বাংলাদেশ ক্রিকেট

যেখানে ব্যাটিং করি সেখানে নিজের বলতে কিছু থাকে না: মোসাদ্দেক

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 13:41 বুধবার, 07 জুন, 2023

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

ঘরোয়া ক্রিকেটে বরাবরই সেরাদের একজন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। নিয়মিত পারফর্ম করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও পা রেখেছেন এই অলরাউন্ডার। বাংলাদেশের হয়ে তিন সংস্করণে খেললেও নিজের প্রতিভার ছাপ রাখতে পারেননি ধারাবাহিকতা দিয়ে। মোসাদ্দেককে অবশ্য মনে রাখার মতো যথেষ্ট কারণ আছে। ২০১৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতে বাংলাদেশ।

৫ ছক্কা ও ২ চারে মাত্র ২৭ বলে অপরাজিত ৫২ রান, মোসাদ্দেকের এমন ইনিংস নিশ্চিতভাবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে। বাংলাদেশের শততম টেস্টেও আছে ৭৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। তবে মোসাদ্দেকের পরিসংখ্যানটা নিয়ে খুশি হবার সুযোগ নেই। বছর সাতেকের ক্যারিয়ারে মোসাদ্দেকের আক্ষেপে জমে পাহাড়সম হয়েছে। নিজের আক্ষেপ, ২০২৩ বিশ্বকাপ, সাত নম্বর পজিশন নিয়ে ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে কথা বলেছেন মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার ৬ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ার কিন্তু খেলেছেন মাত্র চারটি ম্যাচ। এটা নিয়ে নিশ্চয় আফসোস হয়...

মোসাদ্দেক:  অবশ্যই আফসোসের ব্যাপার। কারণ ৬ বছরে মাত্র ৪টা টেস্ট খেলেছি। আমি প্রাপ্যটা হয়তো আরও বেশি হতে পারত। আমি আরও বেশি ম্যাচ খেলতে পারতাম যদি সুযোগ পেতাম। সেই সুযোগটা হয়তো আমি পাইনি, আক্ষেপ তো অবশ্যই আছে... সামনের দিকে সুযোগ আছে তবে সামনে সুযোগ এলে অবশ্যই চেষ্টা থাকবে যেন ভুলগুলো শুধরে ফেলতে পারি। সামনে আরও ভালো কিছু ইনিংস খেলতে পারি। আমি আরও অনেকদিন খেলতে চাই বাংলাদেশ দলের জন্য, সেটা ৩ ফরম্যাটেই। অবশ্যই আফসোসটা আছে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: শততম টেস্টে সাকিবের সঙ্গে আপনার ১৩১ রানের জুটি। আপনি নিজেও ৭৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। রিয়াদের বদলি হিসেবে খেলা চাপ থাকলেও সাকিব থাকায় খানিকটা সহজ হয়েছিল কিনা...

মোসাদ্দেক: একজন ক্রিকেটার তখনই পরিপূর্ণ ক্রিকেটার হয় যখন সে টেস্ট ক্রিকেট খেলে। আমরা যেদিন শততম টেস্ট খেলি আমার জন্য পরিস্থিতিটা সহজ ছিল না, রিয়াদ ভাইর বদলি হিসেবে খেলা... ওইখানে চাপ তো অবশ্যই ছিল। সে সময় সাকিব ভাইর সঙ্গে আমার যে জুটিটা হয়েছিল তা আমার কাজ সহজ করে দিয়েছিল। সে সময় অনেক পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দিতে হয় তা দেখেছি, বুঝেছি। যদিও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে যতই ভালো খেলি না কেন! টেস্ট ম্যাচের বিষয়টা অন্যরকম থাকে, আমি বলব সাকিব ভাইয়ের জন্য আমার কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: সাত নম্বর পজিশনটা নিয়ে অনেকদিন ধরেই কথা হচ্ছে। অন্য অনেকের সঙ্গে আপনার নামটাও আসছে। নিজেকে বিশ্বকাপ দলে দেখছেন?

