বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ২০২৩

করোনা, উবার ইটস এবং বদলে যাওয়া ম্যাকেরেন

আবিদ মোহাম্মদ

আবিদ মোহাম্মদ
প্রকাশের তারিখ: 22:16 বুধবার, 04 জানুয়ারি, 2023

|| ক্রিকফ্রেঞ্জি করেসপন্ডেন্ট ||

‘জীবনের প্রতিটি সিঁড়িতে পা রেখে ওপরে ওঠা উচিত, ডিঙ্গিয়ে উঠলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি’ আমেরিকান লেখক জন গ্রিনলিফ হুইটিয়ারের বলা উক্তিটির সঙ্গে হয়তো বাস্তব জীবনের মিল খুঁজে পান পল আদ্রিয়ান ফন ম্যাকেরেন। নেদারল্যান্ডসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। ফুটবল আর হকিতে বুঁদ হয়ে থাকা দেশটায় ক্রিকেটার হতে তাই সিদ্ধান্ত নিতে হয় ভেবে-চিন্তে। ম্যাকেরিন যে সেটা ঠিকঠাক করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাবার মতো ফুটবলের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন। দুটোকে একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে উঠায় ক্রিকেট ও ফুটবলের মাঝে ২২ গজের লড়াইকে বেছে নেন ২৯ বছর বয়সি এই ক্রিকেটার। তাতেই যেন জীবনের বাঁক বদলে খুঁজে পেয়েছেন নতুন মোড়। যা দুয়ার খুলে দেয় বিভিন্ন দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সই মূলত সব দুয়ার খুলে দিয়েছে ম্যাকেরেনের।

ইংলিশ কাউন্টির সঙ্গে সিপিএল-এলপিএল মাতানো ম্যাকেরেনের নতুন ঠিকানা বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল)। খেলবেন তামিম ইকবালের সঙ্গে খুলনা টাইগার্সে। বিপিএল খেলতে বাংলাদেশে মাটিতে পা রেখেছেন এই ডাচ পেসার। প্রথমবারের মতো লাল-সবুজের দেশটিতে এলেও সাকিব আল হাসান-তাসকিন আহমেদদের ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা আছে তার। গেল বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষেই ২ উইকেট নিয়েছিলেন ডানহাতি এই পেসার।

এছাড়া বিশ্বকাপে ১১ উইকেট নিয়ে আলো ছড়িয়ে আলোচনায়ও ছিলেন ম্যাকেরেন। তবে ক্রিকেটার ম্যাকেরেনের বাইরে আরও একটি পরিচয় আছে। জীবন কখনও কখনও না চাইতেও অনেক কিছুই করায়। ম্যাকেরেনও সেসবের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। ২০২০ সালে করোনাকালে পেটের দায়ে কাজ করেছেন খাবার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান উবার ইটসে।

২০২০ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পিছিয়ে যাওয়ায় একটি আবেগঘন টুইটও করেছিলেন এই পেসার। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক সাড়াও ফেলেছিল। তাই করোনাকালে জীবনের নতুন মোড়ও দেখা হয়ে গিয়েছে ম্যাকেরিনের। এছাড়া সহযোগী দেশগুলোর সদস্য হওয়ায় নানা চড়াই-উতরাই দেখেই জীবনকে চিনেছেন ডাচ এই ক্রিকেটার।

নেদারল্যান্ডসের নাগরিক হওয়ায় ম্যাকেরেনকে লড়াই করতে হয়েছে ফুটবল ও হকির সঙ্গেও। জনপ্রিয়তার বিচারে ক্রিকেট এই দুটি খেলার আশে-পাশেও নেই। ফুটবল দেশটির সবার রক্তে মিশে থাকলেও ১১-১২ বছর বয়সেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন কোন পেশায় নিজেকে যুক্ত করবেন। তবে এর আগে ক্রিকেট ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবলেও বাবার পরামর্শেই আজ এতো পথ পাড়ি দিয়েছেন ২৯ বছর বয়সী এই পেসার।

