আইপিএল

ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট, সাকিবদের দেশপ্রেম ও নাসেরের চোখে বাস্তবতা

মমিনুল ইসলাম

মমিনুল ইসলাম
প্রকাশের তারিখ: 02:05 বৃহস্পতিবার, 30 মার্চ, 2023

|| ডেস্ক রিপোর্ট ||

শ্রীলঙ্কায় টেস্ট না খেলে আইপিএলে খেলবেন সাকিব আল হাসান। ঘটনাটা ২০২১ সালের, প্রায় দুবছর পেরিয়ে গেলেও এখনও নিশ্চিতভাবেই মনে রয়েছে সবার। এমন খবরের শিরোনামে সেদিন বিস্মিত হয়েছিলেন দেশের বেশিরভাগ সমর্থক। দেশের খেলা বাদ দিয়ে কেন আইপিএল খেলতে চান সাকিব। এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে ক্রিকফ্রেঞ্জি হেঁটেছে অনেকটা পথ। বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় অবশেষে সোনার ডিম পাড়া হাঁস নয় সাকিবকে পেয়েছিল তারা।

সাক্ষাৎকারের আঙ্গিকে সেদিন যেন রীতিমতো বোমা ফাঁটিয়েছিলেন সাকিব। ব্যাখ্যা দেয়ার সঙ্গে সেদিন প্রশ্ন তুলেছিলেন নীতি-নির্ধারকদের নিয়েও। ক্রিকফ্রেঞ্জিতে দেয়া সাক্ষাৎকারের পর সাকিবের পক্ষে-বিপক্ষে লেখা হয়েছে অনেক। তবে আইপিএল খেলা থেকে আটকানো যায়নি বাংলাদেশের অলরাউন্ডারকে। পরের বছর অবশ্য দুবার নাম তোলা হলেও দলই পাননি সাকিব। যদিও তার স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশির জানিয়েছিলেন, সাকিবকে পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল আইপিএলের দুটি ফ্র্যাঞ্চাইজি।

পুরো মৌসুম খেলতে পারবেন না ভেবেই নাকি তাকে শেষ পর্যন্ত দলে টানেনি তারা। এবার অবশ্য আইপিএলে দেখা যাবে সাকিবকে। কলকাতা নাইট রাইডার্সের জার্সিতে আড়াই মাসের টুর্নামেন্টে এই অলরাউন্ডার খেলতে পারবেন কেবল ২৪ দিন। এমন তথ্য বেশ পুরোনো। নিলামের দিনই এমন খবর ভেসে বেড়িয়েছিল দেশের ক্রিকেটে। আয়ারল্যান্ড সফর করতে হবে বিধায় পুরো আইপিএলের জন্য সাকিবকে ছাড়তে নারাজ বিসিবি। বোর্ড সভাপতি থেকে কর্তারা, সবার কাছেই প্রায় একই উত্তর, ‘দেশের খেলা আগে, আইপিএল নয়।’

নিজেদের এমন সিদ্ধান্তে যে তারা এখনও অটল সেটা কদিন আগে নিজে থেকে জানিয়েছেন নাজমুল হাসান পাপন। অথচ পুরো আইপিএল খেলতে আবেদন করেছেন সাকিব, লিটন দাস ও মুস্তাফিজুর রহমান। গেল কয়েকদিনের খবরে এটা প্রায় নিশ্চিত পুরো মৌসুম খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। দেশের খেলার আগে আইপিএলকে বিবেচনা করতে চায় না বিসিবি। এমন কথার পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে বেশ। তবে খানিকটা পেছন ফেরা যাক।

বিতর্ক তৈরি করে ২০২১ আইপিএল খেলা সাকিবকে বিপাকে পড়তে হয়েছিল পরের মৌসুমে। নিলামে দুবার নাম তোলা হলেও সেবার দল পাননি। সাকিবের দল না পাওয়ার খবরে দেশের সমর্থক গোষ্ঠীর অনেকের দাবি ছিল, এটা দেশের জন্য অপমানজনক। অথচ সাকিব দল পেয়ে আইপিএল খেলতে চাইলে হয়ে যান দেশদ্রোহী। নিশ্চিতভাবে আরও একবার এমন কথার সামনে পড়তে হচ্ছে অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডারকে। যেখানে নতুন করে তার সঙ্গী মুস্তাফিজ ও লিটন। তাদের পুরো আইপিএল খেলতে না দেয়ার পেছনে বড় যুক্তি আয়ারল্যান্ড সফর।