মোসাদ্দেক: ওই একটা জায়গা নিয়ে অনেকদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। আমিও এই পজিশনেই খেলি, তাই আমি অবশ্যই চাইব ভালো খেলে যেন সেই জায়গাটা নিতে পারি এবং দেশকে অনেক কিছু দিতে পারি। এখন সিদ্ধান্ত পুরোটাই তো টিম ম্যানেজম্যান্টের। তারা কাকে চাচ্ছে, কে ওই জায়গার জন্য মানানসই হবে। এগুলা পুরোটাই ম্যানেজম্যান্টের সিদ্ধান্ত। আমি অবশ্যই আশা রাখি, যদি সুযোগটা আসে আমি যেন তা লুফে নিতে পারি। বাকি সিদ্ধান্ত তো ম্যানেজমেন্টের, তারা যাকে যোগ্য মনে করবে তাকেই সুযোগটা দেবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: সাত নম্বরে ইয়াসির আলী, আফিফদের নাম শোনা গেলেও আপনি একটু আড়ালে ছিলেন। তবে বেশ কিছুদিন আগে সাকিব সবার প্রথম আপনার নামটা নেয়। এটা নিশ্চয় স্বস্তি দিয়েছে...

মোসাদ্দেক: বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিব ভাইয়ের বদলি কোনোদিন পাওয়া যাবে কিনা এটা বলা মুশকিল। তার অবদান কেউ ভুলতেও পারবে না কোনদিন। তার মত ক্রিকেটার থেকে এমন মন্তব্য পাওয়া আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। সে এতো বেশি ক্রিকেট খেলেছে যে সে হয়তো বুঝতে পারছে যে এই জায়গায় কে যোগ্য হবেন। অবশ্যই এটা আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রেরণা দেবে। বিশ্বকাপের আগে যেহেতু ৪-৫মাস সময় এখনও আছে এটা আমাকে সাহায্য করবে নিজেকে আরও তৈরি করতে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি ২০১৯ বিশ্বকাপ খেলেছেন। সেই অভিজ্ঞতাটা আপনাকে খানিকটা এগিয়ে রাখছে বলে মনে হয়?

মোসাদ্দেক: দেখেন ২০১৯ বিশ্বকাপে আমরা যে ম্যাচগুলো খেলেছি আমার সবগুলো ম্যাচেই টুকিটাকি অবদান ছিল। দল যেভাবে চেয়েছে আমি সেটাই করার চেষ্টা করেছি। অবশ্যই আশাবাদী যে গত বিশ্বকাপের অভিজ্ঞতা আমার আছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছি। বড় বড় কিছু টুর্নামেন্ট খেলার অভিজ্ঞতা আমার আছে। অবশ্যই সুযোগ পেলে সেটা কাজে লাগানোর চেষ্টা করব।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি যে পজিশনে খেলেন সেখানে কখনও হয়তো ১০ বলে ২৫ আবার কখনও ২০ বলে ৪০ রান করতে হয়। অনেকে আসলে ইম্প্যাক্টটা না দেখে শুধু বলে আপনি মাত্র ২০ রান করেছেন। এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

মোসাদ্দেক: জাতি হিসেবে আমরা সবাই অনেক আবেগপ্রবণ। সবাই যেভাবে ক্রিকেটটা দেখে, ভালোবাসে। সবার যে উন্মাদনা তাই তাদের আশা সবসময়ই বেশি থাকে। হয়তো সবার চাওয়া পূরণ করা সম্ভব হয় না, অবশ্যই একটা দল যখন মাঠে নামে সবারই একটা আলাদা পরিকল্পনা থাকে। এটা হয়তো তারা জানে না। এটা যারা ক্রিকেটার ও ম্যানেজমেন্ট আছে এরাই এটা জানেন।

এগুলো আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না, এগুলা মেনেই আপনাকে মাঠে নামতে হবে। প্রতিটা ক্রিকেটারের আলাদা আলাদা ভুমিকা থাকে এর বাইরে আপনি যেতে পারবেন না। হাতে যদি ৫ ওভার থাকে আপনি চাইলেই ৬০-৭০ করতে পারবেন না। এটা হয়তো মানুষ বুঝবে না তবে দল কিন্তু বুঝবে যে এই রানগুলো কতখানি কার্যকরী।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনি প্রায়শই বলেন আপনি দলের জন্য খেলেন। দল কি চায় সেটা নিয়ে আপনি ভাবেন। সেটা ভাবার কারণে কি আপনার ক্যারিয়ার বড় হচ্ছে না?
 