ক্রিকফ্রেঞ্জির সঙ্গে একান্ত আলাপকালে জানিয়েছেন নেদারল্যান্ডসে ক্রিকেট নিয়ে সবার ভাবনা ও দেশটির ক্রিকেটীয় অবস্থার কথা। ম্যাকেরিন বলেন, ‘নেদারল্যান্ডসে ফুটবল সবার রক্তে আছে, আর ফিল্ড হকি। ক্রিকেট নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ। আমাদের খুব বেশি ছেলে নেই যারা ক্রিকেট জানে। সুযোগ-সুবিধাও তেমন নেই। সাধারণত ফুটবল পিচে আর্টিফিশিয়াল উইকেট বসিয়ে ক্রিকেট খেলি।’

দেশটির কোথাও ক্রিকেটের সম্প্রচার করা হয় না। পত্র-পত্রিকাতেও খবর আসে না। কিন্তু তাতে কি! ঘরোয়া ক্রিকেট দেখে বেড়ে ওঠা ম্যাকেরেন তার নায়কদের পথ অনুসরণ করেছেন। পরবর্তীতে ১৭ বছর বয়সে যুক্তরাজ্যে আসার পর টেলিভিশনে ক্রিকেট দেখার সুযোগ পান তিনি। তাই জীবনের প্রতিটি মোড়ে নতুন নতুন গল্পের সাক্ষী হওয়া এই ক্রিকেটার নিজেকে ভাগ্যবানই দাবি করেছেন।

ম্যাকেরেন বলেন, ‘আমি ছোটবেলায় ফুটবল খেলতাম। ক্রিকেটের চেয়ে বেশি পছন্দও করতাম। কিন্তু বড় হতে হতে ক্রিকেটকেই বেছে নিয়েছি। ক্রিকেট থামিয়ে দিতে চেয়েছিলাম একসময়। কিন্তু বাবা বললো আরেকটা বছর চেষ্টা করো। এরপর আর ছাড়া হলো না। খেলাটায় এখন নিজেকে ভাগ্যবানই মনে হয়। অনেক বড় ক্রিকেটারের সঙ্গে খেলেছি। আশা করি সামনে আরও ডাচ ছেলেরা ক্রিকেটে আসবে।’

‘আমস্টারডমে টিভিতে, পত্রিকায়, ওয়েবসাইটে কোথাও ক্রিকেট নেই। আমি ঘরোয়া ক্রিকেট দেখেই বেড়ে উঠেছি, ওখানে আমার নায়করা খেলতেন। পরে ১৬-১৭ বছর বয়সে টিভিতে ক্রিকেট দেখা শুরু করেছি। ছয় বছর ধরে যুক্তরাজ্যে আছি। এখানে তো ক্রিকেট আছে। তবে দলের দিকেই নজর রাখতে চাই।' আরও যোগ করেন তিনি।

যুক্তরাজ্যে পাড়ি দিয়ে ইংলিশ কাউন্টি খেলে বোলিংয়ে আরও ধাঁরালো হয়ে উঠেছেন ম্যাকেরেন। উচ্চতা কাজে লাগানোর সঙ্গে ইয়র্কারেও দারুণ পারদর্শী এই পেসার। বিশ্বকাপ ছাড়া বাছাইপর্বেও দারুণ বোলিং করেছেন। তবে করোনাকালে সব ওলট-পালট হয়ে গেলেও ধীরে ধীরে নিজেকে ফের খুঁজে পেয়েছেন তিনি। কারণ তিনি নিজের যোগ্যতার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা রেখেছিলেন।

কংক্রিটের ফুটবল পিচে ব্ল্যাক শিট বসিয়ে নিয়মিত বোলিং চালিয়ে গিয়েছেন। নিজেকে ফিট রাখতে সব প্রকার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া অনলাইনে কোচদের পরামর্শ ও নেপালে দলের সঙ্গে ক্যাম্প তাকে সাহায্য করেছেন। করোনাকাল, ইংলিশ কাউন্টি আর ক্রিকেটে ফিরে আসা নিয়ে ম্যাকেরেন বলেন,' স্বপ্ন দেখতাম তো অবশ্যই। জানতাম ফেরার মতো ভালো ক্রিকেটার আমি। কিন্তু তখন চারদিকে করোনা ঘিরে ধরেছে, ক্রিকেটের সুযোগই কম ছিল। শক্ত নিয়ম ছিল কাউন্টি ক্রিকেটে। শীতে টিকে থাকার জন্য কিছু করতেই হতো। উবার ইটস ওই সুযোগটা করে দিয়েছিল।’

