরাউন্ডার হিসেবে জ্যাক ক্যালিসকে একটা সময় তুলনা করা হতো ইমরান, বোথাম, কপিলদের সঙ্গে। সমসাময়িক এন্ড্রু ফ্লিনটফের সাথেও একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা চলত সবসময়। অথচ ক্যারিয়ার শেষে 'সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার' বিতর্কে ক্যালিসের প্রতিদ্বন্দ্বী শুধুমাত্র স্যার গ্যারি সোবার্স!

উল্লেখ্য, টেস্টে ক্যালিসের ব্যাটিং এবং বোলিং গড়ের পার্থক্য ২০ এর বেশি। ক্রিকেট ইতিহাসে এই কৃতিত্ব আছে শুধুমাত্র স্যার গ্যারি সোবার্স এবং ওয়ালি হ্যামন্ডের। 

রাহুল দ্রাবিড়ের মতে, ক্যালিস হচ্ছেন “আমাদের সময়ের গ্যারি সোবার্স”। 

মাহেলা জয়াবর্ধনে বলেছেন, “এ যুগের সেরা অলরাউন্ডার”। 

কেভিন পিটারসেনের মতে, “সম্ভবত সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার।” 

পল কলিংউডের চোখে, “স্ট্যাটিস্টিক্যালি দ্য গ্রেটেস্ট অলরাউন্ডার এভার।”

অ্যালেক স্টুয়ার্টের মতে, “দ্য মোস্ট কমপ্লিট ক্রিকেটার অফ অলটাইম।”

মাইকেল ভন বলেছেন, “আমার সময় ওর মতো ভালো অলরাউন্ডার আর একজনও ছিল না।”

ক্যালিসের অবসরের পর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মাইকেল ভন আরও বলেন, "Many of the great all-rounders - Sobers, Botham or, more recently, Flintoff - generally bat at five, six or seven. But Kallis has batted at three and four throughout his career in all forms of the game.”

এরপরই ক্যালিস সম্পর্কে একটি আলটিমেট স্টেটমেন্ট দিয়েছেন মাইকেল ভন, ‘আমার দৃষ্টিতে শেন ওয়ার্ন সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার। সর্বকালের সেরা একাদশ বাছাই করতে বললে সবার প্রথমে আমি নেব ওয়ার্নকে। এবং দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে অবশ্যই থাকবেন জ্যাক ক্যালিস।’

১৯৯৭ সালে ইংলিশ কাউন্টিতে মিডলসেক্সের হয়ে খেলার সময় ক্যালিসের সতীর্থ ছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক পেসার অ্যাঙ্গাস ফ্রেজার। ক্যালিসের পেশাদারিত্বের প্রশংসা করে তিনি বলেন, “Jacques was very disciplined and committed. He had total devotion to being the athlete he needed to be.”

একজন ক্রিকেটার হিসেবে ক্যালিসের মূল্যায়ন করতে গিয়ে উইজডেন বলছে, “Jacques Kallis is a marvel of the modern game, a colossus whose influence is felt across every facet of cricket.”

ক্যালিসের মত পরিপূর্ণ ক্রিকেটীয় দক্ষতাসম্পন্ন খেলোয়াড় ইতিহাসে খুব কমই এসেছেন। ক্যালিসের গ্রেটনেস বোঝানোর জন্য কয়েকটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি।

★ টেস্টে ৯০০০ এর ওপর রান করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক জ্যাক ক্যালিস। শুনলে অবাক হবেন, ক্যালিসের (২৯২ উইকেট) নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্টিভ ওয়াহর উইকেটসংখ্যা মাত্র ৯২!

★ টেস্টে ২৫০টির বেশি উইকেট নিয়েছেন এমন বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ রানের মালিকও জ্যাক ক্যালিস। এমনকি ৬০০০ রানের মাইলফলকও অতিক্রম করতে পারেন নি কেউ। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কপিল দেবের রান মাত্র ৫২৪৮!

★ টেস্টে ১২৫টির বেশি ক্যাচ নেয়া ফিল্ডারদের মধ্যে ১০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন কেবল জ্যাক ক্যালিসই। উল্লেখ্য, টেস্টে ৭০৮ উইকেটের মালিক শেন ওয়ার্নের ক্যাচের সংখ্যা ঠিক ১২৫!

শেষ করব একটি অন্যরকম তথ্য দিয়ে। বাবা হেনরির সাথে ক্যালিসের সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মত। তাঁর ক্রিকেটার হবার পেছনে বাবাই ছিলেন সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। ২০০৩ বিশ্বকাপের সময় হঠাৎ করেই বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে।

জীবনের অন্তিম মুহূর্তে বাবার পাশে থাকতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি টেস্ট থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেন তিনি। উল্লেখ্য, হেনরির মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। বাবার মৃত্যুর পর থেকে ক্যালিসের জার্সি নম্বরও হয়ে যায় ৬৫। 

এ প্রসঙ্গে এক ইন্টার্ভিউতে ক্যালিস জানিয়েছিলেন, “সময়টা ছিল আমার জন্য খুব কঠিন। তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, শেষ সময়ে বাবার পাশে থাকতে পেরেছি। বাবার মৃত্যুর পর জীবন ও ক্রিকেট নিয়ে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। ক্রিকেট শুধুই একটা খেলা। এ ভেরি সিম্পল গেম ইফ ইউ কিপ ইউর মাইন্ড স্ট্রেইট!”