মোসাদ্দেক: ঘরোয়া ক্রিকেটে সবসময় আমি উপরে ব্যাটিং করি। আমার যা রেকর্ড আছে সব কিন্তু উপরে ব্যাটিং করে হয়েছে। নিচে ব্যাটিং করে আপনি কখনও রেকর্ডের মালিক হতে পারবেন না। দল যেটা চাইবে সেটাই করতে হবে। দলের প্রয়োজন অনুযায়ী খেলতে হবে। এ কথাটা এ কারণেই আসছে যে ক্রিকেট টিম গেইম। দলের যে পরিকল্পনা থাকে সে অনুযায়ী আপনাকে খেলতে হয়। আমি যেখানে ব্যাটিং করি সেখানে নিজের বলতে আর কিছু থাকে না।

তখন আসে দল কি চাচ্ছে, হয়তো দলের চিন্তা করতে গিয়ে আমার ক্যারিয়ার অনেক বড় হচ্ছে না। অনেক রেকর্ডের মালিক আমি হচ্ছি না। কিন্তু যেখানে খেলছি সেখানে থেকে আমার হয়তো এই কাজগুলোই করতে হবে। এটা আমার জানা আছে। এই ১০, ১৫, ২০ রান দলের জন্য ইমপ্যাক্ট এনে দেয়। এই কাজগুলাই আমার করতে হচ্ছে। আমি নিয়মিতভাবে যদি এগুলা করতে পারি তাহলে আমি বুঝব যে এটাই আমার সার্থকতা। এটাই দল আমার থেকে চায় আরকি।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: জাতীয় দলে আসার আগে আপনি ঘরোয়াতে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছেন। কিন্তু জাতীয় দলে আপনার পরিসংখ্যান অবশ্য আপনার পক্ষে না। ঘরোয়াতে ভালো করার পরও জাতীয় দলে নিজেকে মেলে ধরতে না পারার কারণ কি?

মোসাদ্দেক: ক্যারিয়ারের শুরুর দিক ও মাঝের দিক কখনও এক রকম থাকবে না। একজন খেলোয়াড় থেকে আপনি তখনই সেরাটা পাবেন যখন তাকে আপনি ধারাবাহিকভাবে খেলাতে থাকবেন। এটা খেলোয়াড়কে কোনোদিন আপনি ২-৩ ম্যাচ দিয়ে বিচার করতে পারবেন না। এটা আমাদের দেশে অনেক সহজেই হয়ে যায়। একজন ২-৩ ম্যাচ খারাপ খেলেই দল থেকে বাদ পড়ছে।

এটা যদি সবার ক্ষেত্রে সমান হত যে সে যথেষ্ট সুযোগ পাচ্ছে। আপনি ৩ ম্যাচ খেলে বাদ পড়ে গেলেন আবার এসে কিন্তু এক ম্যাচ খারাপ খেলতেই পারেন। আপনি কিন্তু নিশ্চিত বলতে পারবেন না কে কখন ভালো করবে। কে কখন জ্বলে উঠবে। আমি যথেষ্ট সুযোগ পেলে হয়তো নিজেকে আরও বেশি মেলে ধরতে পারতাম।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আপনার খেলা আন্তর্জাতিক ৬ ম্যাচের মাঝে তিনটিতেই আপনি ব্যাটিং করতে পারেননি। অনেকে হয়ত ব্যাপারটা খেয়াল করে না। সবাই দেখতে চায় ম্যাচ শেষে আপনার স্ট্যাটস কি। এভাবে বাদ পড়াটা নিশ্চয় আক্ষেপের...