‘ওই সময় কাজটা আসলে উপভোগও করেছি। আবার যদি কখনো বাড়তি টাকার দরকার হয়, তখন আবার করবো। কিন্তু যুক্তরাজ্যের রাস্তার চেয়ে এখানকার কাজটার চেয়ে এখানে (ক্রিকেটে) থাকাটাকেই বেশি ভালো মনে হচ্ছে। লকডাউনে আমার জাতীয় দলের সঙ্গে নেপালে আসার কথা ছিল। ইনডোর ফ্যাসিলিটিজ তখন বন্ধ ছিল। আমার শরীরকে কোনোভাবে তৈরি করতে হতো বোলিংয়ের জন্য। এরপর কংক্রিটের ফুটবল পিচে ব্ল্যাক শিট বসিয়ে বল করতে শুরু করলাম। জানি না এটা কতটুকু সাহায্য করেছে।’

‘কারণ নেপালে খুব একটা ভালো হয়নি। কিন্তু এটা শুধু কেবল ইম্প্রোভাইজ, নতুন আইডিয়ার ব্যাপার ছিল। যেন তৈরি ও ফিট থেকে খেলতে নামতে পারি। আমার মনে হয় এটা খুব দারুণ কিছু টেকনিক্যাল ব্যাপার নিয়ে কাজ করেছি। কারণ আপনার কখনো কখনো কী ফল আসবে, তার দিকে তাকালে হবে না। মাঝেমধ্যে এটা নিয়ে আমরা বেশিই চিন্তা করে ফেলি। আমি শুধু নিজের শরীর ও বল করার সময় এর অনুভূতির ব্যাপারেই খেয়াল রাখি। এর বাইরে কিছু না। অনলাইন অ্যাপে এক কোচের সঙ্গে কথা হতো। উনি কিছু ব্যাপারে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল। সেগুলো মেনেই তখন খেলতে গিয়েছিলাম।' আরও যোগ করেন ম্যাকেরেন।’

ম্যাকেরেনের বাবা নিজেও ছিলেন একজন ক্রিকেটার। তবে বাকি সবার মতো তিনিও ফুটবল খেলতেন। বাবার ক্লাব দিয়েই এই পেসারের স্বপ্ন যাত্রার সূচনা। সেখানে দুটো খেলা খেললেও শেষ পর্যন্ত ক্রিকেটকে কেন বেছে নিয়েছেন ১১ বছর বয়সেই। এছাড়া বোলিংয়ে আসার পেছনে কোচদের সাহায্য ছিল, তবে তা তিনি পেয়েছেন প্রকৃতিগতভাবে।

ম্যাকেরেন বলেন, 'আমার বাবা ক্রিকেট খেলতেন। উনি ফুটবল শুরু করেছিল নেদারল্যান্ডসের বাকি ছেলেদের মতোই। উনার ক্লাবে ক্রিকেটও ছিল। পরে উনি সেটাকে বেছে নেয়। আমি শুরুতে দুটাই খেলতাম। কিন্তু একসঙ্গে চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে ক্রিকেটকে বেছে নিয়েছি। আমার মনে হয় এটাতে কিছুটা ভালো ছিলাম, এজন্য (হাসি)। ছোটবেলায় অবশ্য একটু ব্যাটও করতাম। কিন্তু প্রতি বলেই ছক্কা হাঁকাতে যেতাম, এটাই ছিল সমস্যা।'

‘এজন্য হয়তো কোচরা আর ব্যাটিং করাতে চায়নি। বোলিং কিছুটা প্রকৃতিগতভাবেও পেয়েছি। লম্বা ছিলাম, পেস বোলারদের জন্য এটা বাড়তি সুবিধা। গতিও ছিল। যখন কোনো ছেলে ক্রিকেট বল হাতে নেয়, ব্যাটিং-বোলিং দুটাই করে। এরপর যত দিন আগায়, একটাতে উন্নতি করতে শুরু করে। বোলার, ব্যাটার, অলরাউন্ডার হয়। আমার জন্য ব্যাপারটা একই ছিল। বোলিংটা ছিল স্বভাবজাত। এরপর আস্তে আস্তে ব্যাটিংয়ের ধারটা কমে গেল।’