সেটা বাংলাদেশের জন্য আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আইসিসি ওয়ানডে সুপার লিগের অংশ হওয়ায় নিশ্চিতভাবে আলাদা গুরুত্ব বহন করছে সেটা। তবে ঘরের মাঠে তাদের দাপুটে পারফরম্যান্স ও বিশ্বকাপে সরাসরি খেলা চূড়ান্ত হওয়ার পর সিরিজটি কি আসলেই গুরুত্ব বহন করে? প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকবে বোধ করি। সবশেষ কবছর আমরা ফলাও করে বলে বেড়িয়েছি ওয়ানডেতে আমরা ভালো দল। আমাদের যে কাউকে হারিয়ে দেয়ার সামর্থ্য রয়েছে। পরিসংখ্যানও সে কথাই বলবে।

সেটাই যদি হয় আমরা কেন এখনও ধরাবাধা ১১ জন ক্রিকেটারের মাঝে আটকে আছি। সাকিব, লিটন কিংবা মুস্তাফিজকে ছাড়া কি তবে আমাদের জয়ের সামর্থ্য নেই। যদি থাকে তাহলে আইপিএল খেলতে দিতে বাধা কোথায়? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তবে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রসারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যে প্রায়োরিটির লিস্টে নিচের দিকে নামছে সেটা বোধ করি বলার প্রয়োজন নেই। সাকিবের আইপিএল খেলার খবর বেরোলেই সবচেয়ে বেশি যে কথাটি চর্চিত হয় সেটা হলো দেশপ্রেম।

প্রায় মাস দুয়েক আগের কথা, লোভনীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আর দেশের খেলা নিয়ে কথা বলেছিলেন নাসের হুসেইন। আলোচনার বিষয়বস্তু অবশ্য ছিল বাংলাদেশ সফরে না এসে পিএসএল খেলা অ্যালেক্স হেলস ও স্যাম বিলিংস। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে সেদিন লাভজনক, জনপ্রিয় এবং ক্ষতিকারক দ্বি-ধারী তলোয়ার হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন মাইকেল আথারটন ও নাসের। আলোচনার একটা পর্যায়ে এসে নাসের বলে বসেছিলেন, ‘স্বীকৃতির দিক থেকে ক্রিকেট এখনটা বদলে গেছে। তারা ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে চায় না, এটা অপমানজনক। আমাদের এমন কথা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’

কেন এমন চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সেটাও ব্যাখ্যাও করেছিলেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক। পিএসএলে ১ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ডে চুক্তি করেছিলেন হেলস। অথচ ইংল্যান্ডের খেললে তিনি পেতেন মাত্র ২৫ হাজার পাউন্ড। সাকিবের কথাই ধরুন না, আইপিএলে কলকাতার জার্সিতে খেললে দেড় কোটি টাকা পাবেন সাকিব। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই টুর্নামেন্টের সময় বাংলাদেশের হয়ে খেললে সাকিব খুব বেশি হলে পাবেন ১৫-২০ লাখ টাকা। নিশ্চিতভাবেই আইপিএলে গেলে বেশি লাভবান হবেন সাকিব। কিন্তু সাকিব কিংবা লিটনের যাওয়াটা কি কেবলই টাকার জন্য?

সাকিবের বর্তমানে যে ব্র্যান্ড ভ্যালু তাতে বিজ্ঞাপন করে এই টাকা কামাতে সাকিবের লাগবে মোটে একদিন। তবে দেশের সিংহভাগ সমর্থকদের ভাবনা সাকিব টাকার জন্য সব কিছু করবেন। সেই ভাবনা যদি সঠিক ধরে নিই তবে আইপিএলে যাওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন নেই তার। কারণ এই আড়াই মাসে চাইলে সেখানকার চেয়ে ১০-২০ গুণ বেশি টাকা কামাতে পারবেন অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার। সাকিবের আইপিএল খেলতে চাওয়াটা যে শুধুই টাকার জন্য নয় সেটা পরিস্কার। তবে সেখানে গেলে তার ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়বে এটাও ঠিক।

বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক, লিটন আর মুস্তাফিজকে কেন আইপিএলে যেতে দেয়া উচিত? সেটার সবচেয়ে বড় উত্তর বোধহয় বছরের শেষ দিকে ভারতের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ। আইসিসির এই টুর্নামেন্টকে সামনে রেখে সব দেশের ক্রিকেট বোর্ডই আইপিএল খেলার জন্য তাদের ক্রিকেটারদের ছেড়ে দিয়েছেন। আড়াই মাস ভারতে থেকে প্রস্তুতি নিতে পারলে সেটা যে বিশ্বকাপে কাজে দেবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই যখন এমন ভাবনার পথে হাঁটছে বিসিবি তখন আসলে কোন পথে হাঁটবে? এমন প্রশ্নের উত্তর পেতে ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে নাটকের শেষাংশ মঞ্চায়ন না হওয়া পর্যন্ত।