মোসাদ্দেক: মানুষ কিন্তু দেখবে না আমি ব্যাটিং পেয়েছি কি পাইনি। মানুষ কিন্তু দল গড়ে দেয় না। এটা করার জন্য ম্যানেজমেন্ট আছে। মানুষ যদি দল গড়ে দিতো তাহলে আমি বুঝতাম যে ওরা দেখে নাই। এটা অবশ্যই দলের পরিকল্পনা। আমি এখন দল থেকে বাইরে আছি, যদি থাকতাম তাহলে দলের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পারতাম। আমার জন্য পরিকল্পনা করা সহজ হত। তাই অবশ্যই বলব সুযোগটা হয়তো আরেকটু বেশি আমার পাওয়া উচিত ছিল। এখানে একটা আক্ষেপ তো আছেই।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: ক্রিকেটাররা একটু খারাপ করলেই তাদের নিয়ে ট্রল হয়। লিটন দাস, নাজমুল হোসেন শান্তদের নিয়ে হয়েছে। এখন ইয়াসির আলী রাব্বিকে নিয়ে হচ্ছে। কখনও কখনও আপনি এটার স্বীকার হয়েছেন। এটা আসলে ক্রিকেটারদের কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে?

মোসাদ্দেক: ট্রলের যে বিষয়টা এগুলা আমরা যত বেশি পারি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের মধ্যে এমন কোন ক্রিকেটার নেই যে ট্রলের শিকার হয়নি। আপনি যখন খেলা দেখছেন আপনি সমালোচনা করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া কিন্তু আপনি বুঝতে পারবেন না এদেশের মানুষ কি পরিমাণ ক্রিকেট পাগল। তাই তারা একই সাথে আলোচনা-সমালোচনা দুটোই করেন। কিন্তু খেলোয়াড় ধরে ধরে ট্রল করা কোনো ভালো কাজের মধ্যে পড়ে না, আমরা খেলোয়াড়রা এটা আশা করি না। আমি আশা করি তারা আমাদের শান্তিতে ক্রিকেটটা খেলতে দেবে এবং এসবের থেকে দূরে থাকবে।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: আমাদের এখানে অনেক সময় এক ফরম্যাটের পারফরম্যান্স দেখে অন্য ফরম্যাটে খেলিয়ে দেয়া হয়। যে কারণে অনেক সময় সেই ক্রিকেটার দুই ফরম্যাটেই খারাপ করতে থাকে। আলোচনা-সমালোচনা হয়, যার ফলে ক্যারিয়ারও শেষ হয়ে যায়। এটাকে কিভাবে দেখেন?

মোসাদ্দেক: একটা খেলোয়াড়কে নিয়ে হয়তো তারা ২-৩টা ফরম্যাট ভাবছে। হয়তো সে একটা ফরম্যাটে ভালো খেলছে আরেকটায় খেলতে পারছে না। এটা হয়তো সে সময়ের সাথে ঠিক করে নেবে। কিন্তু আমরা অনেক দ্রুত ধরে নেই যে এ টি-টোয়েন্টিতে ভালো এ ওয়ানডেতে ভালো না। আবার ওয়ানডেতে ভালো, টেস্টে ভালো না।

দ্রুত এসব ধরে না এটা একটা খেলোয়াড়ের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়। সে অনেক বেশি কনফিডেন্স হারিয়ে ফেলে। তাই একজন খেলোয়াড় জন্য খেলে তার সবার সমর্থন প্রয়োজন হয়। কিন্তু কোন খেলোয়াড় যখন উপরে উঠতে থাকে তখন আমরাই একটা কথা বলে তাকে খারাপ সময়ের মধ্যে ঠেলে দেই। তাই সবার সমর্থন পেলে এটা একজন খেলোয়াড়ের জন্য ভালো হয়।

ক্রিকফ্রেঞ্জি: নিজেকে এটার ভুক্তভোগী মনে হয় কিনা..

মোসাদ্দেক: অনেক সময় হয়েছি। আপনি ভুক্তভোগি না হলে তো এটা বুঝতে পারবেন না। অবশ্যই হয়েছি তাই আমার জন্য বলা সহজ বলে আমি মনে করি।